তিন ম্যাচ শেষে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ৩-০
বাঘের গর্জন আবারও শুনেছে বিশ্ব
উৎপল শুভ্র
৭ আগস্ট ২০২১
কার্ডিফের এক যুগ পর টেস্টে জয় আছে, আছে অনেকগুলো পরাজয়, তারপরও অস্ট্রেলিয়া বললেই কেন যেন কার্ডিফ-রূপকথাতেই ফিরে যেত মন। এত দিনে কার্ডিফকে সরিয়ে এখন সেখানে মিরপুর। কার্ডিফে জয়ের শিরোনাম যদি হয় `বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব`, এবার তো সেই গর্জনে বিশ্ব রীতিমতো প্রকম্পিত।
এক যুগ কেটেছে কার্ডিফের স্মৃতিচারণা করে। নাকি এক যুগেরও বেশি? ২০১৭ সালে মিরপুরে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জিতেছে বাংলাদেশ, কিন্তু অস্ট্রেলিয়া-বধের কথা উঠলেই মন কি চলে যেত না ২০০৫ সালের জুনের কার্ডিফে! টেস্ট জয়টা তো চলে যেত একটু আড়ালেই। তা কি কার্ডিফের মাহাত্ম্যের কারণেই?
হয়তো বা। কার্ডিফে যখন বাংলাদেশ অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়েছিল, তখন বাংলাদেশ তো বাংলাদেশ, বিশ্বের বাকি সব দেশের কাছেই অস্ট্রেলিয়াকে হারানোটা পরম আরাধ্য এক স্বপ্ন। তা পূরণ হবে না জেনেই প্রতিপক্ষ তখন খেলতে নামে। আর বাংলাদেশ খেলতে নামে হারবে ধরে নিয়েই। কার্ডিফ তাই বাস্তব হয়েও যেন এক রূপকথা। অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট জয়টা তা নয়। দশ মাস আগে মিরপুরেই ইংল্যান্ডকে হারানোটাও যার একটা বড় কারণ। ইংল্যান্ডকে যখন হারিয়েছি, অস্ট্রেলিয়াকেও হারাতেই পারি। যে কারণে টেস্ট জয়ের পরও অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সুখস্মৃতি মানেই যেন কার্ডিফ। যে কার্ডিফ-কাব্যের পর প্রথম আলোর সেই অমর শিরোনাম: বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব।
ষোল বছর পর সেই শিরোনামটাই আবার ব্যবহার করতে ইচ্ছা করছে। বাঘের গর্জন এভাবে আর কবে শুনেছে বিশ্ব! বাংলাদেশের ক্রিকেটে স্মরণীয় সব সাফল্যের তালিকা করতে বসলে বারবার ফিরে ফিরে আসে অবিস্মরণীয় সেই ২০১৫। পাকিস্তানকে দিয়ে শুরু, এরপর ভারত আর দক্ষিণ আফ্রিকাকেও হারিয়ে ওয়ানডে সিরিজ জয়ের হ্যাটট্রিক। তিন পরাশক্তির বিপক্ষে টানা তিন জয়কে একসঙ্গে দেখলে ওটাই হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্মরণীয়তম অধ্যায়। কিন্তু ওই তিনটা সিরিজকে আলাদা করে নিয়ে বিচার করলে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টানা তিন জয়ে টি-টোয়েন্টি সিরিজের শেষ দুটি ম্যাচকে ‘অর্থহীন’ বানিয়ে ফেলা যে ছাড়িয়ে যেতে চায় ওসবকেও।
হ্যাঁ, টি-টোয়েন্টিতে অস্ট্রেলিয়ার সাম্প্রতিক ফর্ম ভালো নয়। বাংলাদেশে আসার আগে সর্বশেষ চারটি সিরিজেই যাদের পরাজয়ে নত শির হয়ে মাঠ ছাড়তে হয়েছে।
হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়া দলে তারকা ব্যাটসম্যানদের কেউই দলে নেই। যাঁরা নেই, সেই ওয়ার্নার-ফিঞ্চ-স্মিথ-ম্যাক্সওয়েলরা একাই একটা ম্যাচ জিতিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
তা বাংলাদেশ দলেও তো তামিম নেই, মুশফিক নেই, লিটন নেই...তার ওপর টি-টোয়েন্টিতে বাংলাদেশ বরাবর শেষ বেঞ্চের ছাত্র। সেই বাংলাদেশ পরপর তিন ম্যাচে অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে দেবে, সিরিজ শুরুর আগে এ কথা বললে আপনি নির্ঘাত সেটিকে রসিকতা বলে ধরে নিতেন। সেই জয়ও কী অবিশ্বাস্য সব পারফরম্যান্সে। অস্ট্রেলিয়াকে হতচকিত করে। রেকর্ডের পর রেকর্ড ভেঙে।
রেকর্ডগুলোও কী অদ্ভুত। প্রথম ম্যাচে ১৩১ রান করেও জয়ের পর সবচেয়ে কম রান ডিফেন্ড করের বাংলাদেশের জয়ের যে রেকর্ড, মাঝখানে এক ম্যাচ পরই সেটি ভেঙে দিলেন বাংলাদেশের বোলাররা। অভিষেকেই নাথান এলিসের হ্যাটট্রিকে শেষ তিন বলে তিন উইকেট হারিয়ে তৃতীয় ম্যাচে তো পুঁজি মাত্র ১২৭ রান। কোনোমতে পুরো ২০ ওভার খেললেই যা হয়ে যাওয়ার কথা। তা ২০ ওভার তো ঠিকই খেলল অস্ট্রেলিয়া। কে কবে কল্পনা করেছিল, ২০ ওভার খেলেও অস্ট্রেলিয়া ১১৭ রানের বেশি করতে পারবে না। এর চেয়েও অকল্পনীয় তো এটা যে, অস্ট্রেলিয়ার এই ১১৭ রানেই থেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটবে হাতে ৬ উইকেট হাতে রেখে!
বাংলাদেশের নবীন এক বাঁহাতি স্পিনার পাওয়ার প্লেতে মেডেন ওভার করবেন, এক বাঁহাতি পেসার ইনিংসের ১৯তম ওভারে এসে দেবেন মাত্র ১ রান। আরেক বাঁহাতি পেসার ক্যাচ ফেলে দেওয়ার প্রায়শ্চিত্ত করবেন দুই উইকেট নিয়ে। কিছুক্ষণ আগে সিরিজের সেরা অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানের অকারণে গালি দেওয়ার প্রতিশোধ নেবেন তাঁকে আউট করার পর উন্মাতাল উদযাপনে। লিখতে লিখতে যতবার দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে উঠছে, ততবারই মনে হচ্ছে, না, এমন কিছু এর আগে কখনো দেখিনি।
একটা-দুটি ম্যাচে সাফল্য বাংলাদেশ আগেও পেয়েছে। ২০১০ সালে সেই বিখ্যাত বাংলাওয়াশে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা চার ম্যাচেও। কিন্তু সাম্প্রতিক ফর্ম যা-ই হোক, অস্ট্রেলিয়া হলো অস্ট্রেলিয়া। প্রথম ম্যাচে পরাজয়ই যাদের অহমে লেগেছে, দ্বিতীয় ম্যাচের পর তো তারা রক্তাক্ত। তৃতীয় ম্যাচে তো তাদের সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা।
তা তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছেও। কিন্তু মিরপুরে টানা তিন ম্যাচে যা হলো, তা তো শুধু মানসিক শক্তির পরীক্ষা নয়, স্কিলের পরীক্ষাও। সেই পরীক্ষাতেই কিনা অস্ট্রেলিয়াকে নাকানি চুবানি খাইয়ে ছাড়ল বাংলাদেশ! নবীন যে বাঁহাতি স্পিনারের কথা বলছিলাম, সেই নাসুম আহমেদ প্রথম ম্যাচে ৪ উইকেট নিয়ে ম্যাচ-সেরা। সেদিন সৌভাগ্য তাঁকে দুটি উইকেট এনে দিয়েছিল, এদিন দুর্ভাগ্য তাঁকে আরও দুটি উইকেট থেকে বঞ্চিত করল। তারপরও তাঁর একটি মাত্র উইকেট তো ৪ ওভারে মাত্র ১৯ রান দিয়ে।
যে দুই পেস বোলারের কথা বলছিলাম, তাঁদের একজন টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বসেরা বোলারদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় অবশ্যই থাকবেন। নামটা বলার প্রয়োজন দেখছি না। টি-টোয়েন্টিতে ৪ ওভারে ৯ রান দেওয়াই কোনো বোলারের মাহাত্ম্য বোঝাতে যথেষ্ট। এখানে সেটাও মোস্তাফিজুর রহমানের (এই যা, নামটা বলেই ফেললাম) বোলিং পুরোপুরি বোঝাতে পারছে না। এই জিনিস নিজের চোখে দেখতে হয়। বোলারকে মারতে গিয়েও ব্যাটসম্যান তা পারছেন না, এই দৃশ্য ক্রিকেটে এমন বিরল কিছু নয়। তবে সেটি তো হয় মূলত তুমুল গতিতে পরাস্ত হয়ে বা সুইংয়ে নাকাল হয়ে; গতির এমন চতুর হেরফেরে ব্যাটসম্যানের বলের পর বল বোকা বনে যাওয়া দেখতে এই ম্যাচে মোস্তাফিজুরের ২৪টা বল দেখতে হবে। দেখতে দেখতে মুগ্ধতা বাড়বে এবং তা আবার দেখতে ইচ্ছা করবে।
সবচেয়ে যা আশ্চর্যের, তা হলো, প্রথম দুই ম্যাচে মোস্তাফিজে হাবুডুবু খাওয়ার পরও অস্ট্রেলিয়ানদের তাঁর রহস্য ভেদ করতে না পারা। প্রথম দুটি ম্যাচ না হয় ছিল পরপর দুদিন, কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ম্যাচের মাঝখানে তো পুরো একটা দিন। লিখতে লিখতেই মনে হচ্ছে, ল্যাপটপে যত সফটওয়্যারই থাকুক, ভিডিও কাটাছেঁড়া করে হাজারো বিশ্লেষণ, শেষ পর্যন্ত নির্ভেজাল প্রতিভা ঠিকই সে সবকে বুড়ো আঙুল দেখাতে সক্ষম। তৃতীয় ম্যাচের মোস্তাফিজ তাই প্রথম দুই ম্যাচের চেয়েও বেশি উজ্জ্বল। একটা উইকেটও নেননি, তাতে কি! উইকেট দিয়ে কী হয়, অস্ট্রেলিয়ার তো শেষ পর্যন্ত ৬ উইকেট হাতে ছিল, তা ভাজা করে খাক্! হাফ সেঞ্চুরির সঙ্গে অধিনায়কত্ব যোগ হওয়াতেই সম্ভবত মাহমুদউল্লাহর হাতে ম্যাচ-সেরার স্বীকৃতি, নইলে এই ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের নায়ক তো আসলে মোস্তাফিজই। মোস্তাফিজ না থাকলে ১২৭ রানই অস্ট্রেলিয়ার সামনে এমন দুর্লঙ্ঘ্য পাহাড় হয়ে যায় না।
আরেক যে বাঁহাতি পেসারের কথা বলছিলাম, সেই শরিফুলও মনে হয় মোস্তাফিজের কিছু টোটকা কাজে লাগাচ্ছেন। দু'একটা বলে তাঁকেও তো দেখলাম ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ডুবিয়ে দিতে। সবচেয়ে ভালো লাগল ফাস্ট বোলারসুলভ ওই মেজাজটা। মিচেল মার্শকে আউট করার পর তাঁর ওই 'এবার তুই যা' মার্কা উদযাপন ম্যাচ রেফারির চোখে আপত্তিকর মনে হতেই পারে, তবে আমার কাছে তা এই লেখার শুরুতে বলা ওই শিরোনাম।
বাঘের গর্জন শুনেছে বিশ্ব!