অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়-৩
শেষ রোমাঞ্চের অপেক্ষায়
উৎপল শুভ্র
৩০ আগস্ট ২০২১
তিন দিন শেষে মিরপুর টেস্টে বড় হয়ে উঠেছিল একটা প্রশ্নই। ১৫৬ রান করা বেশি কঠিন, না ৮ উইকেট নেওয়া? প্রথমটা ছিল জয়ের জন্য অস্ট্রেলিয়ার প্রয়োজন। দ্বিতীয়টা বাংলাদেশের। এর তৃতীয় দিনের খেলা প্রথম দুদিনের মতোই রোমাঞ্চ ছড়িয়ে টেস্ট ক্রিকেটের রংয়ে রাঙিয়ে দিয়েছিল মন।
প্রথম প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০১৭। প্রথম আলো।
তৃতীয় দিন শেষে
বাংলাদেশ: ২৬০ ও ২২১। অস্ট্রেলিয়া: ২১৭ ও ১০৯/২
১৫৬ রান করা বেশি কঠিন, না ৮ উইকেট নেওয়া? রীতিমতো কোটি টাকার প্রশ্ন। গত তিন দিনের উত্থান-পতন, নাটকীয়তা—সবই এখন অতীত। সেই অতীতের ওপর দাঁড়ানো যে বর্তমান, সেটিই আজ ঢাকা টেস্টের চতুর্থ দিনটিকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে ধাঁধার মতো ওই প্রশ্নের সামনে। কোনটি বেশি কঠিন—১৫৬ রান, না ৮ উইকেট?
যেটির উত্তর খোঁজার সময় মাঠের মাঝখানের ওই ২২ গজি জমিনটা অবশ্যই বিবেচনায় আসবে, তা প্রথম তিন দিন ব্যাটসম্যানদের ‘ঘূর্ণি-নাচন’ নাচানো মিরপুরের উইকেট এখন কী বলছে?
তৃতীয় দিনের খেলা শেষে সংবাদ সম্মেলনে দুই দলের প্রতিনিধি হয়ে এলেন প্যাট কামিন্স ও তামিম ইকবাল। যাঁদের কথা শুনে মনে হলো, এখানেও একটা ‘খেলা’ চলছে। সেই খেলার একটা নামও আছে-‘মাইন্ড গেম’! প্যাট কামিন্স দাবি করলেন, উইকেট আগের চেয়ে অনেক ভদ্রস্থ আচরণ করছে। প্রথম দিনের তুলনায় তো অনেক ভালো। কী বার্তা দিতে চাইলেন, তা অনুমান করা একদমই কঠিন নয়। ভাইসব, ২৬৫ রানের লক্ষ্য আপনারা যতটা কঠিন ভাবছেন, অতটা কঠিন নয়। এটা হয়ে যাবে।
তামিম ইকবাল মোটেই একমত নন। যতবার উইকেটের প্রসঙ্গ উঠল, প্রশ্ন হলো ম্যাচের ভবিষ্যৎ নিয়ে, প্রতিবারই মনে করিয়ে দিলেন, এটা অননুমেয় এক উইকেট। কখন কী হবে, কিচ্ছু বলা যায় না। এখানে একটা উইকেট পড়া মানেই আরও ২-৩টি পড়ার পথ খুলে যাওয়া।
কামিন্সের কথা বিশ্বাস করবেন, নাকি তামিমের? সাধারণ ক্রিকেটীয় জ্ঞান বলে, যত সময় যাবে, স্পিনিং উইকেট ব্যাটিংয়ের জন্য ততই কঠিন হবে।
আবার কাল শেষ বিকেলে ডেভিড ওয়ার্নারের ব্যাটিংটা মনে করুন। কামিন্সের কথাটাকে কি এখন আর শুধুই একটা ‘চাল’ বলে মনে হচ্ছে?
টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান থেকে ডেভিড ওয়ার্নারের টেস্ট ব্যাটসম্যানে উত্তরণ সাম্প্রতিক ক্রিকেটের সবচেয়ে চমকপ্রদ গল্পগুলোর একটি। ব্যাটিংয়ের স্টাইল অবশ্য বদলাননি। টেস্টের প্রথম দিনেই লাঞ্চের আগে সেঞ্চুরি পর্যন্ত আছে। তবে তাঁর ১৮টি টেস্ট সেঞ্চুরির একটিও উপমহাদেশে নয়। স্পিন বোলিংটা পছন্দ করেন, এমন কথাও কখনো শোনা যায়নি। বছরের শুরুতে ভারত সফরে অশ্বিন আর জাদেজার স্পিন-বিষে নীল হয়ে গেছেন। সেই ওয়ার্নারই উপমহাদেশে তাঁর সর্বোচ্চ ইনিংসটি খেলে ফেললেন কাল। সেটি ওয়ার্নারের ঢঙেই। ইংল্যান্ড সিরিজের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বোলিং ওপেন করলেন মিরাজ। প্রথম ওভারেই দুই চারে তাঁকে স্বাগত জানালেন ওয়ার্নার। অপরাজিত ৭৫ রান মাত্র ৯৬ বলে, যাতে ১১টি চারের সঙ্গে একটি ছক্কা।
সাকিবের প্রথম ওভারেই স্লিপে সৌম্য ক্যাচটা নিতে পারলে অবশ্য উপমহাদেশে ওয়ার্নারের আরেকটি ব্যর্থতার গল্পই লেখা হতো। তাঁর রান তখন মাত্র ১৪। ক্রিকেটে ‘যদি’র কোনো জায়গা নেই। কিন্তু সব সময় কি তা মানা যায়! এখানেই যেমন ওয়ার্নারের দ্বিতীয় ‘জীবন’ পাওয়ার মতো স্টিভ স্মিথের স্টাম্পিং হতে হতে বেঁচে যাওয়াটাও আসবে। প্রথম ইনিংসে মুশফিকের পরামর্শমতো রাউন্ড দ্য উইকেট বোলিং করে স্মিথকে ফাঁদে ফেলেছিলেন মিরাজ। কাল তো এই রণকৌশল প্রথম বলেই স্মিথকে ফিরিয়ে দিয়েছিল প্রায়। মাঠের আম্পায়ার স্টাম্পিংয়ের সিদ্ধান্ত দিতে টিভি আম্পায়ারের শরণাপন্ন আর ব্যাটসম্যান ড্রেসিংরুমের দিকে হাঁটতে শুরু করেছেন-- এই দৃশ্য একটু বিরলই বলতে হবে। ড্রেসিংরুম থেকে ইঙ্গিত পেয়ে থামলেন স্মিথ। টিভি রিপ্লেতে দেখা গেল, চুল পরিমাণ ভেতরে আছে তাঁর পা।
বাংলাদেশের এই দুই আক্ষেপ মিলিয়ে যা হলো-- উইকেটে এখনো অস্ট্রেলিয়ার সেরা দুই ব্যাটসম্যান। আজ প্রথম ঘণ্টায় যাঁদের অন্তত একজনকে ফিরিয়ে দিতে না পারলে টেস্ট নিশ্চিতভাবেই হেলে পড়বে অস্ট্রেলিয়ার দিকে। এমনিতে ইতিহাস বলে, অস্ট্রেলিয়ার কাজটা খুব কঠিন। এই টেস্টের প্রথম তিন ইনিংসের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার প্রথম ইনিংসটাই সবচেয়ে কম রানের। জিততে হলে চতুর্থ ইনিংসে করতে হবে ম্যাচের সর্বোচ্চ রান। টেস্ট ক্রিকেটে এমন কিছু এর আগে কখনো ঘটেনি।
উপমহাদেশে দুই শর বেশি রান তাড়া করেও এর আগে একবারই জিতেছে অস্ট্রেলিয়া। সেটি এই বাংলাদেশের বিপক্ষেই ১১ বছর আগের সেই ফতুল্লা টেস্টে। রিকি পন্টিংয়ের ক্যাপ্টেনস নকে ৩০৭ রানও যেখানে ব্যাপার হয়নি। বাংলাদেশের দ্বিতীয় ইনিংসের মাঝামাঝি মনে হচ্ছিল, এখানেও জিততে হলে অস্ট্রেলিয়াকে তিন শর বেশিই করতে হবে। মাত্র ৩৫ রানে শেষ ৫ উইকেট পড়ে যাওয়ায় যে আশার জলাঞ্জলি।
আফসোস এখানেও আছে। মুশফিক আর সাব্বিরের মাত্রই জমে ওঠা জুটিটা ভেঙে দিল ক্রিকেটের সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক আউট। লায়নের বলে দুর্দান্ত এক স্ট্রেট ড্রাইভ করেছিলেন সাব্বির। রবি শাস্ত্রী ধারাভাষ্যে থাকলে নির্ঘাত বলতেন, ‘লাইক আ ট্রেসার বুলেট।’ কিন্তু স্ট্রেট ড্রাইভটা বড় বেশি ‘স্ট্রেট’ হয়ে গেল! লায়নের হাতের ছোঁয়া নিয়ে বল নন-স্ট্রাইকার প্রান্তের উইকেট ভেঙে দিল, মুশফিক তখন ক্রিজের একটু বাইরে দাঁড়িয়ে। নড়ারও সময় পাননি।
মুশফিকের দুর্ভাগ্যের জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী সাব্বিরও নিজেকে দুর্ভাগা ভাবতে পারেন। প্রথম ইনিংসে তাঁর ‘ভুল’ রিভিউ নেওয়া নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপও হয়েছে। তাই হয়তো এবার আর আম্পায়ারের তর্জনীকে চ্যালেঞ্জ করার সাহস পাননি। অথচ শর্ট লেগের হাতে যাওয়ার আগে বল না তাঁর ব্যাটে লেগেছে, না তাঁর গ্লাভসে।
উইকেট নিয়ে কামিন্স আর তামিমের দুই রকম কথা দিয়ে লেখাটা শুরু হয়েছিল। শেষে এসে মনে হচ্ছে, এই উইকেট নিয়ে তামিমের কথারই তো বেশি গুরুত্ব পাওয়া উচিত। তাঁর চেয়ে বেশি সময় তো আর কেউ কাটাননি ওখানে। উইকেটের খামখেয়ালিপনার পরিচয়ও দুই ইনিংসেই পেয়েছেন। গুড লেংথ থেকে হঠাৎ লাফিয়ে ওঠা কামিন্সের যে বলটিতে কাল আউট হলেন, সেটিতে কী-ইবা করার ছিল তামিমের। প্রথম ইনিংসে ৭১ রানের পর দ্বিতীয় ইনিংসে ৭৮। দুই ইনিংসেই সেঞ্চুরি হারানোর যন্ত্রণায় প্রলেপ পড়ার পথ এখন একটাই। জয়!