উচ্ছ্বসিত মাহমুদউল্লাহর বিপরীত মেরুতে বিধ্বস্ত ওয়েড
উৎপলশুভ্রডটকম
৭ আগস্ট ২০২১
দুই ম্যাচ হাতে রেখেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বাংলাদেশের সিরিজ জয়। সিরিজ জয়ের উচ্ছ্বাসে মাহমুদউল্লাহ ভেসে যাচ্ছেন স্বাভাবিকভাবেই। আর ম্যাথু ওয়েড? অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক শেষ দুই ম্যাচে একটু ঘুরে দাঁড়ানোর লক্ষ্য ছাড়া আর কিই-বা বলবেন!
অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজ খেলতে নামবে বাংলাদেশ, সে সিরিজে থাকবেন না দলের মূল তিন ব্যাটসম্যান এবং দুই ম্যাচ বাকি থাকতেই সিরিজ জেতা হয়ে যাবে তাদের; কার পরিবর্তে কাকে নামালে দলটা আরেকটু লড়তে পারবে ভাবনার বদলে টিম ম্যানেজমেন্টকে ভাবতে হবে, কাকে কাকে বিশ্রাম দেওয়া যায়...এমন স্বপ্নের দিনের সূর্যটা এক সময় না এক সময় উঠতই; তবে এমন অতর্কিতে যে সূর্যকিরণে চতুর্দিক ভাসিয়ে দিয়ে হবে, তা কি কেউ ভাবতে পেরেছিল!
ভাবতে না পারলেও সেটিই এখন বাস্তব। পাঁচ ম্যাচ সিরিজের প্রথম তিনটির পরই ট্রফি দিয়ে দেওয়ার দাবি জানাতে পারে বাংলাদেশ। একটা নতুন রেকর্ডও তো হলো এই জয়েই, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের টানা চারটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচে জয়।
এমন জয়ের পর মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের উল্লাসে ভেসে যাওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক। শূন্যে মুষ্টি ছুড়ে তাঁর উল্লাসের ছবি তো সম্প্রচারকারী ক্যামেরায় ধরা পড়েছে ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে এসেও মাহমুদউল্লাহর প্রতিক্রিয়ায় ভেতরে টগবগিয়ে ফুটতে থাকা উচ্ছ্বাসের বাষ্প, 'আমি খুবই খুশি। আজ আমাদের ছেলেরা যেভাবে লড়াই করেছে, তা অসাধারণ।'
মাহমুদউল্লাহর উচ্ছ্বাস নিশ্চিত করেই বেড়ে গেছে নিজেও সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন বলে। তাঁর অধিনায়কত্ব প্রশংসা পেয়েছে আগের দুই ম্যাচেও, তবে এদিন অবদান রাখলেন ব্যাট হাতেও। ঠিক টি-টোয়েন্টিসুলভ ইনিংস নয়, স্ট্রাইক রেট এক শ'র নিচে; শুরুতে তো টাইমিং খুঁজে পেতেও সমস্যা হচ্ছিল, শট খেলে ফিল্ডারও খুঁজে পেয়েছেন বেশ কয়েকবার; তবে এক প্রান্ত আঁকড়ে রেখে টিকে ছিলেন ঠিকই। পেয়েছেন আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে নিজের পঞ্চম ফিফটি, দলকেও পৌঁছে দিয়েছেন লড়াই করার মতো সংগ্রহে, ম্যাচ-সেরা হিসেবে জুরিরা তাই বেছে নিয়েছেন তাঁকেই।
তবে স্কোরবোর্ডে ১২৭ তুলে কি আসলেই নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলেন মাহমুদউল্লাহ? অধিনায়ক জানান, অভয়বাণী ছড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা সাকিব আল হাসানের ওপরই তুলে দিয়েছিলেন তিনি, ‘মাঠে নামার আগে আমি সাকিবকে কথা বলতে রিকোয়েস্ট করেছিলাম। সাকিব বলেছিল, যা-ই হোক, আমাদের বুক চিতিয়ে লড়তে হবে। শুরুতেই উইকেট নিতে হবে, আস্কিং রেটটা ৮/৯-এ নিয়ে যেতে পারলেই আমাদের জেতার সুযোগ চলে আসবে।’
আর এই উইকেটে ওভারপ্রতি ৮ করে রান তোলা আর এক দিনে এভারেস্ট ডিঙানো যে সমান কথা, তা উইকেট দেখেই বুঝতে পারার কথা। মাহমুদউল্লাহও বলছেন, শুরু থেকেই তাঁরা বুঝেছিলেন, এটা দেড় শ রানের পিচ নয়। স্ট্রাইক রেটের চেয়ে এই উইকেটে টিকে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। এ নিয়ে সাকিবের সঙ্গে ইনিংস সর্বোচ্চ ৪৪ রানের জুটি গড়ার সময় আলাপও করেছিলেন তিনি, 'যখন আমি আর সাকিব ব্যাটিং করছিলাম, আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, আমার কিংবা সাকিবের মধ্যে যেকোনো একজনকে ১৬/১৭ ওভার পর্যন্ত খেলতে হবে। কারণ নতুন ব্যাটসম্যানের জন্য এই উইকেটে খেলা কঠিন বলে যেকোনো একজন সেট ব্যাটসম্যানকে থাকতেই হতো। বল ব্যাটে বেশ ধীরে আসছিল এবং অস্ট্রেলিয়াও আজ কন্ডিশন ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে।’
অস্ট্রেলিয়া যে কাজে লাগিয়েছে, তার প্রমাণ তো পরিসংখ্যানেই। আগের দুই ম্যাচে মাত্র ৩৬ আর ৪২ শতাংশ স্লোয়ার করা অস্ট্রেলিয়ানরা এই ম্যাচে স্লোয়ার বল করেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। অবশ্য বলের গতি কমিয়ে সাফল্য পাওয়ার তরিকাটা বাংলাদেশই জানে ভালো, এবং আগের দু'দিনের মতো সাফল্য এসেছে এদিনও। মাহমুদউল্লাহ তাই বলছেন, ‘আমরা আমাদের পরিকল্পনায় স্থির ছিলাম এবং সেটার ফল পেয়েছি। আমাদের বোলাররা দারুণ করেছে। অনেক কাটার-স্লোয়ার করে কন্ডিশনকে যথাযথভাবে ব্যবহার করেছে।’
কাটার-স্লোয়ার বললে অবশ্য মোস্তাফিজের মুখটাই চোখে ভাসে সবার আগে। অ্যাস্টন অ্যাগার আর ময়েজেস হেনরিকস এর আগেই জানিয়ে গিয়েছেন, মোস্তাফিজকে খেলতে গিয়ে কেমন নাভিশ্বাস উঠছে তাঁদের। আর এদিনের পর তাঁরা কী বলবেন! ৪-০-৯-০ বোলিং বিশ্লেষণ আর ১৯তম ওভারে পাঁচটা ডট দেওয়া কিছুটা বলছে বটে; কিন্তু উইকেটে সেট ব্যাটসম্যান, তা হার্ড হিটারই হোক, একটু দেখে খেলতে চাওয়া ব্যাটসম্যান...কেউই যে মোস্তাফিজের বলগুলো বুঝতে পারলেন না, ড্যান ক্রিস্টিয়ান মনে হলো নাচলেনও...চোখে না দেখলে তা বোঝানো যাবে কেমন করে!
এমন পারফরম্যান্সের পর মোস্তাফিজের প্রশংসা শোনাটা অনুমিতই ছিল। অধিনায়ক তা করলেন নিয়ম মেনেই, ‘মোস্তাফিজ আবারও দারুণ বোলিং করেছে। শরিফুল আর বাকি বোলাররাও ভালো প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিল, আজ মাঠে সেটারই প্রয়োগ ঘটিয়েছে। তবে মোস্তাফিজ ছিল অনবদ্য।'
মাহমুদউল্লাহ যদি এ মুহূর্তে জীবনের উত্তর মেরুতে থাকেন, তো ম্যাথু ওয়েডের অবস্থান নিশ্চিত করেই দক্ষিণ মেরুতে। নিয়মিত অধিনায়ক অ্যারন ফিঞ্চের চোটে নেতৃত্ব পেয়েছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ আর বাংলাদেশ সফরে। আর দুই সফরে এখন পর্যন্ত আট ম্যাচ খেলে জয়ের হাসি হাসতে পেরেছেন মাত্র একবার। আর বাংলাদেশ সফরে এসে তো ব্যাট ধরাটাই যেন ভুলে গেছে তাঁর দল, ১৩০ রান পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি তিন ম্যাচেও। যে কারণে বোলাররা ১২৭ রানে প্রতিপক্ষকে আটকে রাখলেও নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না একটুও, ‘বোলাররা অনেক ভালো করেছে, বেশির ভাগ সময়েই ১২০-১৩০-এর মধ্যে (বাংলাদেশকে) আটকে রেখে তারা আমাদের ম্যাচে রেখেছিল। কিন্তু আমরা ব্যাট হাতে সুযোগটা কাজে লাগাতে পারিনি। এটা হতাশাজনক। লক্ষ্য তাড়া করাটা যে সহজ হবে না, এটা অবশ্য ড্রেসিংরুমেই আমরা বুঝতে পেরেছিলাম।'
কেন সহজ হবে না, ভেবেছিলেন? এর ব্যাখ্যায় বাংলাদেশি বোলারদের ডেথ বোলিং দক্ষতাকেই কারণ হিসেবে দেখালেন ওয়েড। উইকেটের চরিত্রের কারণেই শেষের ওভারগুলোতে রান করা কঠিন, আর ইনিংসের শেষ দিকে বাংলাদেশি বোলারদের ওভারে ৪/৫ রান করে তোলাও তো দুরূহ মনে হচ্ছে তাঁদের।
সিরিজ জেতার আশা তো শেষই হয়ে গেছে, তবে বাকি দুই ম্যাচকে অস্ট্রেলিয়া নিতে চাইছে ঘুরে দাঁড়ানোর মঞ্চ হিসেবে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে অস্ট্রেলিয়া নিজেদের ঝালিয়ে নেওয়ার সর্বশেষ দুটি সুযোগ তো ওই দুটি ম্যাচই। যে কারণে ওয়েডের কণ্ঠে যেন আকুতি, 'আমাদের দ্রুত ঘুরে দাঁড়াতে হবে এবং সিরিজের বাকি ম্যাচগুলোতে মনোযোগ দিতে হবে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলেই এসেছে বলতে গেলে, প্রতিটি ম্যাচই তাই গুরুত্বপূর্ণ।’
কথাগুলো পড়তে গিয়ে একটু কি স্মৃতিকাতরই হয়ে গেলেন! সিরিজের পর সিরিজ বাংলাদেশের অধিনায়কের মুখে এই কথাগুলোই কি শুনতে পেতেন না?