২০১১ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ড-জয়
তবু মাথা নোয়াবার নয়
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
অষ্টম উইকেট যখন পড়ল, জয় তখনো ৫৭ রান দূরে। সেখান থেকে মাহমুদউল্লাহ ও শফিউলের নবম উইকেট জুটির এনে দেওয়া জয়ের মাহাত্ম্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আগের ম্যাচেই বাংলাদেশের ৫৮ রানে গুটিয়ে যাওয়ার দুঃস্বপ্ন।
প্রথম প্রকাশ: ১২ মার্চ, ২০১১। প্রথম আলো।
একি সত্যি, নাকি মায়া! সত্যিই কি বাংলাদেশ জিতেছে!
নিজের চোখে দেখার পরও সত্যি আর মায়া গুলিয়ে যেতে চায়। এই মনে হচ্ছে, এ কীভাবে সম্ভব! আবার সত্যিটা তো চোখের সামনেই নেচে বেড়াচ্ছে। ওই তো জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের বিশাল পর্দায় ফুটে উঠেছে ‘কনগ্রাচুলেশনস বাংলাদেশ!’ ওই তো মাঠকর্মীরা সবাই হাতে হাত রেখে আনন্দে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন মাঠজুড়ে। প্রেসবক্সেও চিৎকার-চেঁচামেচি। পেশাদারির মুখোশ খুলে ফেলে বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা সবাই হয়ে গেছেন আবেগে থরথর সমর্থক। চলছে ‘ঈদের কোলাকুলি’। অবিস্মরণীয় এই মুহূর্তের স্মারক রেখে দিতে ধুম পড়েছে ছবি তোলার।
ক্রিকেট কখনো কখনো জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। উত্থান আছে, পতন আছে। কখনো আনন্দ ভাসিয়ে নিয়ে যায়, কখনো বা ডুবিয়ে দেয় দুঃখে। জীবনের মতোই ক্রিকেটেও বড় সত্যি সেই অমর বাণী—তুমি কতবার পড়ে গেলে সেটা ব্যাপার নয়, কতবার উঠে দাঁড়াতে পেরেছ, সেটিই ব্যাপার।
৫৮-দুঃস্বপ্ন বাংলাদেশকেও ফেলে দিয়েছিল মাটিতে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের খানাখন্দে এর আগেও অনেকবারই হুমড়ি খেয়ে পড়েছে বাংলাদেশ, তবে এমন সশব্দে কখনো নয়। ৫৮ আর ৫৮-পরবর্তী ঘটনায় অতল গহ্বরে পড়ে যাওয়া এই তরুণ দলের উঠে দাঁড়ানোর মানসিক শক্তি আছে—কজনেরই বা বিশ্বাস ছিল এমন!
ক্রিকেট কখনো খেলার চেয়ে অনেক বড় হয়ে যায়। জয় হয়ে যায় বহুমাত্রিক। এই জয়ও শুধুই একটি ক্রিকেট ম্যাচে জয় নয়, এর চেয়েও বেশি কিছু। এই ম্যাচ ব্যাটিং-বোলিংয়ের সীমানা ছাড়িয়ে অজেয় জীবনের জয়গান। চাপ আর বিতর্কের চোখে চোখ রেখে সাকিবের দলের দুঃসাহসী সুন্দর এক অভিযানের গল্প। রুদ্ধশ্বাস ম্যাচে ২ উইকেটে জয় যে গল্পের খুব সামান্যই বলতে পারছে।
একেবারেই কিছু কি বলছে না? প্রেক্ষাপট মনে না রাখলে এই জয়ের আসল মহিমাই হারিয়ে যাবে। তা ভুলে গিয়েও স্কোর কার্ডটা আবার দেখুন না! শুধুই একটা ক্রিকেট ম্যাচ হিসেবে দেখলেও তো এটি ওয়ানডের সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ম্যাচের তালিকায় থাকবে। বাংলাদেশের ক্রিকেট-ইতিহাসে তো সবচেয়ে রোমাঞ্চকর হিসেবে আর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নেই।
বাংলাদেশের ৮ উইকেট যখন পড়ল, তখনো প্রয়োজন ৫৭ রান। এই ম্যাচ কি আর বাংলাদেশ জিততে পারবে, জিতেছে কোনো দিন—দুঃখী গ্যালারি তাই ফাঁকা হতে শুরু করল। আশাভঙ্গের বেদনা বুকে নিয়ে যাঁরা মাঠ ছেড়ে চলে গেলেন, বাকি জীবন একটা দুঃখ সঙ্গী হয়ে গেল তাঁদের। ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার সুযোগটা যে হেলায় হারিয়েছেন তাঁরা!
যখন আশা ছেড়ে দিয়েছেন, তখনই বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন মাহমুদউল্লাহ ও শফিউল। একজন নির্ভেজাল ব্যাটসম্যান, পাকেচক্রে সাত নম্বরে ব্যাটিং করেন। অন্যজন পেস বোলার, তবে টেস্ট ইতিহাসে প্রথম দুটি স্কোরিং শটেই ছক্কা মারার একমাত্র কীর্তিটি তাঁর। দুজনই ব্যাটিং করতে পারেন। কিন্তু কাল তাঁদের আসল পরীক্ষাটা যে ব্যাটসম্যানশিপের ছিল না, ছিল স্নায়ুর। রক্তের স্বাদ পাওয়া বাঘ হয়ে ওঠা ইংলিশ বোলাররাই যথেষ্ট কঠিন প্রতিপক্ষ ছিল, এর সঙ্গে অন্তহীন চাপ মিলিয়ে তাঁদের চোখ রাঙাচ্ছিল জীবনের কঠিনতম চ্যালেঞ্জ। সেই চ্যালেঞ্জে কী দুর্দান্তভাবেই না জিতলেন ওঁরা দুজন!
মাহমুদউল্লাহ ৪২ বলে ২১, শফিউল ২৪ বলে ২৪ রান—রান-বলের এসব হিসাব নিছকই পরিসংখ্যানের খাতা ভরানোর। এর সাধ্য কী ওঁদের বীরত্ব বোঝায়! অসমাপ্ত নবম উইকেটে ৫৮ রানের জুটি। শফিউল নামতে নামতে রান আর বলের হিসাবটাও কঠিন হতে শুরু করেছে। ৪২তম ওভারের শুরুতে বল আর রানের সমীকরণে এগিয়ে গেছে রান—৫৪ বলে প্রয়োজন ৫৫ রান। সোয়ানের সেই ওভারেই লড়াইয়ের ঘোষণাটা দিলেন। ওই ওভার থেকে এল ১৬ রান। মাহমুদউল্লাহর একটি চার, শফিউল চারের সঙ্গে ছয়ও মারলেন একটি।
৪৮ বলে ৩৯ রানের সহজ সমীকরণ এরপর। কিন্তু শুধু রান-বলের হিসাবই তো নয়, বাংলাদেশকে ভাবতে হচ্ছে উইকেট নিয়েও। একটি উইকেট পড়ে গেলেই তো চাপটা হয়ে যাবে হাজার গুণ। মাহমুদউল্লাহর নির্ভার ব্যাট সেই শঙ্কা দূর করল। আর শফিউলের ঝলসে ওঠা ব্যাট আঁধার কেটে আনল আলো।
৩ রান দরকার, মাহমুদউল্লাহ ব্রেসনানকে কভার ড্রাইভ মারলেন। পাওয়ার প্লের ফিল্ডিং ফাঁকি দেওয়ার অর্থই বাউন্ডারি। সেটি দেওয়ার পর বল সীমানা ছোঁয়ার আগেই ব্যাট উঁচিয়ে দৌড় দিলেন মাহমুদউল্লাহ। শফিউল তখন বিহ্বল। মাঠে তখন আবেগের অদৃশ্য ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। ড্রেসিংরুম থেকে দৌড়ে আসছেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা। গ্যালারিতে সমুদ্রের জলকল্লোল। সাগরপারের এই স্টেডিয়াম থেকে যে উল্লাসধ্বনি মুহূর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে পুরো দেশে।
এটা তো নাটকের শেষ অঙ্ক। এর আগে কতবার যে ম্যাচের রং বদলাল! ইংল্যান্ডকে ২২৫ রানে আটকে দেওয়ার পর জয়টা দুলছিল চোখের সামনেই। কিন্তু দুলতে দুলতে তা দৃষ্টিসীমার আড়ালে চলে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল অনেকবারই। শুরুতে তামিম-ঝড়ের পর জুনায়েদের রানআউট, দারুণ একটি বলে রকিবুলের বোল্ড হওয়ার পর ইমরুলের সঙ্গে মিলে হালটা ধরলেন সাকিব।
ইমরুল কায়েস ও সাকিব আল হাসানের ৮২ রানের চতুর্থ উইকেট জুটির সময় পরাজয় লেখা হয়ে গিয়েছিল ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়দের চোখেমুখে। গ্রায়েম সোয়ান শিশিরভেজা বল নিয়ে নাটকের চূড়ান্ত করলেন। প্রায় প্রতিটি বল করার পরই উইকেটের মাটি হাতে মাখলেন। রুমালের চূড়ান্ত সদ্ব্যবহার হলো। বল পরিবর্তন করার আবেদন প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর আম্পায়ার ড্যারিল হার্পারের সঙ্গে তর্কাতর্কিও করলেন। সবকিছু একটা বার্তাই দিচ্ছিল—সুনামির মতো পরাজয়কে ধেয়ে আসতে দেখছেন সোয়ানরা।
কিন্তু এই ম্যাচ যে বাংলাদেশের মানুষের স্নায়ুর চরমতম পরীক্ষা নেবে বলে পণ করে রেখেছে। নাটকের শুরু ইমরুলের রানআউট দিয়ে। তখন সেটিকে এমন প্রভাববিস্তারী বলে মনে হয়নি। ১১৪ বলে প্রয়োজন ৭১ রান। উইকেটে আছেন সাকিব আল হাসান, সব বিতর্ক ব্যাটের ঘায়ে উড়িয়ে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা বিচ্ছুরিত হচ্ছে যাঁর সর্বাঙ্গ থেকে।
ইমরুলকে হারিয়ে একটু বেশি সাবধানী হয়ে যাওয়াতেই শুরু নাটকের পরের অঙ্কটা। পরের ৫ ওভারে এল মাত্র ৭ রান। সেই চাপেই সোয়ানের অফ স্টাম্পের বাইরের বলে সুইপ করতে গিয়ে তা স্টাম্পে টেনে আনলেন সাকিব। দেখতে না-দেখতেই ১৪ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধূসর বাংলাদেশের স্বপ্ন।
মাহমুদউল্লাহ-শফিউলের বীরত্ব সেই স্বপ্নকে শুধু সত্যিই করল না, নতুন করে রং লাগাল বাংলাদেশের বিশ্বকাপ-স্বপ্নেও।
ক্রিকেট কখনো খালি হাতে ফেরানোর নিষ্ঠুরতা দেখায় বটে, আবার দুহাত ভরেও দেয়।