হাবিবুলের সেঞ্চুরি, হাবিবুলের বার্তা
উৎপল শুভ্র
১৭ আগস্ট ২০২১
এর আগেই টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি পেয়ে গিয়েছিলেন, তবে সেই দুটিকে ছাপিয়ে হাবিবুল বাশারের সেরা ইনিংস সম্ভবত এই তৃতীয় সেঞ্চুরিটাই। ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সেন্ট লুসিয়ায় স্ট্রোক প্লের ছটায় উজ্জ্বল যে ইনিংস মন কেড়েছিল ব্রায়ান লারারও। আর দিয়েছিল একটা বার্তা, বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাও শর্ট বল খেলতে জানে।
প্রথম প্রকাশ: ২৯ মে ২০০৪। প্রথম আলো।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ চারজন ফাস্ট বোলার নিয়ে নামছে শুনেই হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল তাঁর মুখ। তারপর আনমনা ভঙ্গিতে বললেন, 'ওরা অনেক শর্ট বল করবে।' হাসির সঙ্গে বেমানান মনে হচ্ছে কথাটা?
মনে হলেও কিছু করার নেই। হাবিবুল বাশার যে হাসিমুখেই বললেন কথাটা। শরীর লক্ষ্য করে বাউন্সারের মিছিল ধেয়ে আসবে জানার পর যেকোনো ব্যাটসম্যানেরই যেখানে একটু দুশ্চিন্তায় পড়ার কথা, তা জানার পর হাবিবুল বরং খুশি। শর্ট বল বা বাউন্সারের যে একটাই অর্থ তাঁর কাছে, রান করার সুযোগ।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের চার ফাস্ট বোলারকেও তা জানিয়ে দিলেন হাবিবুল। গতকাল সেন্ট লুসিয়া টেস্টের প্রথম দিন যে ইনিংসটি খেললেন, সেটি শুধুই একটি টেস্ট ইনিংস নয়, তার চেয়েও অনেক বড় কিছু। ব্যাট দিয়ে ছড়িয়ে দেওয়া একটা বার্তাও। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা বাউন্সারের জবাব দিতে জানে...এই বার্তা।
পুল শটটি নিয়ে কম কথা শুনতে হয়নি হাবিবুলকে। সেই অভিষেক টেস্টের দুই ইনিংস থেকে শুরু, এরপর যখনই পুল করতে গিয়ে আউট হয়েছেন, সমালোচকদের জিভ ধারালো হয়ে উঠেছে তখনই। তারপরও পুল শটটা বিসর্জন দেওয়ার কথা বিবেচনাতেই নেননি কখনো। বরং আস্থা রেখেছেন নিজের বিশ্বাসেই, 'আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বোলাররা ওপরে বল দেয় খুব কম। রান করতে হলে উইকেটের আড়াআড়ি শট খেলতেই হবে।'
কাল সেন্ট লুসিয়ায় শুধু উইকেটের আড়াআড়িই নয়, হাবিবুল শট খেললেন সব দিকেই। ম্যাচের প্রথম বলেই হান্নান সরকার ফিরে আসায় একরকম ওপেনই করতে হয়েছে তাঁকে। ইনিংসের শুরুতে একটু এলোমেলো ব্যাট চালান বলে হাবিবুল ব্যাট করতে নামার পর প্রথম কিছুক্ষণ একটু বাড়তি টেনশন থাকে বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে। কাল ব্যতিক্রম, শুরু থেকেই হাবিবুল বুঝিয়ে দিলেন এটি তাঁরই দিন। প্রথম বলেই কলিন্সকে ফ্লিক করে ৩ রান। এরপর পুল, কাট, ড্রাইভের এমন বন্যা বইয়ে দিলেন যে, তাঁর সেরা শট বেছে নেওয়াটা হয়ে দাঁড়াল প্রায় অসম্ভব। লসনের বলে মারা স্কয়ার কাটটিকে যখন সেরা মনে হচ্ছে, একটু পরই কলিন্সকে মারা কাভার ড্রাইভটি দাবি করছে সেই স্বীকৃতি। মাত্র ৬৯ বলে তাঁর ফিফটি, যাতে পাঁচটি চার।
মাত্র ১১৬ বলে ১০০, ১৩টি বাউন্ডারি-- এ এমনই এক সেঞ্চুরি, যা দেখে তালি দিতে বাধ্য ব্রায়ান লারাও।
সাতটি দেশের বিপক্ষেই তাঁর ফিফটি আছে, বাদ ছিল শুধু শ্রীলঙ্কা আর এই ওয়েস্ট ইন্ডিজই। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও তা হয়ে যাওয়ার পর আরও দুর্বার হাবিবুলের ব্যাট। মাত্র ৪৭ বলে এলো দ্বিতীয় ফিফটি, যার ৩২-ই (আটটি চার) বাউন্ডারি থেকে। দুটি সেঞ্চুরিই নেই বাংলাদেশের আর কোনো ব্যাটসম্যানের, হাবিবুলের হয়ে গেল তিনটি। জিম্বাবুয়ে আর পাকিস্তানের বিপক্ষে আগের দুটিকে ছাড়িয়ে এটিই হাবিবুলের সেরা টেস্ট সেঞ্চুরি...এই সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে একদমই ভাবতে হচ্ছে না।
মাত্র ১১৬ বলে ১০০, ১৩টি বাউন্ডারি; এ এমনই এক সেঞ্চুরি, যা দেখে তালি দিতে বাধ্য ব্রায়ান লারাও। ৯৯ থেকে সিঙ্গেল নিয়ে সেঞ্চুরি ছোঁয়ার পর হাবিবুলের হাসিতে যখন আলো হয়ে উঠেছে মাঠ, নিয়ম ভেঙে প্রেসবক্স মুখরিত হয়ে উঠেছে করতালিতে, স্লিপে দাঁড়ানো ব্রায়ান লারাও যোগ দিলেন হাবিবুল-বন্দনায়। মাথার ওপর দু'হাত তুলে করতালি দিয়ে জানালেন, 'ইনিংসটি আমার পছন্দ হয়েছে।'
বাংলাদেশ টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর থেকে হাবিবুল বাশার রান করবেন, এটি যেমন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে, হাবিবুল তিন নম্বরে ব্যাট করেন বলে একই রকম নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে দ্বিতীয় উইকেট জুটির আলাদা হয়ে থাকা। কালও তা থাকল। শূন্য রানে প্রথম উইকেট হারানোর পর জাভেদ ওমর আর হাবিবুল বাশারের দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ১২১ রান।
হাবিবুলের রান করাটা নিয়ম, নিয়ম বাংলাদেশের দ্বিতীয় উইকেট জুটিটির আলাদা হয়ে থাকা, এই দুই নিয়মের সঙ্গে যোগ হলো তৃতীয়টি। হাবিবুল বাশার এমনভাবে আউট হলেন যে, তাঁর সব ভালো ইনিংসের মতো এটিরও সঙ্গী হয়ে থাকল আক্ষেপ। তাঁর পুলপ্রীতি দেখে স্কয়ার লেগ ফিল্ডারকে পেছনে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তারপরও লসনকে পুল করার লোভ সামলাতে পারলেন না হাবিবুল। সেই পুল ঠিকই খুঁজে নিল ডোয়াইন স্মিথকে।
ডিপ স্কয়ার লেগে ফিল্ডার দেখার পর পুল না করলেই পারতেন হাবিবুল। লাইনটি লেখার পরই অপরাধী লাগছে। ১১৩ রানের যে ইনিংসটি খেলেছেন, তাতে হাবিবুল বাশারের সমালোচনা করাটা পাপের পর্যায়েই পড়ে।