টেন্ডুলকারও তাহলে মানুষ!
উৎপল শুভ্র
৩০ মার্চ ২০২১
পাকিস্তানের বিপক্ষে বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল। এর সঙ্গে যোগ করুন শততম টেস্ট সেঞ্চুরির অপেক্ষায় থাকা শচীন টেন্ডুলকারকে। ২০১১ বিশ্বকাপের এই ম্যাচ ঘিরে আকাশ ছুঁয়েছিল আগ্রহের পারদ, এ আর আশ্চর্য কি! আর সেই ম্যাচেই টেন্ডুলকার খেলেছিলেন অদ্ভুত এক ইনিংস। দুবার রিভিউ নিয়ে বেঁচেছেন, ক্যাচ দিয়েও বেঁচে গেছেন চারবার। তারপরও সেঞ্চুরি অবশ্য পাননি। তবে আউট হওয়ার আগে প্রমাণ করে গিয়েছিলেন, চাপ তাঁকেও ছুঁয়ে যায়। তিনিও মানুষ!
প্রথম প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০১১। প্রথম আলো।
★ আজমলের এলবিডব্লুর আবেদনে আঙুল তুলে দিলেন আম্পায়ার ইয়ান গোল্ড। রিভিউয়ে তা বাতিল। টিভি রিপ্লে জানাল, বল স্টাম্প মিস করছিল।
★ পরের বলেই স্টাম্পিং করলেন কামরান আকমল। সাইমন টফেল টিভি আম্পায়ারের শরণাপন্ন। ‘নট আউট’ বলতে বেশ কটি রিপ্লে লাগল।
★ আফ্রিদির বলে মিড উইকেটে ক্যাচ ফেললেন মিসবাহ-উল-হক। আফ্রিদিকে স্বভাববিরুদ্ধভাবে নির্বিকার দেখাল।
★ মিড অফে ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে সহজ ক্যাচ ফেলে দিলেন ইউনিস খান। বোলার এবারও আফ্রিদি। হতাশায় মাথায় হাত।
★ উইকেটকিপার কামরান আকমল ক্যারিয়ারে যত ক্যাচ ধরেছেন, তার চেয়ে বেশি ফেলেছেন বলে সবার ধারণা। তাঁর মানদণ্ডে কঠিন এই ক্যাচটা ধরতে না পারারই কথা। আবারও বোলার আফ্রিদির মাথায় হাত।
★ বড় ভাইয়ের পর ছোট ভাই! ওয়াইড মিড উইকেটে উমর আকমলকে মনে হলো ফুটবলের গোলকিপার, লাফিয়ে উঠে বারের ওপর দিয়ে বল পাঠিয়ে দিচ্ছেন! এবার বোলারের নাম হাফিজ।
খেলা দেখে থাকলে ব্যাটসম্যানের নাম আপনি জানেন। যাঁরা দেখেননি, তাঁদের জানাই—শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। ছয়-ছয়বার মৃত্যু-উপত্যকা থেকে ঘুরে আসার সময় রান: ২৩, ২৩, ২৭, ৪৫, ৭০ ও ৮১। কালকের ম্যাচে পাঁচ ফুট পাঁচ ইঞ্চি ব্যাটসম্যানের নাম ছিল আসলে শচীন ‘লাকি’ টেন্ডুলকার!
বিড়ালের নাকি নয় জীবন! মনে হচ্ছিল, টেন্ডুলকার না আজ ‘বিড়াল’কেও ছাড়িয়ে যান! এই ম্যাচের জন্য নতুন ব্যাট আনিয়েছেন। সেই ব্যাটে চড়ে ক্রিকেট-বিধাতাও যেন তাঁর সঙ্গে উইকেটে! শততম সেঞ্চুরির অপেক্ষায় দিন গুনছে পুরো ভারত। ক্রিকেট-বিধাতাও কি তাহলে শামিল হয়ে গেলেন সেই দলে? টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরির সেঞ্চুরি আজ করিয়েই ছাড়বেন!
একটা সময় তাঁরও বোধহয় মনে হলো, ব্যাপারটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। এমন মহার্ঘ একটি ব্যাপার কি না এমন যন্ত্রণাকাতর এক সেঞ্চুরি দিয়ে! যেটি নিয়ে কথা উঠলে উল্টো টেন্ডুলকার অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে চাইবেন! ক্রিকেট-বিধাতাও তাই মুখ ফিরিয়ে নিলেন। সাঈদ আজমলের বলে কভারে ক্যাচ দিয়ে শেষ হলো টেন্ডুলকারের অটেন্ডুলকারীয় ইনিংস। ১৬১ মিনিট, ১১৫ বল, ১১টি চার—রান ৮৫।
টেন্ডুলকারের ক্যাচও ধরা যায়—যিনি তা প্রমাণ করলেন, তাঁর দুহাত তুলে মূর্তি হয়ে যাওয়া এই বিশ্বকাপের সবচেয়ে পরিচিত দৃশ্য। ক্যাচ ধরেও সেই ভঙ্গিমায়। তিন-তিনবার টেন্ডুলকারের উইকেট পেতে পেতেও পাননি। ক্যাচ নিয়েই শহীদ আফ্রিদির যেন তাই উইকেট নেওয়ার আনন্দ!
ওয়াসিম আকরাম কি তখন কমেন্ট্রি বক্সে? টেন্ডুলকারের ক্যাচ পড়ছিল আর তাঁর মনে পড়ছিল ২০০৩ বিশ্বকাপের সেঞ্চুরিয়ন? মোহালির আগে বিশ্বকাপে সর্বশেষ ভারত-পাকিস্তান। টেন্ডুলকারের মহাকাব্যিক ৯৮ রানের সেই ম্যাচ। মহাকাব্য দূরে থাক, সেটি কাব্যও হতে পারত না, যদি রাজ্জাক মিড অফে টেন্ডুলকারের ক্যাচ ফেলে না দিতেন। রাজ্জাককে ৩০ গজি সীমানার ওপর দাঁড়াতে বলেছিলেন, রাজ্জাক একটু সামনে এগিয়ে যাওয়ায় ক্যাচটা পাননি। বোলার ওয়াসিম আকরাম রেগেমেগে বলেছিলেন, ‘তুজ কো পাতা হ্যায় তুনে কিসকা ক্যাচ ছোড়া’ (তুই বুঝতে পারছিস তুই কার ক্যাচ ছেড়েছিস)।
রাজ্জাক তখনই বুঝেছিলেন। পরে আরও ভালো করে। গত কয়েক বছর কখনো ধারাভাষ্য, কখনো ইএসপিএন-স্টার স্পোর্টসের অন্য কোনো প্রয়োজনে ওয়াসিম আকরামের নিয়মিতই ভারতে আসা-যাওয়া। প্রতিবার ঘুরে যান, আর রাজ্জাকের সঙ্গে দেখা হলেই তাঁকে গালমন্দ করেন—এমনিতেই ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো দেখলে মনে হয়, ভারত সব ম্যাচেই পাকিস্তানকে হারিয়েছে। তোর কারণে টিভি খুললেই টেন্ডুলকারের ওই মার দেখতে হয়।
সেঞ্চুরিয়নের আবদুল রাজ্জাক এই ম্যাচেও ছিলেন। সেই পাকিস্তান দলের আফ্রিদি ও ইউনিস খানও কাল মাঠে। ড্রেসিংরুমে শোয়েব আখতার ও ওয়াকার ইউনুস। রাজ্জাক কি ইউনিস-মিসবাহ বা দুই আকমলকে ফিরিয়ে দিয়েছেন ওয়াসিম আকরামের বলা ওই কথাটা?
হয়তো বলেছেন। হয়তো না। প্রশ্ন এটা নয়। প্রশ্ন হলো—৮৫ রান করতেই টেন্ডুলকারকে যে চার-পাঁচটি ইনিংস খেলতে হলো, এর ব্যাখ্যা কী? চাপ?
চাপ! বাইশ বছর ছুঁইছুঁই ক্যারিয়ারে সবই দেখা হয়ে গেছে, চাপ তাঁকে কেন স্পর্শ করবে?
সবই দেখেছেন। এর আগে খেলেছেন পাঁচটি বিশ্বকাপও। কিন্তু একটা ব্যাপার তো টেন্ডুলকার এই প্রথম দেখছেন। আগের বিশ্বকাপগুলোয় জানতেন, এবার না হলেও সুযোগ আছে। এবার কোয়ার্টার ফাইনাল থেকে ‘এটাই আমার শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ হয়ে যেতে পারে’ উৎকণ্ঠার সঙ্গে টেন্ডুলকারের প্রথম পরিচয়। সেই চাপই যদি কারণ হয়ে থাকে, তাহলে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেন সবাই।
শচীন টেন্ডুলকারও মানুষ!