বিশ্বকাপের ট্র্যাজিক হিরো
উৎপল শুভ্র
৪ সেপ্টেম্বর ২০২১
ওই বিশ্বকাপটা তাঁর ছিল, ২২ বছর পরও তাঁরই আছে। তবে ল্যান্স ক্লুজনারের কাছে ১৯৯৯ বিশ্বকাপ সম্ভবত আক্ষেপই জাগিয়ে যায়। ২৮১ রান আর ১৭ উইকেট পেয়েও দলকে যে তুলতে পারেননি ফাইনালে। নিজেরই এক পাগলাটে দৌড়ের কারণে....
প্রথম প্রকাশ: ১৯ জুন ১৯৯৯। প্রথম আলো।
একদিন বিশ্বকাপ হাতে ওয়াসিম আকরাম বা স্টিভ ওয়াহর ছবিটিই প্রতীক হয়ে যাবে এই বিশ্বকাপের। ক্লাইভ লয়েড আর কপিল দেবের পর এই প্রথম কারও সুযোগ এসেছে লর্ডসের ব্যালকনিতে বিশ্বকাপ হাতে দাঁড়ানোর। কাল যখন সেই দৃশ্য দেখবে পুরো বিশ্ব, হানসি ক্রনিয়ে তখন কী করবেন? অথবা ল্যান্স ক্লুজনার?
যে বিশ্বকাপটি নিয়ে বাকি জীবন গল্প করার কথা ছিল ক্লুজনারের, সেটিই এখন দুঃস্বপ্ন হয়ে বারবার ফিরে আসবে তাঁর মনে। কখনো কখনো ক্রিকেট বড় নিষ্ঠুর, নইলে ক্লুজনারের বিশ্বকাপ কেন এমন হবে?
পুরো টুর্নামেন্টে বলতে গেলে একটি পা-ও ভুল ফেলেননি। ম্যাচের পর ম্যাচ রান তুলেছেন, সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নিয়েছেন উইকেট। এমন অলরাউন্ড নৈপুণ্যের ঝলক বিশ্বকাপ এর আগে কখনো দেখেনি। শুধু রানের সংখ্যা, আউট হওয়ার আগে সবচেয়ে বেশি রান করার রেকর্ড-- এসবে ক্লুজনারের মহিমা বোঝা যায় সামান্যই। ম্যাচের পর ম্যাচ জিতিয়েছে ক্লুজনারের ব্যাট। পাহাড়প্রমাণ চাপ সামলে যেখানে সব ঝড়ো ইনিংস খেলেছেন, তাতে পুরো ব্যাপারটিকেই মনে হয়েছে যেন ছেলেখেলা। এমন ইনিংস অন্য ব্যাটসম্যানরাও খেলে, তবে সেটি দশ ইনিংসে একবার। ক্লুজনার ব্যাপারটি পরিণত করেছিলেন অভ্যাসে। এ কারণেই সুপার সিক্স শুরু হওয়ার পরপরই ভিভ রিচার্ডস ঘোষণা করেছেন, ল্যান্স ক্লুজনারই আমার ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট। ও তো নিয়মিত ম্যাচ জেতাচ্ছে। এটিই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট হয়তো তিনি এখনো হবেন। ৮ ইনিংসে আউট হয়েছেন মাত্র দুবার। রান ২৮১, গড় ১৪০.৫, সঙ্গে ১৭ উইকেট- একজন ক্রিকেটার আর কী করতে পারে? কিন্তু মুহূর্তের একটা ভুল কুজনারের মন থেকে মুছে দিয়েছে এর সবকিছুই। তাঁর চোখে এখন একটাই দৃশ্য। নন স্ট্রাইকার প্রান্তের দিকে ছুটে যাচ্ছেন তিনি, অ্যালান ডোনাল্ড নড়ছেন না। পুরো দক্ষিণ আফ্রিকার জন্যই এটি ‘হরর' ছবির এক দৃশ্য হয়ে থাকবে চিরদিন। আর ক্লুজনারের কাছে?
দু'দলে আরো ২১ জন ছিল, কেন তাঁকেই এই ট্র্যাজেডির নায়ক হতে হবে? সেমিফাইনালেও তো ক্লুজনার আবারও সেই অবিশ্বাস্য ম্যাচ উইনার হয়ে থাকাই নিশ্চিত করে ফেলেছিলেন। এই বিশ্বকাপে দর্শকদের এতটা আনন্দ দিয়েছেন যিনি, তাঁকে কেন এমন দুঃখে পুড়তে হবে? সত্যিই কখনো কখনো ক্রিকেট বড় নিষ্ঠুর খেলা!
সেমিফাইনাল শেষে সংবাদ সম্মেলনে বারবার উঠল তাঁর নাম। তাঁর অধিনায়ক হানসি ক্রনিয়ে যেমন বললেন, 'ল্যান্সের জন্য অবিশ্বাস্য এক টুর্নামেন্ট গেলো এটি। এখনো তো আমার ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট ও-ই।' স্টিভ ওয়াহ আর শেন ওয়ার্নও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তাই। ওয়ার্ন তো ‘অবিশ্বাস্য' শব্দটি ব্যবহার করে ফেললেন বেশ ক'বার, 'ও যে কেমন করে এভাবে মারে। এমন একজন থাকলে কোনো ম্যাচই আগে হেরে বসতে হয় না।'
সেমিফাইনালে হারেনি দক্ষিণ আফ্রিকাও। তারপরও এটিই দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় হারের দিন। অবিস্মরণীয় সব বিজয়ের দিনগুলো মুছে দিয়ে ক্লুজনারের মনেও '৯৯ বিশ্বকাপ বলতে না হেরেও এই সবচেয়ে 'বড় পরাজয়ে'র স্মৃতিই ফিরে আসবে বারবার। আবার কবে একটু শান্তি মতো ঘুমুতে পারবেন ক্লুজনার!
আহ্, কখনো কখনো ক্রিকেট বড় নিষ্ঠুর!
আরও পড়ুন:
এ দিনটি কীভাবে ভুলবেন ক্লুজনার!