‘বোওল-আউট’ বলবেন, না তামাশা?
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তার অনুপম এক প্রদর্শনীর সঙ্গে সবচেয়ে মানানসই ফলটাই হয়েছিল। টাই! কিন্তু টোয়েন্টি-টোয়েন্টি নামের উত্তর আধুনিক ক্রিকেট যে মীমাংসাহীন কিছু মানতে রাজি নয়। সেটির একজন বিজয়ী লাগবে। তা ‘বোল-আউট’ নামের তামাশার মাধ্যমে হলেও!
প্রথম প্রকাশ: ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০০৭। প্রথম আলো।
‘ম্যাচের’ শেষ ১৫ মিনিট যা হলো, সেটি ক্রিকেট নয়। তামাশা!
ম্যাচের শব্দটিতে ঊর্ধ্বকমা দেওয়ার কারণ, ওই শেষ ১৫ মিনিট আসলে ম্যাচের অংশও নয়। ম্যাচ শেষ হয়ে গেছে শেষ বলে মিসবাহ-উল হক রান আউট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তার অনুপম এক প্রদর্শনীর সঙ্গে সবচেয়ে মানানসই ফলটাই হয়েছিল। টাই! কিন্তু টোয়েন্টি-টোয়েন্টি নামের উত্তর আধুনিক ক্রিকেট যে মীমাংসাহীন কিছু মানতে রাজি নয়। সেটির একজন বিজয়ী লাগবে। তা ‘বোল-আউট’ নামের তামাশার মাধ্যমে হলেও!
রেকর্ড বইয়ে এই ম্যাচের বিজয়ী হিসেবে লেখা থাকবে ভারতের নাম। সঙ্গে হয়তো একটা ফুটনোট—‘টাই’ ম্যাচের পর ‘বোল-আউট’-এ ভারত ৩-০-তে জয়ী। এই ৩-০টা কী? বোলারদের ফাঁকা স্টাম্পে বল লাগানোর দক্ষতাই যখন এর নিয়ামক, ব্যবধানটাকে কি উইকেট বলা হবে?
ফুটবলের টাইব্রেকারের ব্যবধানকে গোলই বলা হয়। তবে ফুটবলে তো জয়-পরাজয়ের নির্ধারক শুধুই গোল। ক্রিকেটে তো রানের ব্যবধানে জয়-পরাজয় আছে, আছে উইকেটের ব্যবধানেও। ফুটবলের টাইব্রেকারের সঙ্গে টোয়েন্টি-টোয়েন্টির ‘বোল-আউট’-এর আরেকটি বড় পার্থক্যও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল গত পরশুর ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। ফুটবলে টাইব্রেকার তখনই হয়, যখন একজন বিজয়ী নির্ধারণ না করলে আর চলছে না। সেটি চ্যাম্পিয়নশিপ নিষ্পত্তির জন্য হতে পারে, হতে পারে পরের রাউন্ডে কোন দল যাবে, সেটি ঠিক করার প্রয়োজনেও। এই নিয়ম অনুসরণ করলে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে ‘বোল-আউট’-এর প্রয়োজনই ছিল না। ম্যাচ ‘টাই’য়ে শেষ হওয়ারও প্রায় ৬ ওভার আগেই দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠা নিশ্চিত হয়ে গেছে দু দলেরই। কিন্তু ওই যে বললাম, টোয়েন্টি-টোয়েন্টি সমতায় বিশ্বাস করে না, তার একজন জয়ী লাগবেই।
পরিহাসই বলতে হবে এটিকে, ব্যাটে ও বলে লড়াইয়ের মৌলিক ব্যাপারটিকেই প্রহসন বানিয়ে ফেলা ফরম্যাটের যে ম্যাচটিতে ক্রিকেট তার পরিপূর্ণ মহিমায় প্রকাশিত হলো, সেটিরই শেষটা হলো ‘বোল-আউট’-এর তামাশায়।
‘বোল-আউট’-এর সময় কিংসমিডে দর্শকদের উত্তেজনা দেখছিলাম টেলিভিশনে, আর চর্মচক্ষে সহ-দর্শকদের। দেখতে দেখতে ‘এটা ক্রিকেট নয়’—বদ্ধমূল এই ধারণার মধ্যেও বুদ্বুদের মতো অন্য একটা চিন্তা ভেসে উঠছিল। খেলার অর্থ যদি বিনোদন হয়, আনন্দ হয়; তা হলে ‘বোল-আউট’-এ দোষ কি! ক্রিকেট-দর্শকদের এমন স্বতঃস্ফূর্ত উচ্ছ্বাস তো আগে কখনো দেখিনি। টেলিভিশনে দু দলের খেলোয়াড়দের দেখেও মনে হলো, ক্রিকেট মাঠে এমন মজা এর আগে আর তাঁরা পাননি। একটু দাঁড়ান, সেটি নিশ্চয়ই এই ‘বোল-আউটে’ জয়-পরাজয়ের কোনো তাৎপর্য ছিল না বলে।
একবার ভাবুন তো, এই ‘বোল-আউট’ই যদি ভারত না পাকিস্তান কোন দল দ্বিতীয় রাউন্ডে যাবে, সেটির নির্ধারক হতো! তখন কি আর খেলোয়াড়দের এমন নির্ভার দেখাত! শুধু স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক নয়, এই দু দেশের কোটি কোটি মানুষকেও দিতে হতো হৃদযন্ত্রের সক্ষমতার পরীক্ষা। টোয়েন্টি-টোয়েন্টির প্রবক্তারা হয়তো বলবেন, ‘আমরা তো এটাই চাই। চাই উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপুক মানুষ।’ সে চাওয়ায় দোষের কিছু নেই। কিন্তু এই টোয়েন্টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালটা যদি ‘বোল আউট’-এ নিষ্পত্তি হয়! যদি ক্রিকেট দক্ষতার পরিবর্তে ভাগ্যই হয়ে দাঁড়ায় বিশ্ব জয়ের নির্ধারক!
পরিহাসই বলতে হবে এটিকে, ব্যাটে ও বলে লড়াইয়ের মৌলিক ব্যাপারটিকেই প্রহসন বানিয়ে ফেলা ফরম্যাটের যে ম্যাচটিতে ক্রিকেট তার পরিপূর্ণ মহিমায় প্রকাশিত হলো, সেটিরই শেষটা হলো ‘বোল-আউট’-এর তামাশায়। কংক্রিটের মতো উইকেট, ক্রমশ ভালো হতে থাকা ব্যাট, বোলারদের হাত-পা বাঁধার নানা আয়োজন মিলে যত দিন যাচ্ছে, ততই ক্রিকেটকে শুধু ব্যাটসম্যানদের খেলা বানিয়ে ফেলার চেষ্টা চলছে। তিতিবিরক্ত মাইকেল হোল্ডিং তো রেকর্ড বইয়ে দুটি আলাদা ভাগ করার প্রস্তাবই করে বসেছেন—প্রপার ক্রিকেট ও মিকিমাউস ক্রিকেট। প্রপার ক্রিকেট—যত দিন বোলাররা ক্রিকেটের সত্ ছেলেতে পরিণত হয়নি। মিকিমাউস ক্রিকেট—দর্শকেরা শুধু চার-ছয় দেখতে চায়, এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে গত কিছুদিন যা হচ্ছে। আধুনিক কালের টেস্ট ক্রিকেটকেই মিকিমাউস ক্রিকেট নাম দিয়ে ফেলেছেন হোল্ডিং, টোয়েন্টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে তিনি না জানি কী বলেন! হায়, যুগের চাহিদা এমনই অপ্রতিরোধ্য যে, মাইকেল হোল্ডিংও ঠিকই টোয়েন্টি-টোয়েন্টির ধারাভাষ্য দিয়ে যাচ্ছেন!
একবার ভাবুন, টোয়েন্টি-টোয়েন্টির সব বাধা জয় করেও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটি কীভাবে ক্লাসিক হয়ে গেল! বারবার রং বদলে রুদ্ধশ্বাস এক সমাপ্তি—ক্লাসিক ক্রিকেট ম্যাচের মিনিয়েচার এক সংস্করণ। দু দলই করেছে ১৪১—টোয়েন্টি-টোয়েন্টির বিচারে নিতান্তই লো-স্কোরিং। অথচ দর্শকদের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে এ ম্যাচটিই, ৪১৩ রানের উদ্বোধনী ম্যাচ নয়। সেটি যে ছিল শুধুই অসহায় বলের ওপর ব্যাটের সদম্ভ আস্ফালন, আর এটিতে ব্যাটে-বলের রোমাঞ্চকর লড়াই।
ব্যাট হাতে উথাপ্পা-ধোনির লড়াই-দৃঢ়প্রতিজ্ঞা আর মিসবাহ-উল হকের হার না মানা দুর্জয় সাহসের মতো বল হাতে মোহাম্মদ আসিফের স্কিলের প্রদর্শনীও এখানে একই রকম স্মরণীয়। একটা শিক্ষাও কি দিয়ে গেল না এই ম্যাচ? শুধু ধুন্ধুমার ব্যাটিংয়ে চার-ছয়ের ফুলঝুরিই নয়; ক্রিকেট তখনই সুন্দরতম, যখন এটিতে ব্যাট-বলের সুষম লড়াই হয়। না, দর্শক মনোরঞ্জনের জন্য তখন ‘বোল-আউট’ নামের তামাশারও প্রয়োজন হয় না।