সাকিবকে শাস্তি পেতেই হতো, পেয়েছেনও, কিন্তু এরপর...

উৎপল শুভ্র

১৩ জুন ২০২১

সাকিবকে শাস্তি পেতেই হতো, পেয়েছেনও, কিন্তু এরপর...

স্টাম্পে লাথি মারার পর আম্পায়ারের সঙ্গে সাকিবের বচসা। ছবি: বিসিবি

আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ হয়ে লাথি মেরে স্টাম্প ভেঙে ফেলায় তিন ম্যাচ নিষিদ্ধ হয়েছেন সাকিব আল হাসান, সঙ্গে জরিমানা করা হয়েছে পাঁচ লাখ টাকা। যে কাণ্ড করেছেন, তাতে সাকিবের শাস্তি অবধারিতই ছিল, তবে সেটির বিচারের প্রক্রিয়া প্রশ্ন জাগাতে বাধ্য। বোর্ড সভাপতি যে ঘটনার `রুট কজ` খুঁজে বের করতে বলেছেন, সেটিও যথেষ্টই কৌতূহলোদ্দীপক।

সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রে সব কিছুই আলাদা। ক্রিকেটের সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী, মাঠে কোনো ক্রিকেটার কোনো শৃঙ্খলা বা আইন বহির্ভূত কিছু করলে আম্পায়ারদের রিপোর্টের ভিত্তিতে ম্যাচ রেফারি ওই ক্রিকেটারকে তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগের কথা লিখিতভাবে জানাবেন। তা ম্যাচ শেষ হওয়ার পর পরই তা ক্রিকেটারের কাছে পৌছে দেবেন চতুর্থ আম্পায়ার।অভিযুক্ত ক্রিকেটার যদি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ এবং অপরাধ স্বীকার করে নেন, ম্যাচ রেফারির কাজটা তখন খুব সহজ। আইন অনুযায়ী অপরাধটা কোন পর্যায়ের, ক্রিকেটে যা লেভেল ওয়ান, লেভেল টু, লেভেল থ্রি...এমন শ্রেণিতে ভাগ করা, তা তো ঠিক করাই আছে। সেই অনুযায়ী তিনি শাস্তির কথা জানিয়ে দেবেন। তখন আর শুনানির প্রয়োজন পড়বে না।

আর ক্রিকেটার যদি তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন, তখন শুনানি হবে। শুনানি হতে পারে শাস্তিটা তাঁর কাছে বেশি হয়ে গেছে মনে হলেও। শুনানি মানে ক্রিকেটার কেন নিজেকে নির্দোষ মনে করেন, সেই যুক্তি দেবেন আর কি! ক্রিকেটরের দাবির পক্ষে যুক্তি শোনার পর আম্পায়ারদের পর্যবেক্ষণ এবং অন্য সব তথ্যউপাত্ত যেমন ভিডিও ফুটেজ, অডিও ক্লিপ (যদি থাকে)-এর সঙ্গে তা মিলিয়ে দেখবেন ম্যাচ রেফারি। যুক্তিতর্কও হতে পারে। এসব থেকে ম্যাচ রেফারি ঘটনার সত্যাসত্য বোঝার চেষ্টা করবেন, আদালতে বিচারক যা করেন আর কি! সেটা বোঝা হয়ে গেলে পরের কাজটা খুব সহজ। অপরাধের মাত্রাভেদে লেভেল তো নির্ধারণ করাই আছে। সেই লেভেলের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ আর সর্বনিম্ন শাস্তিও। এর মধ্যে কোনটা এক্ষেত্রে ন্যায্য বিচার হয়, সেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে তারপর তা জানিয়ে দেবেন ম্যাচ রেফারি। যা ম্যাচের দিনই আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে দেওয়াটাই স্বাভাবিক নিয়ম। যেটির জন্য একটা প্রেস রিলিজই যথেষ্ট।

অথচ সাকিবের ক্ষেত্রে কী ঘটল? ঘটনার প্রায় ২৪/২৫ ঘণ্টা পর তাঁর অবধারিত শাস্তির ঘোষণা এলো। সেটিও আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে। সেই সংবাদ সম্মেলন নিয়েও নাকি অনেক নাটক হয়েছে শুনলাম। একবার বলা হয়েছে, হবে। আবার বলা হয়েছে, হবে না। শেষ পর্যন্ত যেখানে তা হলো, সেখানেও নাকি তা হওয়ার কথা ছিল না। তারপরও কিছু সাংবাদিক তো ছিলেনই। ঢাকা লিগের পরিচালক সংস্থা সিসিডিএমের প্রধান কাজী ইনাম আহমেদ এবং বিসিবির মিডিয়া কমিটির চেয়ারম্যান সন্ধ্যার দিকে সারা দিন অপেক্ষমান সেই সাংবাদিকদের সামনে এসে ঘোষণা করলেন সাকিবের বিরুদ্ধে শাস্তির বিস্তারিত। বিস্তারিত বলতে তিন ম্যাচের নিধেষাজ্ঞা এবং পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা। সাকিবের অপরাধটা যে লেভেল থ্রি পর্যায়ের, জানালেন এটাও।  এখানে জানিয়ে দেওয়া ভালো, লেভেল থ্রি পর্যন্ত বিচারের এখতিয়ার শুধু ম্যাচ রেফারির। অভিযোগটা লেভেল ফোর পর্যায়ভুক্ত হলেই শুধু তা বোর্ডের ডিসিপ্লিনারি কমিটি বা সিইও পর্যন্ত যাবে।

সেই লাথি। ছবি: বিসিবি

সাংবাদিকেরা আগেই জেনে গিয়েছিলেন, তারপরও তাঁদেরকে জানানো হলো, সাকিবের বিরুদ্ধে এই শাস্তির সিদ্ধান্ত ঘোষণা করার আগে ক্রিকেট বোর্ডের বড় বড় কর্তাব্যক্তিরা মিটিং করেছেন। আরও জানা গেল, বোর্ড সভাপতি ঘটনার বিস্তারিত জানতে চাওয়ায় তাঁকেও তা জানানো হয়েছে। তা আলাদা করে, নাকি ওই সভাতেই, এ ব্যাপারে অবশ্য এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি। সাকিবের শাস্তির সিদ্ধান্তটা ম্যাচ রেফারি নিয়েছেন, নাকি বিসিবির ডিসিপ্লিনারি কমিটি (যতটুকু বুঝি, তাতে মাঠের ব্যাপার ওই পর্যন্ত যাওয়ারই কথা না), এটাও নিশ্চিত বলতে পারছি না। 

সাকিব যা করেছেন, তাতে এই শাস্তিকে লঘু পাপে গুরু দণ্ড বলার উপায় নেই। বরং কেউ উল্টোটাই দাবি করতে পারেন। এর চেয়ে কম 'অপরাধ' করেও যে অতীতে সাকিব আরও বড় শাস্তি পেয়েছেন। এবার তাই তিনি অল্পের ওপর দিয়েই বেঁচে গেছেন, এমন বলতেই পারেন কেউ। মাঠের ঘটনার বিচার হয়েছে, 'অপরাধী'র শাস্তিও, কিন্তু মাঠের বাইরে আবাহনীর কোচ খালেদ মাহমুদ যা করেছেন, টিভিতে সরাসরি দেখা প্রেস কনফারেন্সে তা নিয়ে কোনো কথা হতেই শুনলাম না। সাকিবের মতো গুরুতর না হলেও প্রতিপক্ষের একজন খেলোয়াড়ের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে একটু হলেও 'অপরাধ' তো তিনিও করেছেন। সাকিবের অপরাধের বিচারটা ম্যাচ রেফারির ওপর ছেড়ে না দিয়ে এই যে বিসিবির ডাকসাইটে পরিচালকদের কয়েক ঘণ্টা মিটিং করতে হলো, তাতে কি আদৌ এই প্রসঙ্গটা উঠেছিল? এটাও জানতে কৌতূহল হচ্ছে, খালেদ মাহমুদ নিজেও ওই সভায় ছিলেন কি না! থাকতেই পারেন। বোর্ড পরিচালক হিসেব সেই অধিকার তো তাঁর আছেই।

কী গোলমেলে ব্যাপার, দেখুন না! আগের দিন আবাহনীর কোচ ভিন্ন অবতারে দেখা দিয়ে পরের দিন অনায়াসেই বোর্ড পরিচালক হয়ে যেতে পারেন! লাইভ প্রেস কনফারেন্সে এটাও শুনলাম, বোর্ড সভাপতি নাকি ঘটনার 'রুট কজ' খুঁজে দেখতে বলেছেন। এজন্য একটা তদন্ত কমিটিও করা হয়েছে। তদন্ত কমিটির সদস্যদের নামও জানিয়ে দেওয়া হলো। তিন দিন পর বোর্ড মিটিংয়ে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে। তা নিশ্চয়ই ওই তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতেই। যা শুনে আশায় থাকব কি না, ঠিক বুঝতে পারছি না। অতীত অভিজ্ঞতা খুব একটা আশাবাদী হতে দেয় না। প্রথম প্রশ্ন, তদন্ত কমিটি কি আবিষ্কার করবেন, যা বাংলাদেশের ক্রিকেট পাড়ায় মোটামুটি সবাই জানেন না? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন, 'রুট কজ'টা কি বোর্ড সভাপতির আসলেই অজানা?

সাকিবের শাস্তির খবরটা পাওয়ার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটুকুই লিখলাম। বিসিবি যেমন বিস্তারিত আলোচনা করবে বলে জানিয়েছে, আমিও এ নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত লেখা নিয়ে আপনাদের কাছে আসছি। এজন্য অবশ্য তিন দিন অপেক্ষা করতে হবে না। আশা করি, আজ/কালের মধ্যেই তা পেয়ে যাবেন। হয়তো আজ রাতেই।      

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×