অতৃপ্তি ঘুচল টেন্ডুলকারের
আকাশ ছুঁলো ধোনির ভারত
উৎপল শুভ্র
২ এপ্রিল ২০২১
সেই ১৯৯২ থেকে যে স্বপ্নের পিছু ধাওয়া করে আসছেন, এত বছর পর সেই স্বপ্ন এখন সত্যি। ১৪ বলে ১৮ রান তাতে খুব বড় অবদান রাখেনি, কিন্তু বিশ্বকাপটাতে তো তাঁরই সবচেয়ে বেশি অধিকার। এ কারণেই তেরঙ্গা নিয়ে ভারতীয় দলের ভিক্টরি ল্যাপের সময় টেন্ডুলকারকে কাঁধে তুলে নিলেন সুরেশ রায়না ও ইউসুফ পাঠান। টেন্ডুলকার হাসছেন, গলা ফাটিয়ে ফেলা দর্শকদের দিকে হাত নাড়ছেন। সব পাওয়ার আনন্দ খেলা করছে তাঁর চোখেমুখে। আহ্! বিশ্বকাপ...অবশেষে তুমি ধরা দিলে!
প্রথম প্রকাশ: ৩ এপ্রিল ২০১১। প্রথম আলো।
হরভজন সিং কাঁদছেন। বীরেন্দর শেবাগের চোখেও জল। ফ্লাডলাইটের আলোয় চকচক করছে বাকিদের চোখও। আবেগে আত্মহারা ভারতীয় খেলোয়াড়েরা একে অন্যকে আলিঙ্গনে বাঁধছেন আর আনন্দাশ্রুতে ভিজিয়ে দিচ্ছেন সতীর্থের কাঁধ। বিশ্বজয়ের আনন্দ তো এমনই হবে। দেশের মাঠে, উৎসবমুখর দর্শকের সামনে ২৮ বছরের অপেক্ষা ঘুচে যাওয়ার উচ্ছ্বাস তো চোখের জলই দাবি করে!
কিন্তু তিনি কোথায়? কুলাসেকারার বলে ধোনির ছক্কা বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার পরই ড্রেসিংরুম থেকে দৌড়ে এসেছেন ভারতীয় দলের কয়েকজন। প্যাড পায়ে সুরেশ রায়না পর্যন্ত। কিন্তু এই বিশ্বকাপ যাঁর ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তিটাও মুছে দিয়ে সেটিকে সর্বাঙ্গসুন্দর করে দিল, তাঁরই সবার আগে দৌড়ে আসার কথা।
তিনি শচীন টেন্ডুলকার বলেই সবার পরে এলেন। সেটিও দৌড়ে নয়। ধীর পায়ে। জটলার মধ্যে হারিয়ে যাওয়ার পর অবশ্য উচ্ছ্বাস ভাসিয়ে নিয়ে গেল তাঁকেও। সেই ১৯৯২ থেকে যে স্বপ্নের পিছু ধাওয়া করে আসছেন, এত বছর পর সেই স্বপ্ন এখন সত্যি। ১৪ বলে ১৮ রান তাতে খুব বড় অবদান রাখেনি সত্যি, কিন্তু বিশ্বকাপটাতে তো তাঁরই সবচেয়ে বেশি অধিকার। এ কারণেই তেরঙ্গা নিয়ে ভারতীয় দলের ভিক্টরি ল্যাপের সময় টেন্ডুলকারকে কাঁধে তুলে নিলেন সুরেশ রায়না ও ইউসুফ পাঠান। টেন্ডুলকার হাসছেন, গলা ফাটিয়ে ফেলা দর্শকদের দিকে হাত নাড়ছেন। সব পাওয়ার আনন্দ খেলা করছে তাঁর চোখেমুখে। আহ্! বিশ্বকাপ...অবশেষে তুমি ধরা দিলে!
আরেকজন এর মধ্যেও আবেগকে সীমানা পেরিয়ে যেতে দিচ্ছেন না। পরাজয়ে যেমন নিষ্কম্প, জয়েও আপাত নির্বিকার। অথচ তিনিই ফাইনালের নায়ক। বিশ্বকাপের প্রথম ফাইনালে ক্লাইভ লয়েডের সেঞ্চুরি ইতিহাস হয়ে আছে। ২০০৩ বিশ্বকাপ ফাইনালে রিকি পন্টিংয়ের সেঞ্চুরিও। মহেন্দ্র সিং ধোনি সেঞ্চুরি করেননি। কিন্তু তাঁর অপরাজিত ৯১ রানের ইনিংসটির মহিমা ছাড়িয়ে যাবে অনেক সেঞ্চুরিকেও। এই বিশ্বকাপে ব্যাটে রান নেই বলে সমালোচনাটা ফিসফাসের বেশি হতে পারেনি শুধু দল জিতছিল বলে। আগের ৭ ইনিংসে সর্বোচ্চ ছিল মাত্র ৩৪। আসল সময়ে ব্যাটিং অর্ডারে নিজেকে তুলে এনে সত্যিকার এক ‘ক্যাপ্টেনস নক।’
ইনিংসের দ্বিতীয় বলেই বীরেন্দর শেবাগ আউট। ৩১ রানের মধ্যে টেন্ডুলকারও। তার পরও যে ভারত ফাইনালের চাপে আরও ২০-৩০ রান বেড়ে যাওয়া ২৭৫ রানের কঠিন টার্গেট ৬ উইকেট হাতে নিয়েই জিতে গেল, সেটি তো মহেন্দ্র সিং ধোনিরই অবদান। গৌতম গম্ভীর ৯৭ করেছেন। রানের বিবেচনায় ধোনি ৬ রান পিছিয়ে, কিন্তু প্রভাব বিবেচনায় অনেক অনেক এগিয়ে। শেষটাও হলো যেমন হওয়া উচিত। শুধু ধোনির ছক্কাই নয়, বিশ্বকাপ জয়ের মাহেন্দ্রক্ষণে উইকেটে ম্যাচের সেরা ধোনির সঙ্গে টুর্নামেন্টের সেরা যুবরাজ সিং। দুই কীর্তিমানকে একই ফ্রেমে পেয়ে গেল ফটো সাংবাদিকদের ক্যামেরা। সেটিও আলিঙ্গনাবদ্ধ অবস্থায়।
দ্বিতীয় বলেই স্টাম্পিং হতে পারতেন ধোনি। ৩০ রানে ক্যাচ পড়েছে গম্ভীরের। এসব শ্রীলঙ্কাকে অবশ্যই পুড়িয়ে মারবে। ইংল্যান্ডের পর এই প্রথম টানা দুটি ফাইনালে হারার দুঃসহ অভিজ্ঞতা হলো কোনো দলের। ১৯৯৬ বিশ্বকাপ জয়ের সুখস্মৃতিরও এই দুঃখ ভোলাতে হিমশিম খাওয়ার কথা। মুত্তিয়া মুরালিধরন তাই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন ভারতীয় উত্সবের দিকে। শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ—আবার বিশ্বকাপ তো হাতে নেওয়া হলোই না, বোলিংয়েও হয়ে থাকলেন নিজের ছায়া (৮-০-৩৯-০)।
আকাশে আতশবাজির খেলা, পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে চ্যাম্পিয়ন ভারতীয় দলের সব খেলোয়াড়কে এক কোটি রুপি করে পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিচ্ছে বিসিসিআই। এক পাশে দাঁড়িয়ে নীরবে তা দেখছেন মাহেলা জয়াবর্ধনেও। যাঁর দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরিও শেষ পর্যন্ত শুধু রানার্সআপের পদকের বেশি জোটাতে পারল না।
আট বছর আগে ওয়ান্ডারার্সে ভারতের বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন মুছে যাওয়ার সূচনা হয়েছিল জহির খানের হাতে। ৭ ওভারে দিয়েছিলেন ৬৭ রান। ৩ ওভারের প্রথম স্পেলে ২৮। কাল জহিরের প্রথম তিন ওভারই মেডেন। ৫ ওভারের প্রথম স্পেল: ৫-৩-৬-১।
শুরু আর শেষ পুরো বিপরীত। মাঝখানে দ্বিতীয় স্পেল করতে ফিরে তুলে নিয়েছেন কাপুগেদারার উইকেট। শ্রীলঙ্কান ইনিংস শেষে সেই জহিরই বোলিং ফিগারের কথা পারলে ভুলে যান। শেষ দুই ওভারে ১৭ ও ১৮ দিয়ে সেটি ১০-৩-৬০-২। শহীদ আফ্রিদির সঙ্গে এই বিশ্বকাপে সবচেয়ে বেশি উইকেট তাঁর। কিন্তু থিসারা পেরেরার ৯ বলে ২২ রানের ঝড়ে হতভম্ব জহিরের তখন তা নিয়ে ভাবারই অবস্থা নেই।
জহিরের প্রথম ১৯ বলে কোনো রানই হয়নি। আর শেষ বলে পেরেরার বিশাল এক ছয়। শ্রীলঙ্কার ইনিংসের শুরু আর শেষেও একই রকম বৈপরীত্য। বোলিং পাওয়ার প্লের প্রথম ১০ ওভারে মাত্র ৩১। এই বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা এর চেয়ে কম রানপ্রসবিণী ১০ ওভার আর দেখেনি।
১৯৯৬ বিশ্বকাপে জয়াসুরিয়া-কালুভিতারানার মতো ক্রিকেট ট্যাকটিকসে নতুন দিগন্ত উন্মোচনকারী নয় বলে দিলশান-থারাঙ্গার উদ্বোধনী জুটি নিয়ে অতটা আলোচনা হয়নি। তবে সাফল্যের বিচারে নবীনতম জুটি অনেক এগিয়ে। ফাইনালের আগে ৮ ম্যাচে দুজনের মোট রান ৭৯৭, সেঞ্চুরি ৪টি। কাল দুজনের মিলিত অবদান ৩৫ রান। এর ৩৩-ই দিলশানের। জহির খানে হাবুডুবু খেয়ে থারাঙ্গার ২০ বলে করুণ ২।
জহির খানের যেমন শুরু আর শেষে চরম বৈপরীত্য, শ্রীলঙ্কান ইনিংসেও তা-ই। ব্যাটিং পাওয়ার প্লের শেষ ৫ ওভারে রীতিমতো ঝড় তুলে ৬৩ রান। থিসারা পরিস্থিতির দাবি অনুযায়ী অর্ডার দেওয়া একটা ইনিংস খেলেছেন। তবে ২৪০-৫০ জপতে জপতে শ্রীলঙ্কার ২৭৪ হয়ে যাওয়ার আসল কৃতিত্বটা মাহেলা জয়াবর্ধনের।
১৯৯৬ বিশ্বকাপ ফাইনালে অরবিন্দ ডি সিলভার সেই ক্লাসিক মনে করিয়ে দিয়ে ৮৪ বলে সেঞ্চুরি। আগের দিনই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের প্রধান নির্বাচক দলের খেলোয়াড়দের নিজের দর্শনের কথা জানিয়ে উদ্দীপ্ত করতে চেয়েছেন, ‘ব্যাটিং করতে নামার সময় আমার মানসিকতাটা ছিল, আমিই একাই ম্যাচ জেতাব।’ পরে ব্যাটিং করেছিলেন অরবিন্দ ডি সিলভা তা পেরেছিলেন। ডি সিলভার মতো মাহেলা জয়াবর্ধনেরও অপরাজিত সেঞ্চুরি। ২৭৪-কে যে গম্ভীর-ধোনিরা এমন খেলো বানিয়ে দেবেন, কী করে তা ভাববেন!
ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসে এত দিন দুটি দিন পাশাপাশি থাকত। ২৫ জুন, ১৯৮৩। ২৩ মার্চ, ২০০৩। প্রথমটি পয়মন্ত। দ্বিতীয়টি অভিশপ্ত। একটি বিশ্বকাপ জয়ের। আরেকটি বিশ্বকাপ ফাইনালে হেরে যাওয়ার।
২৫ জুন-২৩ মার্চকে পেছনে ফেলে ২ এপ্রিল ২০১১ এখন সবচেয়ে জ্বলজ্বলে হয়ে গেল!