২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ
এবার যে জেগে উঠতে হয় মুশফিক
উৎপলশুভ্রডটকম
১৬ অক্টোবর ২০২১
সর্বশেষ নয় টি-টোয়েন্টিতে একবার ব্যাটিং করেননি। বাকি আট ম্যাচে তিনবার ফিরেছেন শূন্য রানে। এর মধ্যে দুবার তো প্রথম বলেই। এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ওয়ার্ম-আপ ম্যাচেও তিনি ব্যর্থ। আর এমনিতেও মুশফিকুর রহিমের টি-টোয়েন্টি পারফরম্যান্স কখনোই খুব ভালো না। তারপরও তিনি মুশফিক বলে কথা। বিশ্বকাপ ঘিরে যে স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ, তা পূরণে মুশফিককে তো এখন জেগে উঠতেই হবে।
মিডল-অর্ডারে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভরসার কথা বললে সবার আগে বোধ হয় তাঁর নামটাই লিখতে হবে। গালভরা একটা নামও তো জুটেছে তাঁর, 'মি. ডিপেন্ডেবল’। কখনো দুবাইতে, কখনো গলে, কখনো বা ওয়েলিংটনে...মুশফিকুর রহিমের ওই ব্যাটটা ভরসা অনেকবারই যুগিয়েছে। তবে সবই তো ওয়ানডে কিংবা টেস্টে। টি-টোয়েন্টিতে কি ব্যাটটা সেরকমভাবে আস্থার অন্য নাম হতে পেরেছে?
৮২ ইনিংস খেলে ১৯.৭২ গড়ে ১৩২১ রান, স্ট্রাইক রেট ১১৫.৬৭। এবার বিশ্বকাপে মুশফিক যাচ্ছেন এমন পরিসংখ্যান সঙ্গী করেই। ক্যারিয়ারের ৩০তম ম্যাচে এসে দেখা পেয়েছিলেন প্রথম টি-টোয়েন্টি হাফ সেঞ্চুরির। অবস্থার খুব একটা বদল হয়নি এরপরও। পরের ফিফটিটা পেতে খেলতে হয়েছে প্রথমবারের চেয়েও এক ম্যাচ বেশি, অর্থাৎ ৬১তম ম্যাচে। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে মুশফিক এখন পর্যন্ত ম্যাচ খেলেছেন ৯১টি, এর মধ্যে অর্ধশতক মোটে পাঁচটি। যেখানে ম্যাচ জেতানো ফিফটি মাত্র দুটি। নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেই ৩৬ বলে ৭২ রান, আর ২০১৯ সালে ভারতের মাটিতে টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচে করেছিলেন অপরাজিত ৬০ রান।
তাহলে প্রশ্ন হলো, টি-টোয়েন্টিতে মুশফিকের কার্যকারিতা ঠিক কোথায়? সবশেষ ৯ টি-টোয়েন্টিতে একবার ব্যাটিং করতে পারেননি। বাকি আট ম্যাচে তিনবার ফিরেছেন শূন্য রানে, এর মধ্যে দুবার তো প্রথম বলেই। দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছালেও পারেননি বিশের সীমারেখা পার হতে। কিউইদের বিপক্ষে ঘরের মাঠে যে সিরিজ বাংলাদেশ জিতল, তাতে ফিল্ডিংয়ে মুশফিকের অবদান থাকলেও ব্যাটিংয়ের বেলায় তা একেবারে যৎসামান্যই।
টেস্ট ছাড়া বাকি দুই ফরম্যাটেই বাংলাদেশ দলের চার নম্বর পজিশনটা বরাদ্দ মুশফিকের জন্য। কিন্তু এই পজিশনে মুশফিক কতটুকু সফল? টি-টোয়েন্টিতে অন্যান্য দেশের একই পজিশনের ব্যাটসম্যানদের সাথে তুলনায় গিয়েই দেখা যাক। এমনিতে ১৯ ম্যাচ ও ১৭ ইনিংস কম খেলেও অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল মুশফিকের চেয়ে এগিয়ে ৪৫৯ রানে। ব্যাটিং গড়ে মুশফিক পিছিয়ে ১০.৫২ রান। শুধু ৪ নম্বর পজিশনের তুলনায় গেলে দেখা যাচ্ছে, ৩২ ইনিংসে ব্যাট করে ৩৪ গড়ে ৯৫৮ রান করেছেন ম্যাক্সওয়েল। হাঁকিয়েছেন একটি সেঞ্চুরি ও পাঁচটি হাফ সেঞ্চুরি। আর মুশফিকের পুরো টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারেই নেই কোনো হান্ড্রেড। ফিফটির সংখ্যাতেও তো মুশফিকের পুরো ক্যারিয়ার হয়ে যাচ্ছে ম্যাক্সওয়েলের এক পজিশনের রেকর্ডের সমান। ৪ নম্বরে ম্যাক্সওয়েলের চেয়ে ৯ ম্যাচ বেশি খেলে ১০৫ রান কম করেছেন মুশফিক। হাফ সেঞ্চুরি কম করেছেন একটি। দুজনের স্ট্রাইক রেটের তুলনা না করাই বোধ হয় শ্রেয়।
স্ট্রাইক রেটের কথায় অবশ্য ইংল্যান্ড অধিনায়ক এউইন মরগানের নামটাও সামনে চলে আসে। ৪ নম্বর পজিশনে ৫৬ ইনিংসে ব্যাটিং করে তাঁর স্ট্রাইক রেট ১৩৯.৩০। আর রান করেছেন ১৩১৫, সংখ্যাটা মুশফিকের পুরো টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারের চেয়ে মাত্র ৬-ই কম।
আইসিসির সহযোগী সদস্য স্কটল্যান্ডের রিচি বেরিংটনের সাথে তুলনা করতে গেলেও মুশফিককে এগিয়ে রাখা যাচ্ছে না খুব। ৪ নম্বর পজিশনে ১৫ ইনিংস ব্যাট করে বেরিংটনের গড় ব্যাটিং গড় ৬৩। ফিফটি হাঁকিয়েছেন ৫টা, স্ট্রাইক রেটও ১৪০। রান সংখ্যায় মুশফিক ২১৪ রানে এগিয়ে থাকলেও ম্যাচ খেলেছেন ২৬টি বেশি।
মু্শফিক বলতে পারেন, পুরো ক্যারিয়ারের প্রায় অর্ধেক ইনিংসই তাঁকে খেলতে হয়েছে মিরপুরের স্লো-লো উইকেটে। কথা সত্য. ঘরের মাঠে ৪০ ম্যাচ খেলেছেন তিনি। তাতে ৩৬ ইনিংস ব্যাটিং করে তাঁর ব্যাটিং গড় ১৯.১৭, স্ট্রাইক রেট মাত্র ১০৮.২৯। কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ, নিউজিল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকাতেও তো সুবিধের নয় মুশফিকের পরিসংখ্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজে ব্যাটিং গড় ১১, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৮, নিউজিল্যান্ডে একটা টি-টোয়েন্টি খেলে আউট হয়েছিলেন শূন্যতেই। মুশফিকের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ পরিসংখ্যানও যাচ্ছেতাই। সবগুলো বিশ্বকাপ খেলে ২০ ইনিংসে ১৬ গড়ে করেছেন ২৫৮ রান, স্ট্রাইকরেট মাত্র ১০৪। নেই কোনো ফিফটি।
পারফরম্যান্সের এমন হতশ্রী দশা নিশ্চয়ই মুশফিকেরও অজানা নয়। এই পরিসংখ্যানগুলোই কি চাপ হয়ে বসেছে তাঁর জন্য? দ্রুত রান তোলার তাড়না শট সিলেকশনেও বোধ হয় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে, ইনিংসের শুরুর দিকেই স্কুপ কিংবা স্লগ সুইপের ফাঁদে আটকে গেছেন বহুবার। যেমনটা দেখা গেছে ওমান 'এ' দলের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচেও।
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজটা খেলতে পারেননি, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সিরিজে ফিরলেও ব্যাটে ছিল ভাটার টান। বায়ু পরিবর্তনেও লাভ হয়নি ব্যাটিংয়ে, মরুর দেশে গিয়েও তিন প্রস্তুতি ম্যাচে করেছেন মোটে ১৭ রান।
এমনিতে আমিরাতে মুশফিকের পারফরম্যান্সটাও বেশ আশাজাগানিয়া। টি-টোয়েন্টি খেলা হয়নি সে দেশে, তবে পাঁচটা ওয়ানডে খেলেছেন ২০১৮ সালের এশিয়া কাপে। ওই পাঁচ ম্যাচে তাঁর ব্যাটিং গড় ৬০.৪০, সেঞ্চুরি করা ইনিংসটাতে রচনা করেছিলেন ১৪৪ রানের মহাকাব্য।
মাঝের তিন বছরে মুশফিক অভিজ্ঞতার ঝুলিটা সমৃদ্ধ করেছেন আরেকটু। নিজেদের সপ্তম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলতে এবার আমিরাতে গেছেন যে ছয় ক্রিকেটার, মুশফিক তাদেরই একজন। মুশফিক কি পারবেন, সপ্তম বিশ্বকাপে এসে সপ্তম স্বর্গে চড়তে?
'লাকি সেভেন' কথাটার সার্থকতাও তো প্রমাণিত হয় তাহলে।