কনকাশন সাবে বাংলাদেশ সবার ওপরে
উৎপলশুভ্রডটকম
৩০ নভেম্বর ২০২১
ফিল হিউজের মৃত্যুর ঘটনায় ক্রিকেট দুনিয়ার অনেক কিছু বদলেছে। সেই বদলের ধারায় স্টিভেন স্মিথের কনকাশন সাব হয়ে যা মারনাস লাবুশেন করেছেন, তা রীতিমতো ক্রিকেটীয় রূপকথা। চট্টগ্রাম টেস্টে বাংলাদেশকেও খুঁজতে হয়েছে কনকাশন সাব। অভিষিক্ত ইয়াসির আলী রাব্বীর জায়গায় নেমেছেন নুরুল হাসান সোহান। যা জাগিয়ে তুলছে একটা প্রশ্ন। ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি কনকাশন সাব কি বাংলাদেশেরই?
ক্রিকেটে ‘কনকাশন’ শব্দটার যখন বলতে গেলে পরিচিতিই ছিল না, অস্ট্রেলিয়ার মারনাস লাবুশেন সেটাকে বিশ্ব ক্রিকেটের ঘরে ঘরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। যেটির শুরু ২০১৯ অ্যাশেজ সিরিজের লর্ডস টেস্টে জফরা আর্চারের বাউন্সার স্টিভ স্মিথের হেলমেটে আঘাত করা দিয়ে। ততদিনে ঘরোয়া ক্রিকেটে কনকাশন বদলি চালু হয়ে গেলেও টেস্ট ক্রিকেট সেবারই তা প্রথম দেখেছিল। স্মিথের বদলি হিসেবে নেমে লাবুশেন যা করেছিলেন, তা হয়ে আছে ক্রিকেটীয় রূপকথা।
সে অন্য গল্প। প্রসঙ্গক্রমে আসবেই। কনকাশন বদলির কথাটা আসছে আজ চট্টগ্রাম টেস্টের ঘটনায়। ইয়াসির আলী রাব্বীর কারণে। প্রায় দুই বছর ধরে দলের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছেন, কিন্তু খেলার সুযোগ মিলছিল না মোটে। অবশেষে যখন সবচেয়ে সম্মানের টেস্ট ক্যাপ পেলেন ইয়াসির আলী রাব্বী, ওই মুহূর্তে তো তার সপ্তম আকাশে বিচরণ করার কথা। কিন্তু তা আর স্থায়ী হলাে কই! দ্বিতীয় ইনিংসে মুশফিকুর রহিমের বিদায়ে বাংলাদেশে যখন বিপদে, ইয়াসির বুঝেশুনে খেলার ধারাপাতই পাঠ করছিলেন। ৭২ বলে ৩৬ রান করে ফেললেন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে, এর মধ্যে হাত খোলারও শুরু। কিন্তু বিপদটা এলো ঝড়ের গতিতে।
পাকিস্তানি ফাস্ট বোলার শাহিন শাহ আফ্রিদির একটা বাউন্সার ছোবল তুলল। ডাক করতে ইয়াসিরের যে টাইমিংয়ের সামান্য গণ্ডগোল হয়েছে, তা বলাই যায়। হেলমেটে বল লাগার পর ফিজিও ফিরে গেছেন রুটিন প্রশ্ন করে। কিন্তু ইয়াসিরের তো আর ভালো লাগে না। কয়েকটা বল খেলার পর হার মানতে হয়। মাঠ ছাড়েন। উইকেটকিপার-ব্যাটসম্যান নুরুল হাসান সোহান কনকাশন রিপ্লেসমেন্ট হলেন। ইয়াসিরকে হাসপাতালে স্ক্যানের জন্য নেওয়া হয়েছিল। ঠিক আছেন। কনকাশনের নিয়ম হলো ব্যাটসম্যানের বদলে ব্যাটসম্যান, বোলারের বদলে বোলার, অলরাউন্ডারের বদলে অলরাউন্ডার রিপ্লেসমেন্ট নিতে হবে। যে ব্যাটসম্যান কনকাশনের কারণে আর এই ম্যাচে খেলতে পারবেন না, তার রিপ্লেসমেন্ট কেবল সেই কাজটাই করতে পারবেন।
পরিসংখ্যান খুঁজতে গিয়ে দেখা গেল, কনকাশন সাবের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এক নম্বরে। টেস্ট আর ওয়ানডে মিলিয়ে চারবার ’কনকাশন সাব’ খুঁজে নিতে হয়েছে বাংলাদেশকে। এর মধ্যে এক টেস্টেই দুবার। এই ঘটনা আর কোনো দলের ক্ষেত্রে ঘটেনি। ২০১৯ সালের নভেম্বরে কলকাতায় দিবা-রাত্রির টেস্ট ম্যাচে লিটন কুমার দাস (২৪) ও নাঈম হাসানকে (১৯) বেরিয়ে যেতে হলো মোহাম্মদ শামির বাউন্সারে চোট পেয়ে। তাদের বদলি হিসেবে নামলেন মেহেদী হাসান মিরাজ ও তাইজুল ইসলাম।
এক টেস্টে দুজন কনকাশন বদলির ঘটনায় যেমন বাংলাদেশ প্রথম, তেমনি প্রথম ছেলেদের ওয়ানডেতে প্রথম কনকাশন বদলিতেও। গত মে মাসে মিরপুরে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা দ্বিতীয় ওয়ানডেতে দুষ্মন্ত চামিরার বাউন্সারে চোট পেয়েছিলেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। হেলমেটে বল লাগার পরও দৌড়ে এক রান নিতে গিয়ে তিনি রান আউট হয়ে যান। পরে কনকাশনের লক্ষণ দেখা দেওয়ায় আর ফিল্ডিং করতে নামেননি। তাঁর বদলে বোলিং করেন তাসকিন আহমেদ। মেয়েদের ওয়ানডে অবশ্য এর আগেই কনকাশন সাব দেখে ফেলেছে। ২০১৯ সালের ১ নভেম্বর অ্যান্টিগায় ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের শাবিকা গজনবীর কনকাশন বদলি হিসেবে নেমেছিলেন চিনেল হেনরি।
লর্ডসে ইতিহাসের প্রথম কনকাশন বদলির ঘটনা আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া যাক। প্রথম ইনিংসে ৮০ রান করার পর মাথায় চোট পেয়ে ফিরে যাওয়ার পর আবার ফিরে এসে স্মিথ ৯২ রান করেছিলেন। এরপর খারাপ লাগতে শুরু করায় দ্বিতীয় ইনিংসে লাবুশেন ব্যাট করেছিলেন স্মিথের কনকাশন বদলি হিসেবে। তাঁর ব্যাট থেকে আসে ৫৯ রান, যা ছিল অস্ট্রেলিয়ার দ্বিতীয় ইনিংসের সর্বোচ্চ। স্মিথের কনকাশন পরবর্তৗ জটিলতায় তৃতীয় টেস্টেও দলে ঢুকে পড়েন লাবুশেন। এরপর তো শুরু হয় তাঁর বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা।
পরের তিন টেস্টে সুযোগ পেয়ে লাবুশেন তিন ফিফটিতে ২৯৪ রান করেন। হয়ে যান দলে নিয়মিত। এরপর পাকিস্তানের অস্ট্রেলিয়া সফর। গ্যাবায় নিজের প্রথম টেস্টে খেলে পেলেন ১৮৫ রানের ইনিংস। দ্বিতীয় টেস্টেও সেঞ্চুরি আসে তাঁর ব্যাট থেকে। শুধু তাই নয়, ডিসেম্বরে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম টেস্টেও সেঞ্চুরি করেন। রান মেশিন হয়ে ওঠেন কনকাশন সাব।
টানা তিন সেঞ্চুরির পর লাবুশেন পরের দুই ইনিংসে দুটি ফিফটি করেন। ২০২০ সাল শুরু করার আগেই খেলেন ২১৫ রানের প্রথম ডাবল সেঞ্চুরির ইনিংস। ২০১৯ সালে টেস্টে সবচেয়ে বেশি রানের রেকর্ড গড়ে লাবুশেন পরিণত হন এক বিস্ময়ে। অবাক করার মতো ব্যাপার হলো, তাঁর ১,১০৪ রানের ৯৭৫-ই এসেছে আগস্টে কনকাশন সাব হওয়ার পর। এই সময়ে বিশ্ব র্যাঙ্কিংয়ে ১০৬ ধাপ উন্নতি করে উঠে আসেন চার নম্বরে।
পুরুষ ও নারী মিলিয়ে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচে প্রথম কনকাশন সাব ভারতের রিচা শর্মা। মেলবোর্নে ২০২০ আইসিসি উইমেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের তানিয়া ভাটিয়ার বদলি হিসেবে নেমেছিলেন তিনি।
কনকাশন বদলি নিয়ে অনেক সময় বিতর্কও হয়েছে। ২০২০ সালে ক্যানবেরায় অস্ট্রেলিয়া-ভারত ম্যাচেই যেমন। প্রথম টি-টোয়েন্টির শেষ ওভারে মিচেল স্টার্কের বল জাদেজার মাথায় আঘাত হানে। বাকি বল খেলেন জাদেজা। কিন্তু গোল বাঁধে ইনিংস ব্রেকের পর জাদেজার সাব হিসেবে ভারত লেগ স্পিনার চাহালকে নামালে। বোলার হিসেবে জাদেজার চেয়ে চাহাল ভালো ধরলে ভারত বাড়তি সুবিধা পেয়ে যায়। অস্ট্রেলিয়ার কোচ জাস্টিন ল্যাঙ্গার এমনই ভেবেছিলেন। ভারত জাদেজা ও চাহাল দুজনের ভালো দিকটার সুফলই পেয়েছিল। ব্যাটিংয়ে ৪৪ রান করেছিলেন জাদেজা। আর বোলিংয়ে ৩ উইকেট তুলে নিয়ে চাহাল তো হয়ে যান ম্যান অব দ্য ম্যাচই।