চলিতেছে সার্কাস...

উৎপল শুভ্র

২৯ অক্টোবর ২০২১

চলিতেছে সার্কাস...

এই বিশ্বকাপে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে বাংলাদেশ যতই বিবর্ণ হোক না কেন, মাঠের বাইরের কথা-পাল্টা কথা, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এসবের বিচারে বাংলাদেশ এরই মধ্যে চ্যাম্পিয়ন। আর কোনো দল ধারে কাছেও আসতে পারবে বলে হয় না। যা দেখেশুনে বলতে ইচ্ছা করছে, চলিতেছে সার্কাস...

মাস পাঁচেক আগে এই ওয়েবসাইটে এক পাঠকের লেখার ওই শিরোনামটা খুব মনে পড়ছে। বিসিবির কর্মকাণ্ড এবং নির্বাচকদের কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে ওই লেখাটার শিরোনাম ছিল: চলিতেছে সার্কাস...। 

পুরোনো সেই শিরোনাম মনে পড়ার কারণ, টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ নিয়ে বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা নিয়ে কিছু লিখতে গেলে সেই লেখার আদর্শ শিরোনামও মনে হচ্ছে ওটাকেই। চলিতেছে সার্কাস…

মাঠের খেলার বদলে বড় হয়ে উঠছে মাঠের বাইরের বিতর্ক। এই বিশ্বকাপে ব্যাট-বলের লড়াইয়ে বাংলাদেশ যতই বিবর্ণ হোক না কেন, মাঠের বাইরের কথা-পাল্টা কথা, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এসবের বিচারে বাংলাদেশ এরই মধ্যে চ্যাম্পিয়ন। আর কোনো দল ধারে কাছেও আসতে পারবে বলে হয় না।

নাজমুল হাসান, সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ, মুশফিকুর রহিম, মাশরাফি বিন মুর্তজা...এঁরাই সরগরম করে রেখেছিলেন সংবাদ মাধ্যম। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কথা আর না-ইবা বললাম। এটিকে শুধু ক্রিকেটার আর বোর্ড কর্মকর্তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ক্রিকেটারদের পরিবার-পরিজনও দেখছি এখন নেমে পড়েছেন মাঠে।

সর্বশেষ সংযোজন আজ দুপুরে সাকিব আল হাসানের স্ত্রী সাকিব উম্মে আল হাসানের ফেসবুক স্ট্যাটাস। সুন্দর ইংরেজিতে লেখা যে স্ট্যাটাসের বাংলা করলে তা এমন দাঁড়ায়: ‘আমরা ২০১৯ বিশ্বকাপ নিয়ে একটু কথা বলতে পারি। আমি ভাবছি ভারত, পাকিস্তান, ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডের মতো বড় দলগুলোর বিপক্ষে আমরা কেন জিততে পারিনি, যখন আমাদের গতি-তারকারা এবং কথিত সেরা উদ্বোধনী জুটি ছিল! কী ভুল হয়েছিল ওই ম্যাচগুলোতে, কৌতূহলী মন তা জানতে চায়। আমি যদি সেই ভুলগুলো নিয়ে আলোচনা করার জন্য তখন কিছু টক শো করতাম, তাহলে আজ আমাদের এই ব্যর্থতা দেখতে হতো না।’

সাকিবের স্ত্রী শিশির কারও নাম উল্লেখ করেননি। তবে ‘গতিতারকা’ এবং ‘কথিত সেরা উদ্বোধনী জুটি’ থেকে বুঝে নিতে সমস্যা হয় না, খোঁচাটা তিনি কাকে দিয়েছেন। চরিত্র যেহেতু একাধিক, ‘কাকে’ না বলে ‘কাকে কাকে’ বলাটাই ঠিক হবে। ২০১৯ বিশ্বকাপ স্মৃতিতে আছে, এমন যে কেউই এখানে ‘গতিতারকা’ বলতে মাশরাফি বিন মুর্তজা আর ‘সেরা উদ্বোধনী জুটি’ বলতে তামিম ইকবালকে বুঝে নেবেন। শিশির কথাটায় একটু ফাঁক রাখতেই হয়তো দুই ক্ষেত্রেই বহুবচন ব্যবহার করেছেন। যা বলতে চান, সেটা বলাও হলো; আবার একটু ফাঁকও থাকল, যাতে দাবি করা যায়, ‘আমি তো কোনো একজনের কথা বলিনি’।

তবে এমন একটা স্ট্যাটাস যিনি দিতে পারেন, মনে হয় না, এমন নিরাপদ থাকার কোনো চিন্তা তাঁর মাথায় ছিল। ২০১৯ বিশ্বকাপে সাকিব কেমন দুর্দান্ত খেলেছিলেন, সেটা যেমন সবার জানা; তেমনি মাশরাফি ও তামিম যে ভালো করতে পারেননি, সেটাও কারও অজানা নয়। কিন্তু সোয়া দুই বছর পর আরেকটি বিশ্বকাপে তা মনে করিয়ে দেওয়ার কারণটা কী? ২০১৯ বিশ্বকাপের ভুলগুলো নিয়ে তিনি টক শো করলে আজ এই ব্যর্থতা দেখতে হতো না, এই কথাটার মর্মার্থও কারও বুঝতে না পারার কথা নয়। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া তামিম ইকবাল এই বিশ্বকাপ নিয়ে টিভিতে নিয়মিত টক শো করছেন, এটুকু জানা থাকাই যথেষ্ট।

শিশিরেরই কথা হোক, বা শিশিরকে মাধ্যম করে সাকিবের কথা...তা আসলে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ দলের মধ্যকার অস্থিরতাটা নতুন করে প্রকাশিত হয়ে পড়া। আগামী কয়েক দিন আরও কথা-পাল্টা কথা, আরও অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, আরও কাদা ছোড়াছুঁড়ির দুয়ারও খুলে যাওয়া।

মাশরাফির ছোট ভাই মোরসালিন বিন মুর্তজা আবার এই স্ট্যাটাসের জবাবও দিয়েছেন দেখলাম। যদি এরই মধ্যে তা না দেখে থাকেন, আপনার জন্য সেটিও তুলে দিই, ‘আমি একটা বিষয় নিয়ে কথা বলার আগে আমাকে জানতে হবে যে, সেই বিষয় নিয়ে কথা বলার মত জ্ঞান আমার আছে কি না।
হাত ঠেলার অভ্যাস সবারই থাকে কিন্তু, নিজের জ্ঞানের পরিসীমা বুঝে কথা বলার অভ্যাস সবার থাকে না।’

ফেসবুকে এমন কোনো স্ট্যাটাস দেওয়া মানে যার যা ইচ্ছা বলার সুযোগ করে দেওয়া। সেই সুযোগ নিচ্ছেনও অনেকে। এটা কি শিশিরের নিজের দেওয়া স্ট্যাটাস, নাকি সাকিব আল হাসান তাঁর কথাগুলোই স্ত্রীর মুখ দিয়ে বলাচ্ছেন, যৌক্তিক এমন সন্দেহও প্রকাশ করতে দেখলাম অনেককে।

এটা শিশিরেরই কথা হোক, বা শিশিরকে মাধ্যম করে সাকিবের কথা...তা আসলে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, এর মাধ্যমে বাংলাদেশ দলের মধ্যকার অস্থিরতাটা নতুন করে প্রকাশিত হয়ে পড়া। আগামী কয়েক দিন আরও কথা-পাল্টা কথা, আরও অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ, আরও কাদা ছোড়াছুঁড়ির দুয়ারও খুলে যাওয়া। যা এই বিশ্বকাপের শুরু থেকেই মহা সমারোহে চলিতেছে। স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে পরাজয়ের পর দিনই অসংখ্য টেলিভিশন বুমের সামনে বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন যেটির ‘শুভ উদ্বোধন’ ঘোষণা করেছেন।

স্কটল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়াটা বোর্ড সভাপতির বুকে লাগাটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশের কারই বা তা লাগেনি? তবে সেটির প্রতিক্রিয়া যে এমন প্রকাশ্য না হলেই ভালো হতো, এ ব্যাপারে মনে হয় না নাজমুল হাসান এবং তাঁর পারিষদবর্গ ছাড়া আর কারও কোনো দ্বিমত আছে। প্রতিক্রিয়ারও তো ধরন আছে। নাজমুল হাসান যেভাবে সিনিয়র তিন ক্রিকেটার সাকিব, মুশফিক ও মাহমুউল্লাহর নাম উল্লেখ করে পরাজয়ের জন্য সরাসরি তাঁদের দায়ী করলেন, ক্রিকেট ইতিহাসেই তা অভূতপূর্ব।টুর্নামেন্ট যেহেতু মাত্রই শুরু, তাঁর জন্য উচিত কাজ হতো সংবাদ মাধ্যমে নীরব থেকে যা বলার দলকে বলা। দলকেও আসলে কিছু না বলাটাই ভালো হতো; কিন্তু যেহেতু তিনি কিছু না বলে থাকতে পারেন না, সেজন্য কম ক্ষতিকর পথটার কথা বললাম আর কি!

স্কটল্যান্ডের কাছে বাংলাদেশের পরাজয় অবশ্যই পাকিস্তানের কাছে ভারতের পরাজয়ের চেয়ে অনেক বেশি অপ্রত্যাশিত। তবে ভারত-পাকিস্তান বৈরিতা, বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিপক্ষে ভারতের এত বছরের আধিপত্য, পরাজয়ের ধরন...এসব বিবেচনায় নিলে তো ভারতীয় বোর্ড প্রেসিডেন্টের আরও বেশি ক্ষুব্ধ হওয়ার কথা। বিশেষ করে সেই প্রেসিডেন্ট নিজেও যেখানে যৎসামান্য ক্রিকেট খেলেছেন। অথচ ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের দুদিন পর এ নিয়ে সৌরভ গাঙ্গুলী কী বলেছেন, তা কি আমাদের বোর্ড প্রেসিডেন্টের চোখে পড়েছে? সৌরভ কাউকে কাঠগড়ায় দাঁড় না করিয়ে, দলের পারফরম্যান্স নিয়ে বিন্দুমাত্র সমালোচনাও না করে যা বলেছেন, তার সারাংশ হলো: ক্রিকেটে এমন হতেই পারে। পরের ম্যাচেই হয়তো ওরা ফিরে আসবে। কারণ গত দুই বছর ধরে ওরা ভালো ক্রিকেট খেলছে।

ক্রিকেট বোর্ড যদি ক্রিকেটারদের অভিভাবক হয়ে থাকে, দল খারাপ করার পর বোর্ড সভাপতির কথা তো এমনই হওয়া উচিত। হারার পর তো এমনিতেই চারদিক থেকে ছুটে আসে সমালোচনার তির, বোর্ড সভাপতিও তাতে যোগ দিলে দলের খারাপ ছাড়া ভালো হওয়ার কোনো কারণ নেই। ওমানের বিপক্ষে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ম্যাচে ব্যাটিং অর্ডার নিয়ে পাগলামির পেছনেও বোর্ড সভাপতির অমন তীব্র সমালোচনার ভূমিকা না থেকে পারে না। যেটির জের সেখানেই শেষ হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে সাকিব আল হাসানের তির্যক উত্তর, মাহমুদউল্লাহ ও মুশফিকের বহুল আলোচিত পেইনকিলার ও আয়না-তত্ত্বের উৎসও তো এটি। যা ক্রিকেটারদের বাংলাদেশ ফ্যানদের প্রতিপক্ষই বানিয়ে দিয়েছে বলতে গেলে।

এসবের মধ্যেই আবার যোগ হয়েছেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। বিশ্বকাপ নিয়ে ফেসবুকে নিয়মিত স্ট্যাটাস দিয়ে যাওয়াটা বাংলাদেশ দলের প্রতি ভালোবাসা থেকেই উৎসারিত, এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। মাহমুদউল্লাহ ও তাঁর দলের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থনের কথা জানিয়ে তাদের উৎসাহ দেওয়ার কাজটাও করছেন মাশরাফি। তবে এর মধ্যে আবার নিয়ম করে কোচিং স্টাফের সমালোচনাও থাকছে। তা যৌক্তিক কি না, সেটা অন্য বিচার। কিন্তু একটা টুর্নামেন্ট চলার সময় এ ধরনের মন্তব্যে দলের উপকার হবে নাকি অপকার, এটা নিশ্চয়ই মাশরাফির অজানা নয়। কোচিং স্টাফ নিয়ে তাঁর যে মন্তব্যটা নানা জায়গায় উদ্ধৃত হয়েছে, সেটি নিয়েও তো প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশের কোচিং স্টাফ দেখলে সেটিকে দক্ষিণ আফ্রিকানদের রিহ্যাব সেন্টার বলে মনে হয়...কথাটাতে চটক আছে, কিন্তু তাতে সত্যের অপলাপও আছে।  মূল কোচিং স্টাফের (ব্যাটিং আর বোলিং ধরে) দুজনই না শুধু দক্ষিণ আফ্রিকান; পেস ও স্পিন বোলিং কোচ ওটিস গিবসন আর রঙ্গনা হেরাথ কোন দেশের মানুষ, এটা মাশরাফির জানা না থাকার কোনো কারণ নেই। তিরটা মূলত হেড কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর দিকেই, এটা তো বোঝাই যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশ দল যখন বিশ্বকাপে খেলছে, তখন কি এই প্রশ্ন তোলার উপযুক্ত সময়?

মাঠের যাচ্ছেতাই পারফরম্যান্সের সঙ্গে মাঠের বাইরের এসব মিলিয়েই তো ওই কথাটা বলতে ইচ্ছা করছে।

চলিতেছে সার্কাস...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×