ইউরোতে অ্যাডিডাস বনাম নাইকি লড়াই
উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা
আজহারুল ইসলাম
১৪ জুন ২০২১
ফুটবলে আমরা লড়াই দেখি ফুটবলারদের, অ্যাথলেটিকসে অ্যাথলেটদের। খেলোয়াড়দের দৃশ্যমান এই লড়াইয়ের আড়ালে চলে আরেক লড়াই—দল, খেলোয়াড়দের স্পনসরকারী প্রতিষ্ঠানের। লক্ষ লক্ষ ডলার বাণিজ্যের যে লড়াইয়ে ইউরোতেও মুখোমুখি ক্রীড়া সরঞ্জামাদি নির্মাতা দুই প্রতিষ্ঠান নাইকি ও অ্যাডিডাস।
মাঝরাত পেরিয়ে অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় থাকা ইউরো ২০২০-এর কিক-অফ পর্বটা তো দুদিন আগেই দেখে ফেলেছেন। রেফারিদের মাঠের মাঝখানে রেখে দুই দল নিজ নিজ অর্ধে অবস্থান নিয়ে আছে, এমন সময় একটা রিমোট কন্ট্রোলচালিত খেলনা গাড়িতে সওয়ার হয়ে উদ্বোধনী ম্যাচের বলটি ধীরে ধীরে মাঠে প্রবেশ করছে। গাড়িটা ছোট্ট হলেও তার গায়ে পরিস্কার দেখা যাচ্ছে উয়েফার পার্টনার ফোক্সওয়াগনের লোগো। টুইটারে এটা নিয়ে বেশ হইচইও হয়েছে। কেউ কেউ এটা দেখে বেশ পুলকিত, কেউ বা হয়েছেন বিরক্ত। কিন্তু উয়েফার ইঙ্গিতটা পরিস্কার—যতই আপনি ঝাঁজালো ফুটবল-রণ আশা করেন না কেন, পর্দার আড়ালে বাণিজ্য-রণটাই এখন ক্রীড়া জগতের চালিকাশক্তি।
হ্যাঁ, ক্রীড়ামোদী হিসেবে সাধারণ দর্শকরা পড়ে থাকবে গোল, পজেশন, শট অন টার্গেট, ফর্মেশন, পরিসংখ্যান ইত্যাদি নিয়ে। তবে সবার নজর কিন্তু সেদিকে থাকবে না। ১১ জুলাই এর ফাইনালে বরমাল্য কার গলায় উঠছে সেটার চেয়ে কারও কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাবে বাণিজ্যের লড়াইয়ে প্রতিপক্ষকে কতটা ধরাশায়ী করা গেল, সেই হিসাব। হ্যাঁ, কথা বলছি খেলাধুলা জগতের দুই জায়ান্ট নাইকি এবং অ্যাডিডাসকে নিয়ে।
টূর্নামেন্টে মাত্র শুরুর দিকে বলে অনেক দলের জার্সিই হয়তো এখনো আপনার নজরে আসেনি। যখন আসবে, তখন খেয়াল করলে দেখবেন, আসরের ২৪ দলের ৯টির জার্সির স্পন্সর নাইকি আর ৮টির অ্যাডিডাস। অন্যান্য স্পন্সরের মধ্যে আছে পুমা, হামেল, জেকো এবং জোমা। বড় দলগুলোর কথা যদি আলাদা করে ধরি তাহলে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড ।ও পর্তুগালের জার্সি স্পন্সর নাইকি; বেলজিয়াম, জার্মানি ও স্পেনের জার্সি স্পন্সর অ্যাডিডাস।
আমেরিকাভিত্তিক নাইকির ব্যবসা মূলত আমেরিকায় আর জার্মানিভিত্তিক অ্যাডিডাসের ব্যবসা এশিয়া এবং ইউরোপে অধিকতর বিস্তৃত। চলমান মহামারীর মধ্যে তাই নাইকির তুলনায় অ্যাডিডাস ক্ষতির শিকার হয়েছে বেশি। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী নাইকি এবং অ্যাডিডাসের রাজস্ব আয় যথাক্রমে ২৬ বিলিয়ন এবং ১৭ বিলিয়ন পাউন্ড। দুটি প্রতিষ্ঠানই করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠার পর্যায়ে আছে এবং স্টক মার্কেটে তাদের মূল্য অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে শ্রেয়তর।
স্পোর্টস মার্কেটিং কনসালটেন্ট টিম ক্রো’র শরণাপন্ন হলে দুটি ব্র্যান্ডের পার্থক্যটা বুঝতে সুবিধা হবে, ‘নিঃসন্দেহে নাইকি আর অ্যাডিডাসই ক্রীড়াপণ্যের বাজারের নেতা। এই দুই কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদনগুলো পড়লে দেখবেন, তাদের প্রায় সব কিছুই একই রকম। তবে তারা হুবহু এক নয়। যেমন, অ্যাডিডাস অনেকদিন ধরেই ইউরো ২০২০-কে গুরুত্ব দিয়ে আসছিল এবং বোঝাতে চাচ্ছিল, কীভাবে এটি অ্যাডিডাসের অস্তিত্বের সাথে জড়িত। অন্যদিকে নাইকি কিন্তু ফুটবল নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামায় না। সত্যি বলতে নাইকি ফুটবল খেলাটার চেয়ে কিলিয়ান এমবাপ্পেকেই বেশি ফোকাস করে। নাইকি আর অ্যাডিডাসের মধ্যে বড় একটা পার্থক্য এখানেই। অ্যাডিডাস সবসময় দলের ওপর মনোযোগ দিয়েছে, আর নাইকি ব্যবসা করতে চেয়েছে তারকাদ্যূতিকে কাজে লাগিয়ে।'
সেই ১৯৫৪ সাল থেকে জার্মান দলের সাথে অ্যাডিডাসের প্রায় সাত দশকের বন্ধনের ইতিহাসটা দেখলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালে প্রথম বারের মতো বিশ্বকাপ জেতা পশ্চিম জার্মানির খেলোয়াড়রা অ্যাডিডাসের তৈরি ফুটবল বুট পায়ে দিয়ে মাঠে নেমেছিল। এরপর দু’পক্ষের রসায়ন জমে যেতে সময় লাগেনি। ১৯৭০-এর দশকে এসে জার্মানরা অ্যাডিডাসের তৈরি জার্সি ও কিট ব্যবহার করা শুরু করল। প্রায় অর্ধশত বছর সব কিছু স্বাভাবিকভাবেই চললেও ২০০৬-এ এসে জার্মান দলের স্পন্সরশিপ নিয়ে অ্যাডিডাস পড়ে চ্যালেঞ্জের মুখে। সেই সময় চুক্তি অনুযায়ী অ্যাডিডাস জার্মান ফুটবল ফেডারেশনকে (ডিএফবি) বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন ইউরো দিলেও সুযোগসন্ধানী নাইকি অ্যাডিডাসের প্রায় ৫ গুণ বেশি অর্থের বিনিময়ে ডিএফবিকে নতুন চুক্তিতে প্রলুব্ধ করে। বিশাল অংকের এই অফারে ডিএফবি রাজিও হয়ে যায় এবং অ্যাডিডাসের সাথে চুক্তির মেয়াদ শেষে নাইকিকেই কিট পার্টনার করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে।
কিন্তু পাশার দান উলটে যায় মেয়াদ শেষে অ্যাডিডাস ১০ মিলিয়ন ইউরো থেকে লাফ দিয়ে বছর প্রতি ৬৫ মিলিয়ন ইউরো অফার করার পর। সেটাও আবার পরবর্তী ১০ বছরের জন্য। জার্মানির সঙ্গে নাইকির আর তাই গাঁটছড়া বাঁধা হয়নি। শুধু অর্থ বাড়িয়েই নয়, ডিএফবি’র অনুরোধে অ্যাডিডাস জার্মান দলের জন্য আধুনিক সুযোগসুবিধাসহ একটি স্বতন্ত্র ট্রেনিং গ্রাউন্ডও তৈরি করে দেয়। টিম ক্রো’র মতে, ‘অ্যাডিডাস জানে নাইকিই মার্কেট লিডার; কিন্তু অ্যাডিডাস বিনা যুদ্ধে হাল ছেড়ে দিতে রাজি নয়।’
কিন্তু জাতীয় দলের পেছনে এই বিনিয়োগ কি আসলেই লাভজনক? লিগের মতো জাতীয় দল তো সপ্তাহে-সপ্তাহে মাঠে নামে না। ফলে সারা বছরব্যাপী জার্সি-কিট বিক্রির অবস্থাটা কী? জাতীয় দলের সাফল্যের সাথেই বা এটি কতটা সম্পর্কিত?
স্পোর্টস মার্কেটিং বিশেষজ্ঞ ম্যাট পাওয়েলের মতে, ক্রীড়াপণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানগুলো মূলত চোখ রাখে বড় বৈশ্বিক আসরে শেষ ধাপ পর্যন্ত টিকে থাকা দলগুলোর ওপর। স্বাভাবিকভাবেই একটা আসর যত পরিণতির দিকে যায়, দর্শক আর মিডিয়া ততই টিকে থাকা দলগুলোর উপর মনোযোগ দেয়। এতে ব্র্যান্ডগুলোর যেমন প্রচারণা হয়, তেমনি জার্সি বিক্রিও হুট করে বেড়ে যায়। একটা উদাহরণ দিলেই ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার বোঝা যাবে। ২০১৪ বিশ্বকাপের আগে অ্যাডিডাস জার্মান জাতীয় দলের প্রায় ২০ লাখ জার্সি বিক্রি করতে পেরেছিল। কিন্তু ২০১৪ বিশ্বকাপ জেতার পর জার্মানির জার্সিতে যখন চতুর্থ তারকা যুক্ত হলো, তখন নতুন করে বাজারে ছাড়া চার-তারকাযুক্ত ১০ লাখ জার্সি হু হু করে বিক্রি হয়ে যায়!
ভিন্ন উদাহরণও আছে; ইউরো ২০১৬'র পর নাইকির সাথে ইংলিশ ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এফএ) চুক্তি নবায়ন করার সময় বছরপ্রতি মাত্র ৩৩ মিলিয়ন ইউরোর কিছু বেশি অফার করেছিল (যেখানে অ্যাডিডাস ডিএফবি’র সাথে চুক্তি করেছিল বছরে ৬৫ মিলিয়ন ইউরোয়)। এফএ’র দর-কষাকষির সুযোগ ছিল না, কারণ বিশ্বকাপ ২০১৪ এবং ইউরো ২০১৬ দুই আসরেই ইংল্যান্ড ছিল নিদারুণভাবে ব্যর্থ (৭ ম্যাচে মাত্র ১ জয়)। যে ব্যর্থতার মূল্য দিতে হয়েছিল নাইকিকেও। ‘থ্রি লায়ন’ চিহ্নিত ইংলিশ জার্সি বিপুল ছাড়ে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল তারা।
এ থেকে আমরা তাহলে কী বুঝলাম? বুঝলাম যে, দর্শকপ্রিয় বা প্রথাগত বড় দলের সাথে যুক্ত হওয়াটাই ব্র্যান্ডগুলোর জন্য সাফল্যের নিশ্চয়তা নয়। তাছাড়া বর্তমানে ডিজিটাল মার্কেটটাও অনেক বড় এবং এখানে মূলত তরুণ ও কম বয়সী ক্রেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার কৌশল প্রথাগত বাজার-কৌশলের চেয়ে ভিন্ন। এজন্যই হয়তো নাইকি জাতীয় দলের চেয়ে তারকা খেলোয়ারদের আলাদাভাবে স্পন্সর করতে বেশি আগ্রহী। কারণ, খেলা থাক বা না থাক, তারকারা সাধারণত সারা বছরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কম-বেশি উপস্থিত থাকেন। তবে এটাও কিন্তু ঠিক যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘লাইক’ বেশি সব সময় পণ্যের বিক্রির সমানুপাতিক নয়।
তাহলে কি তুলনামূলক ছোট দলগুলো বড় ব্র্যান্ডের স্পন্সরশিপের বাইরেই থেকে যাবে? বা ছোট ব্র্যান্ডগুলোই বা কিভাবে টিকে থাকবে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন তুলনামূলক ছোট ব্র্যান্ডগুলো অনেক সময় বড় ব্র্যান্ডগুলোর ‘অ্যামবুশ মার্কেটিং’-এর শিকার হয়। ছোট ব্র্যান্ডগুলো কতটা ছোট তার একটা উদাহরণ দেয়া যাক—হামেল ব্র্যান্ড স্পন্সর করছে ডেনমার্কের জার্সি, জ্যাকো স্পন্সর উত্তর মেসিডোনিয়ার এবং জোমা ইউক্রেনের জার্সি। এই তিন স্পন্সরশিপের সম্মিলিত অর্থের অঙ্ক বছরে মাত্র সাড়ে তিন মিলিয়ন ইউরো, যেখানে অ্যাডিডাস শুধু জার্মানিকেই দিচ্ছে বছরে ৬৫ মিলিয়ন ইউরো!
মোট কথা, এই স্পোর্টস মার্কেটিংয়ের জগতটা একদিকে যেমন খেলাধুলার প্রতি বড় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ-নিবেদনের পরিচায়ক, তেমনি এখানে বিনিয়োগ করা প্রতিটি পয়সা চুলচেরা হিসাব করা। আবার কখনো কখনো এটা অনেকটা জুয়ার মতোও। যেমন, ২০১২ সালে ফিফা র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ বিশের বাইরে থাকা বেলজিয়াম ২০১৮ বিশ্বকাপে হয়ে গেল তৃতীয়। আর এখন তো তারা র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের এক নম্বর দলই। ২০১৪ সাল থেকে বেলজিয়ামের কিট স্পন্সর অ্যাডিডাস। চুক্তির অর্থের অঙ্ক কত ছিল, জানেন? বছরে আড়াই মিলিয়ন ইউরো!
বুঝতেই পারছেন, এবার বেলজিয়াম যদি ইউরো জিতে যায়, তাহলে অ্যাডিডাসের তো পোয়া বারো।
* এই লেখাটা লিখতে 'দ্য অ্যাথলেটিক'-এর একটি প্রতিবেদন ও অন্য অনেক সূত্র থেকে অকাতরে সাহায্য নেওয়া হয়েছে।