পাণ্ডুলিপি মেনেই বিশ্বজয়ের হাসি!

উৎপল শুভ্র

২ এপ্রিল ২০২১

পাণ্ডুলিপি মেনেই বিশ্বজয়ের হাসি!

`আমি পাইলাম, আমি ইহাকে পাইলাম`। বিশ্বকাপ জয়ের পরদিন ট্রফি হাতে শচীন টেন্ডুলকার। ছবি: এএফপি

মনে রাখার মতো হিরণ্ময় স্মৃতি তো আর ২০১১ বিশ্বকাপ কম দেয়নি। বঙ্গবন্ধু-মিরপুর থেকে ওয়াংখেড়ে...টুকরো টুকরো কত ছবির কোলাজ! শেষ ফ্রেমেই সুন্দরতম ছবিটা। বিশ্বকাপ হাতে শচীন রমেশ টেন্ডুলকার!

প্রথম প্রকাশ: ৪ এপ্রিল ২০১১। প্রথম আলো।

বীরেন্দর শেবাগের চার দিয়ে শুরু, মহেন্দ্র সিং ধোনির ছক্কায় শেষ। বিশ্বকাপের শুরুতে ভারত, শেষটাও হলো ভারতকে দিয়েই। যেন নিপুণ চিত্রনাট্যকারের লেখা এক পাণ্ডুলিপি।

হিন্দি ছবিতে গল্পের গরু গাছে চড়ে। লাগামছাড়া কল্পনার সেই হিন্দি ছবির কারখানা মুম্বাইয়ে বিশ্বকাপের ফাইনাল। এর পাণ্ডুলিপিটাও যেন হিন্দি ছবির কোনো কাহিনিকারের লেখা!

আসলে তা নয়। হলে শচীন টেন্ডুলকারের শততম সেঞ্চুরিটা অবশ্যই হতো। অপরাজিত সেঞ্চুরিতে বিশ্বকাপ জিতে ব্যাট তুলে বেরিয়ে আসছেন টেন্ডুলকার—শেষ দৃশ্য হতো এটাই। জীবন হিন্দি ছবি নয়। নয় বলেই সেঞ্চুরির বদলে টেন্ডুলকার করলেন মাত্র ১৮।ফিরে আসছেন শচীন, মাত্র ১৮ করে। কিন্তু দিনশেষে তা কে-ইবা মনে রাখতে গেছে! ছবি: গেটি ইমেজেস

তাতে কী আসে-যায়! শততম সেঞ্চুরি যেদিন হওয়ার হবে। গত পরশু ওয়াংখেড়ের মায়াবী রাতে টেন্ডুলকারের এসব ‘তুচ্ছ’ বিষয় নিয়ে ভাবার সময় কোথায়! কখনো চোখ চিকচিক করছে, কখনো ভেঙে পড়ছেন হাসিতে। এই হরভজনকে জড়িয়ে ধরছেন তো এই কোনো সাপোর্ট স্টাফকে। গায়ে তেরঙ্গা জড়িয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলছেন, ‘আমার জীবনের সবচেয়ে গৌরবময় মুহূর্ত।’ হওয়ারই কথা। শচীন টেন্ডুলকারের অর্জনের মোটা খাতায় একটা পাতাই শুধু সাদা হয়ে ছিল। সেটিতে এখন বিশ্বকাপ ট্রফির ছবি। টেন্ডুলকার এখন ‘সব পেয়েছি’ ভুবনের বাসিন্দা।

বিশ্বকাপ জেতার হাজারও অনুপ্রেরণা আছে। ভারতীয় দল এর সঙ্গে যোগ করে নিয়েছিল এটাও—শচীনের হাতে কাপ তুলে দিতে চাই। বিশ্বকাপ জয়ের পর সবার প্রতিক্রিয়াতেই তাই থাকল এটা। সবচেয়ে ভালো বলেছেন বিরাট কোহলি। ভিক্টরি ল্যাপে টেন্ডুলকার থাকলেন সতীর্থদের কাঁধে। পুরো মাঠ ঘুরতে কষ্ট হয়নি? কোহলির উত্তর, ‘শচীন ২১ বছর ধরে পুরো জাতিকে কাঁধে বয়ে বেড়াচ্ছে। আর আমরা ওকে কাঁধে নিতে পারব না?’

যুবরাজ বলেছিলেন, এই বিশ্বকাপে তাঁর রূপান্তরের পেছনে আছেন 'বিশেষ একজন'। কে তিনি, প্রশ্ন করায় প্রথমে একটু রসিকতা করে নিলেন, ‘আপনাদের হতাশ করার জন্য দুঃখিত। এটা আমার গার্লফ্রেন্ড নয়, শচীন টেন্ডুলকার।’

এই বিশ্বকাপে টেন্ডুলকার-মহিমা শুধু রান আর সেঞ্চুরিতে সীমাবদ্ধ নয়। চার নম্বর ম্যান অব দ্য ম্যাচ পুরস্কার জিতে যুবরাজ সিং জানিয়েছিলেন, তাঁর এই রূপান্তরের পেছনে আছেন ‘বিশেষ একজন’। বিশ্বকাপ জিততে পারলে নাম বলবেন। বিশ্বকাপ জয়ের পর যুবরাজকে তাই প্রশ্নটা করা হলো। যুবরাজ প্রথমে একটু রসিকতা করে নিলেন, ‘আপনাদের হতাশ করার জন্য দুঃখিত। এটা আমার গার্লফ্রেন্ড নয়, শচীন টেন্ডুলকার।’ রসিকতা দিয়ে শুরু কথার শেষে যুবরাজের চোখ কৃতজ্ঞতায় ছলছলে।

শচীন টেন্ডুলকার কী করেছেন, তার বিস্তারিত এখনো অপ্রকাশিত। হয়তো কোনো একদিন বলবেন যুবরাজ। না-ও বলতে পারেন। কে জানে, টেন্ডুলকারই বারণ করে দিয়েছেন কি না! প্রচারের আলো সব সময় তাঁকে খুঁজে ফেরে বলেই হয়তো নিজে তাতে যথাসাধ্য আগল দিয়ে রাখেন। সেবামূলক কোনো কাজে জড়ালে প্রথম শর্তই থাকে, তিনি যে আছেন, এটা বলা যাবে না।

যুবরাজ ট্রফিতে আলাদা ভাগ চাইতেই পারেন। বিশ্বকাপ মিশনে ভারতের সবচেয়ে বড় ভরসা হয়ে ছিলেন তো তিনিই। ছবি: এএফপি

টেন্ডুলকারের একমাত্র অতৃপ্তি ঘোচানোর বিশ্বকাপ হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবে এই বিশ্বকাপ। সঙ্গে আরও কিছু কারণও থাকবে। এই প্রথম স্বাগতিক দলের হাতে বিশ্বকাপ। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা নামেই ছিল স্বাগতিক। নিজেদের দেশে মাত্র দুটি ম্যাচ, ফাইনালও খেলেছিল লাহোরে। ভারতের জয় তাই নতুন ইতিহাস। এই বিশ্বকাপও কি তা-ই নয়?

টি-টোয়েন্টির আগ্রাসনে ওয়ানডের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন প্রশ্ন উঠে গিয়েছিল, এই বিশ্বকাপ বুঝিয়ে দিল, ওয়ানডেও কত আকর্ষক হতে পারে। টি-টোয়েন্টি যুগের প্রতীক হয়ে ওঠা মহেন্দ্র সিং ধোনিও বিশ্বকাপ জয়ের পর সেটিই মনে করিয়ে দিতে চাইলেন, ‘খেলাটার তিনটি ফরম্যাটই যে সহাবস্থান করতে পারে, এই বিশ্বকাপ আরও ভালো করে তা বুঝিয়ে দিয়েছে। আমি নিজে ওয়ানডে ক্রিকেটের খুব ভক্ত। এখানে শুরুতে ২-৩টি উইকেট পড়ে গেলেও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ থাকে। বড় একটা পার্টনারশিপ হওয়ার পরও ম্যাচের চেহারা বদলে যায়। ওয়ানডে অনেকটা “মিনি টেস্ট”।’

সেই ওয়ানডের সর্বোচ্চ আসর বিশ্বকাপ যে এবার স্বমহিমায় উজ্জ্বল, সেটির আসল কারণটা শুনুন কুমার সাঙ্গাকারার মুখে, ‘আমি সব সময়ই বলে এসেছি, ক্রিকেট খেলার আসল মজা এই উপমহাদেশে। আর কোথাও খেলাটা নিয়ে এমন উৎসাহ, এমন উন্মাদনা নেই। খেলাটির প্রতি এমন ভালোবাসা নেই। এখানে যখন বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্ট হয়, পুরো জাতিই তাতে একাত্ম হয়ে গিয়ে সেটিকে অন্য এক উচ্চতায় তুলে দেয়।’

শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বকাপ তাই জনতার বিশ্বকাপ। এখানেও শুরু আর শেষে অদ্ভুত মিল। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আর ম্যাচ রাস্তায় নামিয়ে এনেছিল ঢাকার মানুষকে। ফাইনালের পর মুম্বাইয়ের রাস্তাও ভোররাত পর্যন্ত লোকারণ্য।

চার বছর আগের বর্ণহীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের সঙ্গে এবারের বিশ্বকাপের তুলনাই তো যথেষ্ট। সেবার বেশির ভাগ ম্যাচে গ্যালারি ভরেনি। এবার স্বাগতিক দলের খেলায় তো টিকিট নিয়ে কাড়াকাড়ি, ভিন্ন দুই দেশের খেলাতেই প্রায় পূর্ণ গ্যালারি। শুধুই একটা টুর্নামেন্ট নয়, ৪৫ দিন ধরে যেন এক মহোৎসব! স্মরণীয় ম্যাচও যে অনেক হলো, বিস্মরণযোগ্য টানা তিনটি একতরফা ফাইনালের পর জমজমাট এক ফাইনাল, এতেও হয়তো ভূমিকা আছে এর।

শেষ পর্যন্ত এই বিশ্বকাপ তাই জনতার বিশ্বকাপ। এখানেও শুরু আর শেষে অদ্ভুত মিল। বিশ্বকাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান আর ম্যাচ রাস্তায় নামিয়ে এনেছিল ঢাকার মানুষকে। ফাইনালের পর মুম্বাইয়ের রাস্তাও ভোররাত পর্যন্ত লোকারণ্য। তিন দেশে বিশ্বকাপ করা সাংবাদিকের মুখে মুখেও এই মিলের কথা, ‘ঢাকা ছাড়া এমন দৃশ্য আর কোথাও দেখিনি।’

এই বিশ্বকাপ বাংলাদেশকে নতুন করে চিনিয়েছে বিশ্বের কাছে। এই বিশ্বকাপে বাংলাদেশও নতুন করে চিনেছে নিজেদের। ওয়েস্ট ইন্ডিজের টিম বাসে পাথরটাই যা একটু খচখচানি হয়ে আছে। প্রায় বিতর্কমুক্ত এক বিশ্বকাপ বলেই ওই ‘পাথর-কলঙ্ক’ এখনো চাপা পড়েনি। ভারতীয় এক পত্রিকায় এই বিশ্বকাপের ভালো-মন্দের তালিকায় ‘মন্দ’ হিসেবে এটি ঠিকই উল্লিখিত।

সুধীর গৌতম। সারা জীবন `শচীন` সেজে থাকার পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন। ছবি: গেটি ইমেজেস

থাক, ওটা দুর্ঘটনা হিসেবেই থাক। মনে রাখার মতো হিরণ্ময় স্মৃতি তো আর এই বিশ্বকাপ কম দেয়নি। বঙ্গবন্ধু-মিরপুর থেকে ওয়াংখেড়ে...টুকরো টুকরো কত ছবির কোলাজ! শেষ ফ্রেমেই সুন্দরতম ছবিটা।

বিশ্বকাপ হাতে শচীন রমেশ টেন্ডুলকার!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×