এরিকসেন ও একটি অনুভূতির গল্প

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

এরিকসেন ও একটি অনুভূতির গল্প

ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন আপাতত সুস্থ আছেন। কিন্তু গতকাল মাঠে পড়ে গিয়ে তিনি যে অসার করে দেওয়া অনুভূতির জন্ম দিয়েছিলেন, পুনর্বার সেই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে চান না কেউ। চান না বুয়েটে পড়ুয়া এই পাঠকও। তাই তো লিখে পাঠালেন, বিষাদগুলো থাকুক শুধুই মাঠের খেলায় পরাজয়ের, বিষাদের হাত যেন জীবন-মৃত্যুকে স্পর্শ না করে। মাঠের খেলার জয়-পরাজয়েই গড়াক দর্শক-সমর্থকের অশ্রু, জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন যেন খেলার মাঠে না আসে।

লেখার শুরুতে নিজের একটা গল্প বলে নিই। ২০১৯ সালের মার্চ মাস। আমি তখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী, বাসায় তাই স্বাভাবিকভাবেই টিভি-ইন্টারনেটের ব্যবহারে সাময়িক বিধিনিষেধ চলছে। এমনই এক সন্ধ্যায়, আমি কোচিংয়ে মডেল টেস্ট দিয়ে বাসায় ফিরলাম। রেডিও শোনার অভ্যাস ছিল, আর পরের দিন নিউজিল্যান্ড-বাংলাদেশ শেষ টেস্ট। ভাবলাম, সন্ধ্যা পৌনে সাতটার খবরে ম্যাচ প্রিভিউটা শোনা যাক। ততক্ষণে সাতটা বেজে গেছে, কোনমতে খেলার খবরটা ধরার আশায়, তড়িঘড়ি করে ইয়ারফোন লাগালাম কানে।

ইয়ারফোন লাগাতেই সর্বপ্রথম যে বাক্যটা শুনলাম, 'শেষ করার আগে শিরোনামগুলো আরেকবার।' ভাবলাম, যাই হোক, শিরোনামটা তো শুনি, পরে বিবিসি শুনে নেওয়া যাবে। প্রথম খবরটাই শুনলাম, 'নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে…' এক লহমায় ভেবে ফেললাম অনেক কিছু। ভাবলাম, এই খবর এখন কেন? খেলার খবর তো প্রচার করার কথা সবার শেষে। ভাবতে ভাবতেই কানে এলো খবরের বাকি অংশ, 'মসজিদে হামলা, নিহত ৫০।' সাথে সাথে মনে হলো, যেন আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। অজানা এক আতঙ্ক যেন ঘিরে ধরল আমাকে। ভয় আর শঙ্কায় হৃদস্পন্দন কত হলো কে জানে। পরের খবরে আরও ভয়ানক কিছুর আশঙ্কা করতে লাগলাম। 'বাংলাদেশ ক্রিকেট দল নিরাপদে… টেস্ট বাতিল, কাল দেশে ফিরছে দল' টুকরো টুকরো এই শব্দগুলো যে কতটা আনন্দের, আর তার চেয়ে কত বেশি স্বস্তির, মরুভূমিতে এক পশলা বৃষ্টি বলতে যে কী বোঝায়, সম্ভবত সবচেয়ে ভালোভাবে অনুভব করলাম জীবনে।

প্রায় দুই বছর পর, গতকাল ১২ জুন সেই একই অনুভূতির মুখোমুখি হলাম আরেকবার। ইউরোর ডেনমার্ক-ফিনল্যান্ড ম্যাচ চলছে। আমি এক মুহূর্তের জন্য চোখ সরালাম ম্যাচ থেকে, পরমুহূর্তেই দেখি একজন ড্যানিশ খেলোয়াড় মাঠে পড়ে রয়েছেন, তাঁকে ঘিরে রয়েছেন বাকিরা। ফুটবল মাঠের খুব সাধারণ দৃশ্য হিসেবে ভেবে নিয়েছিলাম, টুকটাক চোট-আঘাত পাওয়ার ঘটনা তো হরহামেশাই ঘটে থাকে। কিন্তু সময় যতই গড়াতে লাগল, আমার সন্দেহ ততই বাড়তে লাগল। সাধারণ কোন চোট বা আঘাতে তো এত সময় নেন না খেলোয়াড়রা। তাহলে কি খারাপ কিছু ঘটেছে, যেটা আমার চোখ এড়িয়ে গেছে? সন্দেহটা ঘনীভূত হওয়ার আগেই ঢুঁ মারলাম অন্তর্জালে আর সামাজিক মাধ্যমে। এরপর যা দেখলাম, তাতে আমার রক্ত হিম হয়ে গেল। সাধারণ কোন চোট নয়, রীতিমতো ‘কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট’ এর শিকার হয়েছেন ক্রিস্টিয়ান এরিকসেন!

এমন দিগভ্রান্ত চেহারাগুলো কে দেখতে চাইবে আর! ছবি: এপি

মাঠের ক্যামেরা ক্রু'রা ততক্ষণে ফোকাস করছেন দর্শক-সমর্থক আর দু’দলের খেলোয়াড়দের ওপর। সবাই নির্বাক, হতভম্ব, সবার মুখে অপ্রত্যাশিত কিছুর আশঙ্কা, চোখে পানি। ডেনমার্কের খেলোয়াড়েরা মানবদেয়াল গড়লেন এরিকসেনকে ঘিরে। চিকিৎসক দল দ্রুত কাজ শুরু করলেন, যেন যমে-মানুষে টানাটানি চলছে তখন! সেই যুদ্ধে জয়ীর নাম ঘোষিত হওয়ার আগেই এরিকসেনকে নেওয়ায় হলো হাসপাতালে, ফিনল্যান্ডের সমর্থকেরাও ততক্ষণে পতাকা এগিয়ে দিয়েছেন এরিকসেনকে ঢেকে দেওয়ার জন্য। ইউরো, ফুটবল, মাঠের লড়াই, সব এক মুহূর্তে ভীষণ অপ্রয়োজনীয় হয়ে উঠেছে, জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়ানো এরিকসেনকে সাহস দেওয়ার জন্যই তখন দু’দলের সমর্থকেরা গলা চড়ালেন ‘ক্রিস্টিয়ান’, ‘এরিকসেন’ বলে। কিন্তু তাতে কি আর দূরদেশ থেকে টিভিতে চোখ রাখা দর্শকের শঙ্কা কমে? সেই শঙ্কা দূর করতে লেগে গেল আরও কয়েক মিনিট। ভয়, আশঙ্কা আর রুদ্ধশ্বাস প্রার্থনার কয়েক মিনিট!

এরিকসেন ফিরে আসুন এই বেশে।

বিশ্বস্ত সাংবাদিক ফ্যাব্রিজিও রোমানো যখন এরিকসেনের আপাতত সুস্থতার খবর নিশ্চিত করলেন, হাজার ফুটবলপ্রেমীর মতো আমারও বুকের ওপর থেকে যেন একটা পাথর নেমে এল, স্বস্তিতে দু’ফোঁটা চোখের জলও গড়িয়েছিল কি না, নিশ্চিত করে বলতে পারি না। তবে সর্বশক্তিমানের প্রতি কৃতজ্ঞতায় হৃদয় ভরে উঠেছিল, এটা নিশ্চিত করেই বলতে পারি।

রমন লাম্বার মৃত্যু আমার জন্মের আগে, ফিল হিউজের মৃত্যুর ম্যাচটাও দেখা হয়নি সরাসরি। জীবন আর মৃত্যুর মাঝামাঝি সময়ের অবর্ণনীয় অনুভূতিটা প্রথম অনুভব করেছি ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলা আর ‘বাংলাদেশের সবাই সুস্থ আছে’ খবরের মাঝামাঝি সময়ে, দুই বছর পরে আবার অনুভব করলাম এরিকসেনের কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট আর 'আপাতত স্থিতিশীল' খবর পাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে। সেই একই অনুভূতি, শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নেমে যাওয়া, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসা, কেমন একটা অপার্থিব অবিশ্বাসে মাথার ভেতর ভোঁ ভোঁ করা।

এই অনুভূতিই শেষ হয়ে থাকুক। আনন্দ আর রোমাঞ্চ দিয়েই পরিপূর্ণ থাকুক খেলার মাঠ। বিষাদগুলো থাকুক শুধুই মাঠের খেলায় পরাজয়ের, বিষাদের হাত যেন জীবন-মৃত্যুকে স্পর্শ না করে। মাঠের খেলার জয়-পরাজয়েই গড়াক দর্শক-সমর্থকের অশ্রু, জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন যেন খেলার মাঠে না আসে। ভালো থাকুক দুনিয়ার সব ক্রীড়াবিদ, ভালো থাকুক দুনিয়ার সব মানুষ।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×