মেসির স্বপ্নপূরণ ডি মারিয়ার গোলে
কাশীনাথ ভট্টাচার্য
১১ জুলাই ২০২১
যে মারাকানায় ২০১৪ সালে জার্মানদের মাততে দেখেছিলেন বিশ্বজয়ের উৎসবে, সেখানেই শাপমোচন হলো মেসির। তাঁর সাথে সাথে ২৮ বছর পর আন্তর্জাতিক শিরোপার দেখা পেল আর্জেন্টিনাও। কলকাতার নামী ফুটবল লেখকের কলমে মেসির স্বপ্নপূরণের ম্যাচের বৃত্তান্ত।
দিয়েগো তোমার জন্য!
হয়তো বলবেন লিওনেল মেসি। জুড়ে দেবেন, ‘আমার জন্যও’। মাঠে খেলা শেষে দীর্ঘক্ষণ বুকে জড়িয়ে রেখে ধন্যবাদটা তো দিয়েই ফেলেছেন আনহেল ডি মারিয়াকে!
দুঃখ একটাই, ম্যারাডোনা দেখে যেতে পারলেন না। গর্বের মারাকানায় ব্রাজিলকে হারিয়ে আর্জেন্টিনার ট্রফি জয়ের স্বপ্নটা সার্থক হলো তিনি প্রয়াত হওয়ার সাত মাস পর। তাঁর উত্তরসূরি মেসি শেষ শ্রদ্ধা জানালেন ২৮ বছর পর দেশকে ট্রফি দিয়ে। কী জানতে চাইছেন, ফাইনালে তেমন খেললেন কই? সাত ম্যাচের প্রতিযোগিতায় চারটি গোল, সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং পাঁচটি অ্যাসিস্ট, আর্জেন্টিনার মোট ১২ গোলের ন’টিতেই অবদান রেখে সেরা ফুটবলারের ট্রফিও তাঁর। তারপরও প্রশ্ন? সেরা খেলেও ট্রফি যদি না আসে, একটা দিন না হয় তেমন ভালো না খেলেও ট্রফি এলো। কোনটা বেশি সুখকর?
সোনায় সোহাগা হতেই পারত গোলটাও পেলে। কিন্তু হয়নি। ফুটবলও যে জীবনের মতোই, আনন্দের মতোই দুঃখও দেয়। এই দুঃখটাও থেকে যাবে মেসির, ফাইনালে আর্জেন্টিনা জিতলেও গোল নেই। যেমন আগের চারটি ফাইনালেও গোল পাননি। কিন্তু, বিশ্বকাপ ফাইনালের পর প্রতিযোগিতার সেরার ট্রফিটা অনিচ্ছুক হয়ে নিতে গিয়ে একপাশে চুপসে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্যের সঙ্গে যখন মেলাতে বসবেন আজকের আনন্দোচ্ছল মুখ, সেরা ফুটবলারের ট্রফি নিতে যাওয়ার হাসিমুখটা, সহজেই ধরা দেবে পার্থক্য। দলগত খেলায় দলের জয় ব্যক্তির ভালমন্দের অনেক ওপরে থেকে গিয়েছে চিরকালই, থাকবেও। ফুটবল তো আর টেনিসের মতো 'একার-হাতেই-সব' নয়! তাই এমিলিয়ানো মার্তিনেজ ফাইনালে তোলেন টাইব্রেকার তিনটি শট বাঁচিয়ে আর ফাইনালে গোল করে যান ডি মারিয়া, ফাইনালের আগে আর কোনো ম্যাচে যিনি শুরু থেকে মাঠে থাকেননি।
সাত বছর আগে এই মারাকানাতেই বিশ্বজয়ের স্বপ্ন ধুলোয় লুটিয়েছিল মেসির। যদি মনে থাকে, গঞ্জালো হিগুয়েইন সেই ম্যাচের ২০ মিনিটে সোনার সুযোগ নষ্ট করেছিলেন। আর ২০২১-এ সেই মারাকানাতেই ২২ মিনিটে জয়সূচক গোল এনে দিলেন ডি মারিয়া! ফুটবলে, বিশেষ করে এমন মহাদেশীয় বা বিশ্ব প্রতিযোগিতার ফাইনালে, শুরুতে এমন একটি সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে কী হতে পারে, চিরকালই ভাবনার বিষয়। এগিয়ে যাওয়ার আত্মবিশ্বাস আর পিছিয়ে পড়ার মরিয়া মনোভাবে ভুল বেশি করার সম্ভাবনা, দুটোই বিবেচ্য, একই সঙ্গে।
তাই পার্থক্য গড়ে দিল ডি মারিয়ার গোল। আরও পার্থক্য গড়ে দিয়েছিল ডি মারিয়াকে প্রথম এগারোয় রাখা। কোচ লিওনেল স্কালোনি এখানেই বিপক্ষকে বিস্মিত করে দিয়েছিলেন মেসির পছন্দের জায়গায় ডি মারিয়াকে এগিয়ে রেখে, মেসিকে পিছিয়ে দিয়ে। কতবার দেখা গেল মেসিকে রক্ষণে? এতবার দেখেছেন কি সচরাচর? মেসির দিকে নজর রাখতে গিয়ে যেমন ব্রাজিলের মাঝমাঠকে এগিয়ে থাকতে হলো, মেসি নেই ভেবে রেনান লোদি অতটা ওপরে উঠে থাকার সুযোগ নিতে গিয়েছিলেন বলেই তো ডি পলের লং পাস ধরার সময় লোদি জায়গায় ফিরতে পারলেন না বা ফিরতে পারলেও ধরতে পারলেন না। বড় ভুল ব্রাজিলের। সেই ভুল থেকে দুরন্ত গোল ঠাণ্ডা মাথায় অভিজ্ঞ ডি মারিয়ার। আগুয়ান এডারসনের মাথার ওপর দিয়ে তুলে দিলেন কী অনায়াসে! ওই গোলেই শাপমুক্তি মেসির এবং মেসি-প্রজন্মে ব্যর্থতার তকমা সেঁটে যাওয়া ডি মারিয়াদেরও।
উল্টোদিকে ডি মারিয়ার পিএসজি-সতীর্থ নেইমারের কাছে দিনটা একেবারেই মনে রাখার মতো নয়। চেষ্টা করেছিলেন নিজের মতো করে। কিন্তু আর্জেন্টিনার মাঝমাঠ এবং রক্ষণ মিডল থার্ডে ব্রাজিলের আক্রমণ রুখে দেওয়ার জন্য প্রয়োজনে তো বটেই, অপ্রয়োজনেও ফাউল বাড়াল–পেশাদারিত্বে। বহু বছর আগে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার খেলার ধরন নিয়ে ম্যারাডোনার কথা পড়েছিলাম ‘ওয়ার্ল্ড সকার’ পত্রিকায়। রাখঢাক না করেই ম্যারাডোনা বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলের মতো সর্বদা সুখী ফুটবল খেলা আমাদের ঘরানা নয়। বল নিজেদের দখলে থাকলে সৃষ্টিশীল হতে চাই যেমন, বিপক্ষের দখলে থাকলে ধ্বংসাত্মক খেলতেও পারে আর্জেন্টিনা, যেটা ব্রাজিল পারে না একেবারেই।’
উরুগুয়েকে সবচেয়ে বেশিবার কোপা জয়ের ক্ষেত্রে ধরে ফেলার এই কোপা ফাইনালে স্কালোনির কৌশলই ছিল, মাঝমাঠে অদরকারেই খেলার গতি থামাও। ব্রাজিলকে সহজাত খেলাটা খেলতে দিও না। সেই কৌশলে এক শ শতাংশ সফল আর্জেন্তিনা। বিপক্ষের গোলমুখ খুলে ক’বার এমিলিয়ানো মার্তিনেজের মুখোমুখি হলেন নেইমার-রিচার্লিসনরা, গুনতে বসলেই বুঝতে পারবেন স্কালোনির কৌশলের সার্থকতা। রিচার্লিসন গোল করে ফেলেছিলেন, অফসাইডে ঢুকে আসতে পেরেছিলেন বলেই। তাই-ই নয়, যেখানে ছিলেন, সরাসরি গোল করা সম্ভব ছিল না বলে ভেতরের দিকে বল রাখতে গিয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার ডিফেন্ডারের পায়ে লেগে ফিরতি বল তাঁর কাছে আবার যাওয়ার পরও ঠেলতে পেরেছিলেন গোলে। কিন্তু, আগেই অফসাইড!
ফুটবল তো ট্যাকটিক্যাল খেলাও। সেই কৌশলে আর্জেন্টিনার বাজিমাত কোপা ফাইনালে, মেসি ম্যাচ জুড়েই তেমন চোখে পড়ার মতো না খেলা সত্ত্বেও। নিজের দলের দুর্বলতা আর বিপক্ষের শক্তি বুঝে কৌশল তৈরির কাজটাই কোচের। তাই আর্জেন্টিনার এই প্রায় তিন দশক পর ট্রফি জয়ের জন্য কৃতিত্ব স্কালোনিকে না দেওয়াটা অন্যায়। ঠিক যে অন্যায়টা আমরা করে থাকি ১৯৮৬ বিশ্বকাপের জন্য কার্লোস বিলার্দো নামের এক ভদ্রলোককে কোনো কৃতিত্ব না দিয়ে! সেই বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে তিন ব্যাকে খেলানো শুরু করেছিলেন বিলার্দো, মাঝমাঠে তুলে দিয়েছিলেন দুই সাইড ব্যাককে, যখন থেকে ৩-৫-২ সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছিল। আমরা যদিও সেই বিশ্বকাপ জয়ের এক শ শতাংশের মধ্যে এক শতাংশ কৃতিত্বও দিই না ডক্টর বিলার্দোকে!
মারাকানার সঙ্গে ব্রাজিলের সম্পর্কটাও বোধ হয় ফিরে গেল ৭১ বছর আগে। ১৯৫০ বিশ্বকাপে পারেনি। উরুগুয়ের কাছে প্রতিযোগিতার শেষ ম্যাচে হেরে গিয়ে হাতছাড়া হয়েছিল ট্রফি, যে কারণে ‘মারাকানাজো’ থেকে গিয়েছে ব্রাজিলের ফুটবলে সবচেয়ে বড় ক্ষত হিসাবে। এই মারাকানাতেই ২০১৬ অলিম্পিকের ঐতিহাসিক প্রথম সোনার পর ২০১৯ কোপা চ্যাম্পিয়নের শিরোপাও। কিন্তু ঘরের মাঠে চিরশত্রু আর্জেন্টিনার কাছে কোপা ফাইনালে হারের চেয়ে বড় ক্ষত আর কী!
আবারও তাই ফিরে-যাওয়া সেই ২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের আগের দিন। জার্মানির হাতে ১-৭ হওয়ার পর ব্রাজিলীয়দের দুঃখের ঘড়া সম্পূর্ণ করতে আর্জেন্টিনিয়ানরা তো এই আশাতেই ফিরিয়ে এনেছিলেন সেই চরম অপমানজনক গানটা! 'ব্রাজিল দেখে যা কেমন লাগে, নিজের ঘরে বসে দেখতে, তোদের "বাপ" লিওনেল মেসি তোদের ঘর থেকেই ট্রফিটা নিয়ে আসবে ড্যাং ড্যাং করে। নব্বই-এর ম্যারাদোনাকে ভুলে যাসনি তো? কেমন করে ইতালিতে একটা পাসেই তোদের সব দরজা খুলে দিয়েছিল দিয়েগো!'
মারাকানা থেকে কোপার ট্রফিটা নিয়ে আসা তাই মেসিরও ‘ট্রিবিউট’, তাঁর আদর্শ ম্যারাডোনাকে। আনন্দে মেতে উঠে একটু কেঁদে আর অনেকটা হেসে সতীর্থদের কাঁধে চড়ে চৌত্রিশের মেসির ষষ্ঠ কোপায় এই প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি জয় হঠাৎই যেন উসকে দিল ২০১১ সালের অন্য খেলার অন্য এক গ্রেট-এর স্মৃতিও। হরভজন-যুবরাজ-বিরাটদের কোলে-কাঁধে একই রকমভাবে ওয়াংখেড়ে ঘুরেছিলেন যে নিজের ষষ্ঠ বিশ্বকাপেরই শেষে শচীন টেন্ডুলকার!
আরও পড়ুন: