উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
লিটন-মুশফিকের জুটিতে চোখের আরাম
ইফতেখার নিলয়
২৭ নভেম্বর ২০২১
মাঠে যখন দেশসেরা দুই টেকনিক্যালি সলিড ব্যাটসম্যান, তখন তো সেই ব্যাটিং দেখা হয়ে দাঁড়ায় প্রশান্তির সমতুল্য। আরেকটু বাড়তি উপমা যোগ করলে লিটন-মুশফিকের ব্যাটিং দেখলে সমর্থকদের ‘চোখের আরাম’ হয়।
ভোররাতের ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠা চট্টগ্রামে বাংলাদেশ সমর্থকদের সকালের শুরুটাও হয়েছিল অস্বস্তিতে। সাগরিকায় টস জিতে অধিনায়ক মুমিনুলের সিদ্ধান্তে ব্যাটিংয়ে নেমেও কাটানো যায়নি ওপেনারদের দুরবস্থা। ভূমিকম্পের মতোই আঘাত হানে পাকিস্তানি সিমাররা। দুই ওপেনারসহ চার ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফেরত দলীয় স্কোর যখন পঞ্চাশের চেয়েও এক কম। এর মধ্যেই আবার সাগরিকায় কেমিক্যাল ফ্যাক্টরিতে লাগা আগুনের কালো ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় মাঠের আকাশ। এ যেন আরেক অশনি সংকেত।
চার ব্যাটসম্যানের দ্রুত বিদায়ে ম্যাচে ফিরতে তাই মুশফিকের সঙ্গে লিটনের লম্বা জুটির বিকল্প ছিল না। সামর্থ্য থাকার পরেও সাদা বলে লিটনের কাছে ভালো কিছু আশা করে আশাভঙ্গের যন্ত্রণায় পোড়া নিয়মই হয়ে গেছে। তবে লিটন ব্যতিক্রম সাদা পোশাকের লাল বলের ক্রিকেটে। প্রমাণটা তো আরেকবার মিলল নিজের প্রথম টেস্ট শতকের সঙ্গে মুশফিকের সাথে দুই শর বেশি রানের জুটিতে দলকে ম্যাচে ফেরানোয়।
৪৯ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর ক্র্যাম্পের সঙ্গে লড়াই করে অপরাজিত ১১৩ রানের ইনিংস। দিন শেষে স্কোরবোর্ডে ২৫৩। আর লিটন-মুশফিক জুটির রান ততক্ষণে ২০৪। টেস্ট ক্রিকেটের সৌন্দর্য ঠিক এখানেই! খাদের কিনারা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আবারও দৃঢ় প্রত্যয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া। তার ওপর মাঠে যখন দেশসেরা দুই টেকনিক্যালি সলিড ব্যাটসম্যান, তখন তো সেই ব্যাটিং দেখা হয়ে দাঁড়ায় প্রশান্তির সমতুল্য। আরেকটু বাড়তি উপমা যোগ করলে লিটন-মুশির ব্যাটিং দেখলে সমর্থকদের ‘চোখের আরাম’ হয়।
পাঁচ দিনের খেলার শুরুর এক ঘন্টাতেই এমন ধাক্কা ইনিংস ব্যবধানে পরাজয়ের শঙ্কা জন্ম দিয়েছিল খানিকটা হলেও। লিটন আর মুশি সেই শঙ্কা আপাতত অনেকাংশেই মুছে দিয়েছেন। কেটেছে দুই সেশনেই বা প্রথম দিন শেষ হওয়ার আগেই ইনিংস গুটিয়ে যাওয়ার শঙ্কাও। এই দুজনের প্রতিটা স্কয়ার কাট,কাভার আর অন ড্রাইভে হাসি ফিরেছে সাজঘরে থাকা অধিনায়কের মুখে।
ম্যাচ শুরুর আগের দিন চট্টগ্রাম টেস্টের টিকেট কিনতে দর্শকদের অনাগ্রহের খবর চাউর হয়েছিল। মূলত বিশ্বকাপের পর পাকিস্তানের বিপক্ষেও টি-টোয়েন্টি সিরিজে ব্যর্থতায় এমন পরিস্থিতির জন্ম। শুরুর ধাক্কা সামলে লিটন-মুশির জুটি যে আগামীকাল মাঠে দর্শক ভিড় করতে বাধ্য করবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ধৈর্য্যের পরীক্ষা বড় পরীক্ষা, যে পরীক্ষায় ১০০-তে ১০০ পেয়েই উত্তীর্ণ লিটন আর মুশি। দুজনের ৪১৩ বলে ২০৪ রানের অসমাপ্ত জুটিটি তারই প্রমাণ।
এখনও অনেক দূর যাওয়া বাকি। টেস্টে অর্ধশতক কিংবা শতকে দায়িত্ব শেষ বা ফুরিয়ে যায় না। যেখানে সুযোগ থাকে শতককে দ্বিশতকে রূপান্তরের। অধিনায়ক মুমিনুল হয়তো সেই প্রত্যাশাই করেছেন মুশফিকের কাছ থেকে। শতক থেকে ১৮ রান দূরে ৮২ রানে দিন শেষ করা মুশফিক নিশ্চিত সে কথা মাথায় রেখেই দ্বিতীয় দিন মাঠে নামবেন। লিটনের চোট হয়তো মুশফিকের দায়িত্ব আরও বাড়িয়ে দেবে।
প্রথম দিন দুই ব্যাটসম্যানই দারুণ ব্যাটিং করেছেন। মাঠের চারপাশে শট খেলেছেন। লিটন ৯০% বল নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে রান করেছেন আর মুশফিক ৮৯%। লিটনের কাট শট বাড়তি নজর কেড়েছে। চারটি চার এসেছে এই শটে, এই শটেই রানও করেছেন সর্বোচ্চ ২৬। অন্যদিকে মুশফিকের অন ড্রাইভে চার এসেছে দুটি আর সর্বোচ্চ ১৫ রানও করেছেন এই শটে।
যতই টেস্টে লিটনের পারফরম্যান্স ভালো হোক, সম্প্রতি সাদা বলে অফ ফর্মের বৃত্তে বন্দী হয়ে বিশ্বকাপের পর দল থেকে বাদ পড়া মানসিক জড়তার সৃষ্টি করেছিল নিশ্চিত। তাছাড়া লিটনের মূল সমস্যাটাই তো মানসিক। সেই মানসিক জড়তা থেকে বেরিয়ে এসে এমন একটা ইনিংস খেলা তো বিরাট অর্জন।
টেস্টে উইকেটে পড়ে থাকার এই মানসিকতাটাই জরুরি। যাতে সফল হতে জরুরি টেকনিক্যালি সাউন্ড হওয়াও। মুশফিক আর লিটন এই জায়গায় আর অন্য সবার চেয়ে এগিয়ে।
মুশফিক সমর্থকদের কাছ থেকে বড় ধন্যবাদটা পাবেন সিনিয়র হিসেবে লিটনকে যথাযোগ্য সঙ্গ দেওয়ার কারণেই। বিশ্বকাপে দলগত হতশ্রী পারফরম্যান্সের পর হোম সিরিজেও পরাজয়। তলানিতে চলে যাওয়া দলের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে এমন কিছু জরুরি ছিল। পরের ব্যাটসম্যানদের পথটাও এতে অনেকখানি সহজ হয়ে যাবে।
এই ইনিংসে ব্যর্থ হওয়া সাইফ, শান্ত, মুমিনুল আর সাদমানরাও বাড়তি প্রেরনা পাবেন লিটন-মুশির জুটি থেকে। শুধু দর্শক-সমর্থক কেন, সতীর্থদের জন্যও তো লিটন-মুশফিকের জুটি ‘চোখের আরাম’ হয়েই এসেছে। মনের আরামও।