ধ্রুবতারা হতে পারবেন আফিফ?

উৎপল শুভ্র

৫ আগস্ট ২০২১

ধ্রুবতারা হতে পারবেন আফিফ?

ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টিতেই ম্যাচ উইনিং ইনিংস খেলার পথে আফিফ। ছবি: মোহাম্মদ মানিক

আগের সপ্তাহেই আফগানিস্তানের কাছে টেস্টে হেরেছে বাংলাদেশ। হারের শঙ্কা জেগেছিল জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতেও। ১৪৫ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে বাংলাদেশ তো ৬০ রান তুলতেই হারিয়ে ফেলেছিল ৬ উইকেট! সেখান থেকে বাংলাদেশ উদ্ধার পেয়েছিল মাত্র দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নামা আফিফ হোসেন ধ্রুবর ব্যাটে। স্ট্রোকের ছটায় উজ্জ্বল তাঁর সেই ইনিংস দেখে মনে তাই প্রশ্ন জেগেছিল, `ধ্রুবতারা হতে পারবেন আফিফ?`

প্রথম প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯। প্রথম আলো।

তারকার জন্ম এভাবেই হয়! ঘোর অন্ধকারে হঠাৎই আলোকচ্ছটা ছড়িয়ে। হতাশার বাতাবরণ ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা আশার আলোকরশ্মি হয়ে। বৃষ্টিধোয়া এক রাতে যেমন বাংলাদেশের ক্রিকেটাকাশে নতুন তারকা হিসেবে আবির্ভূত হলেন আফিফ হোসেন।

কী এমন করেছেন যে এই বাঁধনহীন উচ্ছ্বাস! তারকা অভিধায় তাঁকে ভূষিত করে ফেলা! শুধু একটা টি-টোয়েন্টি ম্যাচই তো জিতিয়েছেন, তাই না? সেটিও আবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে, বিশ্ব ক্রিকেটের আরেক ‘কেনিয়া’ হওয়ার পথে যাত্রা শুরু করা যে দলের বিপক্ষে জয় অনেক দিনই বাংলাদেশের ক্রিকেটে কোনো অনুরণন তোলে না। সেই জয়ের নায়ককে নিয়ে এমন কাব্যগাথা! না, বাংলাদেশের সাংবাদিকদের বাড়াবাড়ির অভ্যাসটা আর গেল না! এমন কিছু ভেবে থাকলে বুঝতে হবে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের হালহকিকত সম্পর্কে আপনি একেবারেই ওয়াকিবহাল নন।

হয়তো জানেনই না, ঠিক আগের সপ্তাহে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের ক্রিকেটের কৌলীন্য কীভাবে ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। জানলেও সেটির তাৎপর্য ঠিক বুঝে উঠতে পারেননি। বাংলাদেশ হেরেছে, সেটি বড় কথা নয়। খেলায় জয়-পরাজয় থাকেই। তবে সব জয় কি আর সমান! সব পরাজয়ও তা নয়। সব জয়ে সমান গৌরব থাকে না, সব পরাজয়েই উঁকি দেয় না ‘লজ্জা’ শব্দটা। বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভিত্তিমূলকে নাড়িয়ে দেওয়া আফগানিস্তানের বিপক্ষে পরাজয়ে যা শুধু উঁকিই দেয়নি, রীতিমতো আচ্ছন্ন করে ফেলেছে ক্রিকেটাঙ্গনকে। এতটাই যে সেই পরাজয়ের পর ‘প্যাভিলিয়ন’ নামে একটি ওয়েবসাইটে তরুণ এক লেখক অ্যাশেজের অনুকরণে বাংলাদেশের ক্রিকেটের ‘অবিচুয়ারি’-ও লিখে ফেলেছেন। যেটিকে একটুও বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়নি। ১৮৮২ সালে ওভালে যা হয়েছিল, ২০১৯ সালে জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামে তার চেয়ে কম হয়েছে কোথায়? বরং একটু বেশিই তো হয়েছে। ওভালে ৮৫ রানের জয়ের লক্ষ্য তাড়া করতে নামা ইংল্যান্ড ৭৭ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার পর পরদিনের স্পোর্টিং টাইমস পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল ইংলিশ ক্রিকেটের বিখ্যাত সেই মৃত্যুসংবাদ। মাত্র ৭ রানেই তো হেরেছিল ইংল্যান্ড। আর বাংলাদেশ? ২২৪ রানের ব্যবধানও বোঝাতে পারছে না সেই অপমান। জহুর আহমেদে টেস্টের পাঁচ দিনই চলেছে উল্টো রথের খেলা—মনে হয়েছে, আফগানিস্তানই বুঝি টেস্ট পরিবারে বাংলাদেশের চেয়ে ১৯ বছরের বড়! ব্যাটিংয়ে-বোলিংয়ে প্রতিনিয়ত যারা বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের শিখিয়ে গেছে—‘দেখো, টেস্টটা এভাবে খেলতে হয়!’ একটু অপমান তো লাগেই, কী বলেন?

ছবি: মোহাম্মদ মানিক

আরেকটু পিছিয়ে গিয়ে ‘আফগানিস্তান-লজ্জা’র সঙ্গে শ্রীলঙ্কা সফরে ভরাডুবি আর দারুণ শুরুর পর চরম হতাশায় শেষ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপকে যোগ করুন—সাম্প্রতিক অতীতে বাংলাদেশের ক্রিকেটে সর্বশেষ এমন দুঃসময় সেই ২০১৪ সালে। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি জয়টাকে দেখতে হবে এই প্রেক্ষাপটে। তাতেই শুধু পরিষ্কার হবে এটির মহিমা। তুলনা খুঁজতে গিয়ে পিছিয়ে যেতে হচ্ছে প্রায় ১১ বছর। অভিজ্ঞ-তরুণ-উদীয়মান মিলিয়ে বাংলাদেশের ১৪ ক্রিকেটার ‘নিষিদ্ধ’ আইসিএলে যোগ দেওয়ায় বাংলাদেশের ক্রিকেটে নেমে আসা সেই অন্ধকারের কথা মনে আছে না? আইসিএল-উত্তর পরের ম্যাচেই হীনবল বাংলাদেশ দলের নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে দেওয়ার স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই জয়।

নিউজিল্যান্ড তখন বাংলাদেশের কাছে রীতিমতো পরাশক্তি। জিম্বাবুয়ে এখন মোটেই তা নয়। তারপরও এই জয়টা বিশেষ হয়ে উঠছে এটির ধরনের কারণে। ১৪৫ রানের জন্য খেলতে নেমে ৬০ রানে ৬ উইকেট নেই—এই অবস্থায় ব্যাটিং করতে নেমে এখনো বিশ না ছোঁয়া এক তরুণ নিষ্কম্প স্নায়ু আর দুর্দান্ত স্ট্রোক প্লের এক প্রদর্শনীতে ম্যাচ জিতিয়ে দেবেন, এই ঘটনা প্রতিদিন ঘটে না। বাংলাদেশের ক্রিকেটে তো বলতে গেলে কখনোই না। এমন অবস্থা থেকে প্রতিপক্ষ দলের কাউকে ম্যাচ বের করে নিয়ে যেতে অনেকবারই দেখেছে বাংলাদেশ। নিজেরা এই অভাবিত আনন্দের স্বাদ পেয়েছে কমই। ৮ নম্বর ব্যাটসম্যানের ২০০ স্ট্রাইক রেটের এক হাফ সেঞ্চুরিতে কখনো তা পেয়েছে বলেই তো মনে পড়ছে না।

ছবি: শামসুল হক

কোনো কিছুকেই অসম্ভব না ভাবার দুঃসাহস শুধু তারুণ্যেরই অহংকার। আফিফের ব্যাটেও এদিন সেই দুঃসাহস। প্রথম বলটিকেই বোলারের মাথার ওপর দিয়ে তুলে দেওয়া আর ম্যাচের দোদুল্যমান অবস্থায় কাইল জার্ভিসের বলে থার্ডম্যান আর ফাইন লেগ দিয়ে টিপিক্যাল টি-টোয়েন্টি শটে মারা বাউন্ডারিতে যেটির সুন্দরতম বহিঃপ্রকাশ। ভয়ডরহীন ব্যাটিংয়ের মতো আফিফের নিরাবেগ মুখচ্ছবিটাও টেলিভিশন দর্শকদের মনে গেঁথে যাওয়ার কথা। উইকেটে তাঁর সঙ্গে হেঁটে গিয়েছে বছর দেড়েক আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অভিষেক টি-টোয়েন্টিতে দ্বিতীয় বলেই শূন্য রানে আউট হয়ে যাওয়ার স্মৃতি। ভেতরে সেই নার্ভাসনেস না থেকে পারেই না, তবে আফিফকে দেখে তা বোঝার ছিল না। উল্টো সেই ব্যর্থতাকে ‘ব্যতিক্রম’ বলে প্রমাণের প্রতিজ্ঞাই যেন ফুটে বেরোল তাঁর শরীরী ভাষা থেকে। আসলে তো ‘ব্যতিক্রম’ই ছিল। এর আগ পর্যন্ত আফিফের কাছে ‘অভিষেক’ মানেই অবধারিতভাবে সেটি রাঙিয়ে দেওয়া। ২০১৬ সালে বিপিএলে অভিষেকেই তাঁর ৫ উইকেট। পাঁচ শিকারের মধ্যে ছিলেন ক্রিস গেইল নামে জনৈক জ্যামাইকানও। স্বীকৃত টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে কম বয়সে অভিষেকে ৫ উইকেট নেওয়ার সেই কীর্তি এখনো অম্লান। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেকেই সেঞ্চুরি করেছেন, ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে প্রথম মৌসুমেই করেছেন হ্যাটট্রিক।

এই ম্যাচে আট নম্বরে নামলেও আদতে ওপেনার। বাঁহাতি বলে ‘ভবিষ্যতের তামিম ইকবাল’ তকমাও লেগেছে গায়ে। তবে বিকেএসপি ব্যাকগ্রাউন্ড, স্পিনিং অলরাউন্ডার এবং আবেগের ন্যূনতম প্রকাশ মিলিয়ে সাকিব আল হাসানের সঙ্গে বরং আফিফের বেশি মিল খুঁজে পাচ্ছি। একদিন সত্যি সত্যি ‘সাকিব’ হতে পারবেন কি না, এই প্রশ্নের উত্তর ভবিষ্যতের হাতে তোলা। একই সূত্রে গাঁথা আরেকটি প্রশ্নের উত্তরও। আফিফ হোসেনের ডাকনাম ধ্রুব। ধ্রুব কি ধ্রুবতারা হয়ে উঠতে পারবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটাকাশে?

আরও পড়ুুন:

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ম্যাচসেরা আফিফ যা চেয়েছিলেন...

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×