হ্যাটট্রিকের ইতিহাসে অলক কাপালি
উৎপল শুভ্র
২৯ আগস্ট ২০২১
পেশোয়ার টেস্টের তৃতীয় দিনের অর্ধেক পর্যন্ত অদৃশ্য হয়ে থাকা অলক কাপালিই হয়ে গিয়েছিলেন তৃতীয় দিন শেষে বাংলাদেশের নায়ক। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর আগে হ্যাটট্রিক করেছিলেন ২৮ জন, কিন্তু বাংলাদেশের হয়ে তিনিই তো প্রথম!
প্রথম প্রকাশ: ৩০ আগস্ট ২০০৩। প্রথম আলো।
পেশোয়ার টেস্টের পৌনে তিন দিন চলে যাওয়ার পরও তিনি ছিলেন একেবারেই অদৃশ্য। প্রথম ইনিংসে ৪ রান, লাঞ্চের আগে ১ ওভারে ৩ রান দিয়ে কোনো উইকেট নেই— এই ম্যাচের পার্শ্বচরিত্রগুলোর মধ্যেও ছিলেন না অলক কাপালি। ১০ মিনিট, মাত্রই ১০ মিনিট পর এই টেস্টের সবটুকু আলো গিয়ে পড়ল তাঁর ওপর। তাঁকে ঘিরেই শুরু হলো উৎসব। হ্যাটট্রিক করে ফেলেছেন অলক কাপালি!
টেস্ট ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম হ্যাটট্রিক। শুধু টেস্ট ক্রিকেটই নয়, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেই বাংলাদেশের পক্ষে প্রথম। কালকের আগ পর্যন্ত ১২৭ বছরের টেস্ট ইতিহাসে মাত্র ২৮ জন বোলারের ছিল পরপর তিন বলে উইকেট নেওয়ার এই কৃতিত্ব। হিউ ট্রাম্বল, টি জে ম্যাথুজ আর ওয়াসিম আকরাম নিয়েছেন দুবার করে। এ কারণেই হ্যাটট্রিকের তালিকায় ২৮ জনের নাম থাকলেও হ্যাটট্রিকের সংখ্যা ছিল ৩১টি। ২৯তম বোলার হিসেবে অলক কাপালি করলেন টেস্ট ক্রিকেটের ৩২তম হ্যাটট্রিকটি।
লাঞ্চের পর দেড় ঘণ্টার দ্বিতীয় সেশনে দু'প্রান্ত থেকে টানা বল করে গেছেন মোহাম্মদ রফিক আর খালেদ মাহমুদ। চা-বিরতির পরও এক প্রান্তে রফিক থাকলেন, অন্য প্রান্ত থেকে এলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা। ৭ উইকেট পড়ে গেছে পাকিস্তানের, ইউসুফ ইয়োহানাকে সঙ্গ দিতে আছেন শুধু বোলাররা। মাশরাফি ৪ ওভার করার পর কী ভেবে তাঁর জায়গায় অলককে ডাকলেন অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ। ক্রিকেটীয় বিবেচনা থেকেই তাঁর এই সিদ্ধান্ত, তবে খালেদ মাহমুদও নিশ্চয়ই কল্পনা করেননি, তাঁর এই সিদ্ধান্তই নতুন এক অধ্যায় যোগ করবে বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে।
অলকের সেই ওভারের পঞ্চম বলে শাব্বির আহমেদ ড্রাইভ করতে গিয়ে ক্যাচ দিলেন মিড অফে। পরের বলে কোনো শট না খেলে এলবিডব্লু দানিশ কানেরিয়া। ওভার শেষ, দম বন্ধ করে রফিকের পরের ওভারটি দেখলেন অলক। শেষ বলে অনেক চেষ্টা করেও সিঙ্গেল নিতে পারলেন না ইউসুফ ইয়োহানা। স্ট্রাইকে থাকলেন শেষ ব্যাটসম্যান উমর গুলই। অলকের বলটি তাঁর প্যাডে লাগতেই বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের সমস্বরে আবেদন। আম্পায়ার রাসেল টিফিন আঙুল তুলে দিতেই অলককে ঘিরে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের উৎসব।
হ্যাটট্রিক-বলটি করার আগে অলক কী ভাবছিলেন, হ্যাটট্রিক করার পরই বা তাঁর অনুভূতি কী, কিছুই জানা গেল না, তা রইল বাংলাদেশ দলের মধ্যেই। এই সিরিজে প্রতিদিনই সংবাদ সম্মেলনে আসছেন দিনের সেরা পারফরমার। কাল আসার কথা ছিল অলকেরও। দিনের খেলা শেষে সাংবাদিকরা অপেক্ষাও করছিলেন তাঁর জন্য। কিন্তু কোচ ডেভ হোয়াটমোর পিসিবির মিডিয়া ম্যানেজারকে জানিয়ে দিলেন, অলক আসবেন না।
টেস্ট ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো প্রথম ইনিংসে লিড নেওয়ার আনন্দ অনেকটাই মুছে গেছে দিনের শেষ ১৮.৪ ওভারে। লিডটাকে ১১৮ পর্যন্ত বাড়াতেই দ্বিতীয় ইনিংসের ৪ উইকেট হারিয়ে ফেলেছে বাংলাদেশ। বোলিংয়ের পর এখন ব্যাটিংয়েও বাংলাদেশ দল অলক কাপালির ব্যাটের দিকে প্রত্যাশাভরে তাকিয়ে। ৪ রানে অপরাজিত তিনি, সঙ্গী রাজিন সালেহর রান ৫। এটিই শেষ স্বীকৃত ব্যাটিং জুটি। অলকের মনোসংযোগে চিড় ধরতে পারে, এমন সামান্যতম ঝুঁকিও নিতে রাজি হননি ডেভ হোয়াটমোর। তাঁকে সংবাদ সম্মেলনে আসতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তও এ কারণেই।
লেগ স্পিনার হিসেবেই ক্যারিয়ার শুরু করার পর আস্তে আস্তে ব্যাটসম্যান পরিচয়টাই প্রধান হয়ে উঠেছে অলক কাপালির। এই টেস্টের আগে ১০ টেস্টে ১৬০.৪ ওভার বোলিং করে তাঁর মাত্র ৩ উইকেট। পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসে সেই অলক কাপালির বোলিং বিশ্লেষণ: ২.১-১-৩-৩। হ্যাটট্রিক এনে দেওয়া স্পেলটি আরও অসাধারণ: ১.১-১-০-৩!
বাংলাদেশ দলে ঢোকার পর থেকেই তাঁর সামর্থ্য সম্পর্কে সবাইকে নতুন ধারণা দিতে শুরু করেছিলেন অলক। বাংলাদেশের ক্রিকেটে মহসিন কামাল আর আলী জিয়া জুটির এই একটিই অবদান— অলক কাপালিকে চিনেছিলেন তাঁরা। অলকও নতুন করে চিনিয়েছেন তাঁকে, কালকের আগ পর্যন্ত মূলত তাঁর ব্যাট দিয়েই।
কে জানে ,এই হ্যাটট্রিকই হয়তো বদলে দেবে লেগ স্পিনার অলককেও। আগামী দিনগুলোতে শুধু তাঁর ব্যাটিং কীর্তি নয়, বারবার লিখতে হবে তাঁর বোলিং সাফল্যের কথাও।