বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি

সিরিজের নাম `মোস্তাফিজ বনাম স্টার্ক`

উৎপল শুভ্র

৩ আগস্ট ২০২১

সিরিজের নাম `মোস্তাফিজ বনাম স্টার্ক`

বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজটাকেও যদি ‘যুদ্ধ’ ধরি, এর মধ্যে অনেক ছোট ছোট লড়াইয়ের দেখা মিলবে। এর মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মনে হচ্ছে যে লড়াইটাকে, সেটির নাম ‘মিচেল স্টার্ক বনাম মোস্তাফিজুর রহমান’।

যদি প্রশ্ন করেন, বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া টি-টোয়েন্টি সিরিজে কী দেখতে আমি উন্মুখ হয়ে আছি, উত্তর হবে মিচেল স্টার্ক ও মোস্তাফিজুর রহমানের বোলিং। দুজনকে মেলানোর বড় কারণ তো অবশ্যই এটা যে, তাঁরা দুজনই বাঁহাতি পেসার। কারণ আরেকটা আছে, দুজনের বোলিংই আপনার মুখ থেকে অস্ফুটে ‘আহা, কী দেখছি’ অভিব্যক্তি বের করে আনতে সক্ষম।  

খেলা নিয়ে ব্রিটিশ সাহিত্যিক জর্জ অরওয়েলের অমর একটা বাণী আছে, ‘খেলা হলো গোলাবারুদহীন যুদ্ধ’। এই বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজটাকেও যদি ‘যুদ্ধ’ ধরি, এর মধ্যে অনেক ছোট ছোট লড়াইয়ের দেখা মিলবে। এর মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মনে হচ্ছে যে লড়াইটাকে, সেটির নাম ‘মিচেল স্টার্ক বনাম মোস্তাফিজুর রহমান’।

এমনিতে বোলার হিসেবে পুরো প্যাকেজটা বিবেচনায় নিলে দুজনের তুলনা করাটাই অন্যায়। টেস্ট রেকর্ডে এসেই যে থমকে যেতে হয়। একজনের ৬১ টেস্টে ২৫৫ উইকেট, আরেকজনের ১৪ টেস্টে ৩০। লাল বলের পৃথিবীতে দুজন যেন দুই মেরুর বাসিন্দা। রেকর্ডে যেমন দুজনের কোনো তুলনা চলে না, তেমনি লাল বলের প্রতি আকর্ষণেও না। 

মিচেল স্টার্ক টেস্ট ম্যাচ খেলতে ভালো বাসেন। অভিষেক টেস্টেই ম্যাচ-সেরার স্বীকৃতি পাওয়া মোস্তাফিজুর রহমানকে কেউ এমন 'অপবাদ’ দিতে পারবে না। স্টার্ক টেস্ট ক্রিকেটে মোস্তাফিজের চেয়ে প্রায় সাড়ে তিন বছরের সিনিয়র। টেস্ট সংখ্যায় তাই তাঁকে ধরতে পারার সুযোগ এমনিতেও ছিল না। কিন্তু মোস্তাফিজের অভিষেক থেকে ধরলে বাংলাদেশ যে ৩৩টি টেস্ট খেলেছে, বাংলাদেশের বাঁহাতি পেসার তো তার অর্ধেকও খেলেননি। সব সময় ইনজুরিই যে তার একমাত্র কারণ ছিল, ব্যাপারটা মোটেই তা নয়।

তবে আলোচনাটা যদি সাদা বলে সীমাবদ্ধ রাখি, তখন কিন্তু বিশ্বের অন্যতম সেরা পেস বোলারের সঙ্গে তুলনাতেও মোস্তাফিজ যথেষ্টই দেদীপ্যমান। লেখাটা যেহেতু একটা টি-টোয়েন্টি সিরিজ সামনে রেখে, টি-টোয়েন্টিতে দুজনের পারফরম্যান্সের একটা তুলনা একটা ছক বানিয়ে ওপরে দিয়ে রাখলাম। একটু দেখে নিতে পারেন।

ওয়ানডে নিয়ে আলোচনাটা বরং কথাতেই সেরে ফেলি। উইকেট-সংখ্যায় স্টার্ক মোস্তাফিজের চেয়ে ৭৮ উইকেটে এগিয়ে। তবে ম্যাচও তো খেলেছেন ২১টি বেশি। ১৯৫ আর ১২৭ উইকেটের আলোচনা তাই পাশে সরিয়ে রাখাই ভালো। তবে একটু অন্যভাবে তো তা করাই যায়। ৬৮ ম্যাচে মোস্তাফিজের ১২৭ উইকেট। তা ৬৮ ম্যাচে স্টার্ক কত উইকেট পেয়েছিলেন? মাত্র ৭টি বেশি। ১০০ উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়াতেও দুজন তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী। স্টার্ক যা ছুঁয়েছেন ৫২তম ম্যাচে, মোস্তাফিজকে খেলতে হয়েছে দুই ম্যাচ বেশি।

ওয়ানডে পারফরম্যান্সের খুঁটিনাটি নিয়ে কথা বললে তো দুজনকে সেভাবে আলাদাই করা যায় না। বোলিং গড়, ইকোনমি রেট, স্ট্রাইক রেট...সব কিছুতেই আশ্চর্য সমতা। পার্থক্যটা এমনই সূক্ষ্ম যে, তা বুঝতে দশমিকের ডানের কলামে তাকাতে হয়। স্টার্কের বোলিং গড় ২২.৪৫, মোস্তাফিজের ২২.৮৩। স্টার্ক ওভার প্রতি রান দিয়েছেন ৫.১৫, মোস্তাফিজ ৫.১৯। গড়ে প্রতি ২৬.১ বলে একটা উইকেট স্টার্কের, মোস্তাফিজের ২৬.৩ বলে।

মোস্তাফিজুর রহমান

টি-টোয়েন্টিতে দুজনকে আলাদা করতে অবশ্য অমন ফটো ফিনিশ লাগছে না, মোস্তাফিজকেই একটু এগিয়ে রাখতে হচ্ছে। স্টার্ক ইকোনমি রেটে একটু এগিয়ে, কিন্তু বোলিং পারফরম্যান্স বিচারের বাকি সব মানদণ্ডেই তো জয়ী মানতে হয় মোস্তাফিজকে। দুজনের বোলিং গড়, ইকোনমি, সেরা বোলিং এসব তো উপরের ছকেই দেওয়া আছে। ছকে যা নেই, তার মধ্যে দুটি গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনাতেই এগিয়ে মোস্তাফিজ। গড়ে ১৫.৫ বলে একটি উইকেট মোস্তাফিজের, স্টার্কের যেখানে লেগেছে ১৮.৩ বল। স্টার্কের সেরা বোলিং যেহেতু ১১ রানে ৩ উইকেট, বুঝতেই পারছেন, ম্যাচে কখনোই তাঁর ৪ বা ৫ উইকেট নেওয়া হয়নি। মোস্তাফিজ যেখানে তা নিয়েছেন একবার করে। সেটাও যেন তেন দলের বিপক্ষে নয়। ৫ উইকেট নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে, ৪ উইকেটের শিকার শ্রীলঙ্কা।

সেরা ফর্মের মোস্তাফিজকে দেখার মজা অবশ্য শুধু বোলিং ফিগারে বোঝা যায় না। বেশির ভাগ ব্যাটসম্যানকে বোকা বানিয়ে যেভাবে উইকেট পান, তা দেখাটাই না আসল মজা। লিখতে লিখতেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৫ উইকেটের ওই ম্যাচটার কথা মনে পড়ছে। কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচ। মোস্তাফিজ যেভাবে কিউই ব্যাটসম্যানদের নাচিয়ে ছেড়েছিলেন, তা ছিল দেখার মতো এক দৃশ্য। মোস্তাফিজের কল্যাণেই বাংলাদেশের জয়ের একটা সুযোগও তৈরি হয়েছিল। যে ম্যাচে বাংলাদেশ ৭৬ রানে হেরেছিল, সেই ম্যাচ নিয়ে এমন কথা বললে আপনার অবাক লাগতেই পারে, একটু রাগও। এত বড় পরাজয় তো বাংলাদেশ টি-টোয়েন্টিতে তাদের সর্বনিম্ন ৭০ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ায়। নইলে মোস্তাফিজের বোলিংয়ে মাত্র ১৪৫ রানের বেশি করতে না পেরে নিউজিল্যান্ড তো একটু দুশ্চিন্তা নিয়েই ফিল্ডিংয়ে নেমেছিল।

মিচেল স্টার্ক

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটাই টি-টোয়েন্টি খেলেছেন মোস্তাফিজ। সেটাও ওই ২০১৬ বিশ্বকাপেই। বেঙ্গালুরুর ওই ম্যাচেও অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানদের ভালোই নাচিয়ে ছিলেন। কোটার চার বল বাকি থাকতে তাঁর বোলিং ফিগার ছিল ৩.২-০-১৭-২। পরের চার বলের দুটিতে গ্লেন ম্যাক্সওয়েল ‘যা আছে কপালে’ বলে চালিয়ে দিয়ে দুটি ছক্কা মেরে বসায় যা একটু খারাপ হয়ে যায়। ওই ম্যাচে মিচেল স্টার্ক ছিলেন না। বাংলাদেশের বিপক্ষেও স্টার্কের একটাই টি-টোয়েন্টি। তবে ২০১৪ বিশ্বকাপে ঢাকায় ওই ম্যাচের সময় মোস্তাফিজের নাম তাঁর পরিচিতজনের বাইরে কেউই শোনেনি। টি-টোয়েন্টিতে ‘মোস্তাফিজ বনাম স্টার্ক’ তাই এবারই প্রথম। ২০১৭ সালে স্টার্ক বাংলাদেশ সফরে আসেননি বলে টেস্টেও দুজনের দেখা হয়নি। তবে ওয়ানডেতে দুবার তা হয়েছে এবং দুবারই বিপুল ব্যবধানে স্টার্ক জয়ী।

২০১৭ সালে ওভালে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ম্যাচে স্টার্কের ২৯ রানে ৪ উইকেট। বৃষ্টির কারণে অস্ট্রেলিয়ার ইনিংস ১৬ ওভারে থেমে যাওয়ায় মোস্তাফিজ ৫ ওভারের বেশি বোলিং করতে পারেননি। তাতে ২৭ রান দিয়ে কোনো উইকেট নেই। ২০১৯ বিশ্বকাপে স্টার্কের ৫৫ রানে ২ উইকেট। মোস্তাফিজ একটি মাত্র উইকেটই পেয়েছিলেন, সেটিও ৬৯ রান খরচ করে।

মোস্তাফিজের প্রশংসা করতে গিয়ে আইপিএল প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন স্টার্ক। স্টার্কের অনেক কথার মধ্যে একটা এখনো মনে আছে, ‘হি ইজ ডিফারেন্ট।’

ওই চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতেই স্টার্কের সঙ্গে মোস্তাফিজকে নিয়ে কথা হয়েছিল। মোস্তাফিজের সঙ্গে স্টার্ককে নিয়ে। ফুটবল বিশ্বকাপ বা অলিম্পিকে ‘মিক্সড জোন’ বলে একটা জায়গা থাকে। যেখানে খেলোয়াড়-অ্যাথলেটরা এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আইসিসিও এমন একটা ব্যবস্থা করেছিল। অধিনায়কদের প্রেস কনফারেন্সের বাইরেও দুই দলের চার/পাঁচজন করে খেলোয়াড় মিক্সড জোনে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেন। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ শেষে সেখানে মিচেল স্টার্ককে পেয়ে তাঁকে মোস্তাফিজ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছিলাম। ২০১৫ সালের পর আইপিএলে খেলেননি বলে মোস্তাফিজ-ম্যাজিকের প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারেননি, তবে হয় টিভিতে দেখেছেন নয়তো কারও কাছে শুনে থাকবেন। এ কারণেই মোস্তাফিজের প্রশংসা করতে গিয়ে আইপিএল প্রসঙ্গ টেনে এনেছিলেন স্টার্ক। স্টার্কের অনেক কথার মধ্যে একটা এখনো মনে আছে, ‘হি ইজ ডিফারেন্ট।’

শুধু বোলিংই নয়, মোস্তাফিজের ব্যক্তিত্বের ধরনটাও একটু্ আলাদা। কারও প্রশংসাতেই তাঁকে একেবারে গলে যেতে দেখিনি কখনো। তবে সেদিনই সন্ধ্যায় টিম হোটেলে স্টার্কের প্রশংসাবাণী শোনার পর তাঁর চোখেমুখে খুশির একটা আভা পরিষ্কারই ফুটে উঠতে দেখেছিলাম। বোলার মিচেল স্টার্ককে যে তাঁর খুব পছন্দ, এই কথাটাকে ওই প্রশংসার প্রতিদান বলে মনে হয়নি। স্টার্কের বোলিং আসলেই মোস্তাফিজের খুব ভালো লাগে।

বোলার হিসেবে মোস্তাফিজকেই আমার বেশি পছন্দ, তবে স্টার্কের বোলিংও দারুণ লাগে। ২০১৫ বিশ্বকাপ ফাইনালের ওই স্পেলটা তো এখনো ভুলতে পারি না। বাংলাদেশ-অস্ট্রেলিয়া সিরিজকে তো আর এমনিতেই 'মোস্তাফিজ বনাম স্টার্ক' বলছি না! 

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×