খেলার সীমানা ছাড়িয়ে একজন টেন্ডুলকার
উৎপল শুভ্র
৩০ মার্চ ২০২১
আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে তো ছিলেন সবসময়ই। ২০১১ বিশ্বকাপে আরও বেশি। জীবনের শেষ বিশ্বকাপ, একমাত্র আক্ষেপ ঘোচানোর শেষ সুযোগও। পাকিস্তানের বিপক্ষে সেমিফাইনালের আগে চারপাশের কথাবার্তায় মনে হচ্ছিল, ভারতের সীমানা ছাড়িয়ে তিনি পরিণত ক্রিকেটের চিরন্তন প্রতীকে।
প্রথম প্রকাশ: ৩০ মার্চ ২০১১। প্রথম আলো।
কখনো গ্যারি কারস্টেন, কখনো বা ফিজিও বল ছুড়ে যাচ্ছেন, আর তিনি কোনোটায় স্কয়ার ড্রাইভ করছেন, কোনোটায় বা পুল। কখনো কাল্পনিক অফ স্টাম্পের বাইরের বল ছেড়ে দিচ্ছেন ব্যাট উঁচিয়ে। নেটেও ‘জানিস, আমি কে’সুলভ কোনো ঔদ্ধত্য নেই। তুমি যত বড়ই হও, খেলাটার চেয়ে বড় কেউ নয়—চিরদিনই এতে বিশ্বাস করে এসেছেন। ক্যারিয়ারের ২২তম বছরে এসেও তিনি—শচীন টেন্ডুলকার, এই গ্রহের শুদ্ধতম ব্যাটসম্যান— ক্রিকেটের অনুগত ছাত্র।
ম্যাচের আগে এটাই তাঁর রুটিন। কখনো কখনো নেটেও যান না, বাইরে নক করেন। কাল অবশ্য পুরোদস্তুর নেটই করলেন। প্রথমে মার্বেল স্ল্যাবে পড়ে ছিটকে যাওয়া বলে অনেকক্ষণ। এর পর টার্ফে।
হাতে ঝকঝকে একটা ব্যাট। স্টিকার-ফিকার তো নেই-ই, বলের দাগও নয়। আগের দুই দিনও ভারতীয় দলের প্র্যাকটিসে সবচেয়ে দর্শনীয় হয়ে ছিল টেন্ডুলকারের নতুন ব্যাট। পরশু তো মনে হলো, মাঠে এসেছেন ব্যাটগুলোকে ঠিকঠাক করার জন্যই! নিজে ব্যাটিং করার সময়টা বাদ দিয়ে ওটা নিয়েই ব্যস্ত। কখনো হ্যান্ডল কেটে ছোট করছেন। কখনো বা হাতুড়ি দিয়ে বাড়ি মেরে মেরে যুদ্ধের উপযোগী করে তুলছেন তাঁর ব্রহ্মাস্ত্রকে।
বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল, প্রতিপক্ষ পাকিস্তান এবং নিজে দাঁড়িয়ে শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির সামনে—আলাদা আলাদাভাবে প্রতিটিই বিশেষ তাৎপর্য দাবি করে। টেন্ডুলকারের জন্য তিনটিই মিলেমিশে এক হয়ে যাচ্ছে। এই মহা-মহাগুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তিনি কি নতুন ব্যাট নিয়ে নামছেন?
প্রশ্নটার উত্তর কারও জানা নেই। শচীন টেন্ডুলকার অবশ্যই জানেন। কিন্তু বললে তো! বড় ম্যাচের আগে বরাবরই নিজেকে খোলসের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন। এই বিশ্বকাপের দিন বিশেক আগে থেকেই বহির্জগতের সঙ্গে যোগাযোগ বলতে গেলে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। বিশ্বকাপ ঘিরে ভারতে স্পনসরদের কত কর্মযজ্ঞ চলছে। কোনোটিই শচীন টেন্ডুলকারকে পায়নি।
জীবনের শেষ বিশ্বকাপ, ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তি ঘোচানোরও শেষ সুযোগ। টেন্ডুলকার তাই সর্বস্ব বাজি ধরেছেন। ক্রিকেট-বিশ্বও কি তা-ই চাইছে? নইলে আইসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কেন কল্পচোখে মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড়েতে টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরি দেখবেন! অন্য কারও কথা বললে নিশ্চয়ই শোরগোল পড়ে যেত। আইসিসি কর্মকর্তার নিরপেক্ষ চেয়ার থেকে কীভাবে ও কথা বলেন হারুন লরগাত? অথচ লরগাতের কথায় কেউ কিছু মনেই করেনি। কারণ শচীন টেন্ডুলকার যেন এখন ভারত ছাপিয়ে ক্রিকেটের প্রতীক!
শহীদ আফ্রিদি অন্তত এই সেন্টিমেন্টে ভুগছেন না। পাকিস্তানি অধিনায়কের কাছে শচীন টেন্ডুলকারের এখন একটাই অর্থ—ফাইনালে ওঠার পথে কাঁটা। ভারতে এসেই হুমকি দিয়েছেন, টেন্ডুলকারকে শততম সেঞ্চুরি করতে দেবেন না। বলেছেন, ওটা বিশ্বকাপের পরে কোনো এক সময়ের জন্য তুলে রাখতে। গত দু-তিন দিন ভারতের প্রায় সব টিভি চ্যানেলে স্ক্রল হয়ে থাকল আফ্রিদির এই উক্তি। কাল সংবাদ সম্মেলনে আফ্রিদি রেগেমেগে জানালেন, এমন কিছু তিনি মোটেই বলেননি।
বলেননি, ঠিক আছে। কিন্তু প্রতিবাদ করার দরকারটা কী ছিল, টেন্ডুলকারের ওপর চাপের বোঝার ওপর শাঁকের আঁটি চাপিয়ে দেওয়ার জন্য কথাটা তো মন্দ ছিল না। আফ্রিদি কি তাহলে ব্র্যাডম্যান আর মেইলির ওই বিখ্যাত গল্পটা জানেন? অস্ট্রেলিয়া সফরে মেইলির গুগলি বুঝতে না পেরে বোল্ড হয়েছিলেন ব্র্যাডম্যান। এতেই রব উঠে যায়, মেইলিকে ব্র্যাডম্যান পড়তে পারছেন না। কে যেন পত্রিকাতেও তা লিখে দেয়। ব্র্যাডম্যানের চোখে পড়ে এবং পরের টেস্টে মেইলিকে এমন বেধড়ক মার দেন যে, কোনটা লেগ ব্রেক আর কোনটা গুগলি কেউই তা বোঝার অবকাশ পায়নি। অন্য অনেকের মতো টেন্ডুলকারের রাগ দৃশ্যমান নয়, কিন্তু চ্যাম্পিয়নের অহমে ঘা লাগলে কী হয়, সেই প্রমাণ তো তিনি অনেকবারই দিয়েছেন।
আফ্রিদি নিজেও তো কম দেখেননি। বিশ্বকাপে দুই দেশের সর্বশেষ ম্যাচটি তো অমর হয়ে গেছে টেন্ডুলকারের মহাকাব্যিক সেই ৯৮-এর কারণেই। সেঞ্চুরিয়নের ওই আগুনে উইকেটে ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনুস-শোয়েব আখতারের ত্রিশূল। সামনে পাকিস্তানের ২৭৩ রান। টেন্ডুলকারের ৭৫ বলে ৯৮ সবকিছুকেই খেলো বানিয়ে দিয়েছিল। বিশ্বকাপ ইতিহাসে সেরা দুই অঙ্কের ইনিংস, এ নিয়ে কোনো তর্কই নেই। সেঞ্চুরি-টেঞ্চুরি বিবেচনায় নিলেও সেরা কি না, সেটি নিয়ে বরং তর্ক চলে।
ব্যাট করতে নামার সময় বীরেন্দর শেবাগের সঙ্গে টেন্ডুলকারের আলাপচারিতাও ভারতীয় ক্রিকেট রূপকথার অংশ হয়ে গেছে। শেবাগ জিজ্ঞেস করছেন, ‘প্ল্যান কী?’ টেন্ডুলকার জবাব দিচ্ছেন, ‘প্ল্যান আবার কী! মেরে ছাতু বানিয়ে ফেলব।’
এর আগে বিশ্বকাপে চারটি ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। ১৯৯২ বিশ্বকাপে প্রথমটিতে ১৯ বছরের টেন্ডুলকার ব্যাটিংয়ে অপরাজিত ৫৪, বোলিংয়ে ১ উইকেট। প্রথম আর সর্বশেষ—দুটিতেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ। বাকি দুই ম্যাচে ৩১ ও ৪৭।
কিন্তু ওই চার ম্যাচের কোনোটিই আজকের মতো দৈত্যাকার তাৎপর্য নিয়ে হাজির হয়নি। তখন টেন্ডুলকার জানতেন, এটাই শেষ নয়। এর পরও সুযোগ আসবে। আর আজ টেন্ডুলকার জানেন, রাত আসতে আসতে বিশ্বকাপ তাঁর কাছে আমৃত্যু দীর্ঘশ্বাস হয়ে যেতে পারে!
হাজারো অনুষঙ্গ যোগ হয়ে এই ম্যাচ শুরু হওয়ার আগেই ছাড়িয়ে গেছে খেলার সীমানা। এত কিছুর দরকার ছিল না। এই ম্যাচে হুমড়ি খেয়ে পড়ার জন্য এক শচীন টেন্ডুলকারই তো যথেষ্ট ছিলেন!