সাকিবের আচরণিক বিচ্যুতি এবং কিছু প্রশ্ন

সাকিবের আচরণিক বিচ্যুতি এবং কিছু প্রশ্ন

জীবনটা তাঁর কেটে গেল বাইশ গজের হিসেব মেলাতে মেলাতেই। আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে সাকিব আল হাসানের কাণ্ডটা তাঁকে বোঝাল, হিসেবটা এখনো মেলানো যায়নি পুরোপুরি। সাকিবের অভব্য আচরণের পুরো দায়টাই কি সাকিবের, নাকি এই বিক্রিয়ায় প্রভাবকও লুকিয়ে আছে--উৎপলশুভ্রডটকম-এ বর্ষীয়ান ক্রিকেট লেখক ও কোচ জালাল আহমেদ চৌধুরী জানালেন তাঁর ভাবনা।

শুক্রবার পবিত্র জুম্মার দিনে শেরে-বাংলায় যা ঘটেছে, তা দিনটিকে এবং মানবিক সহমর্মিতার প্রতিফলক খেলাটিকে একটি কলঙ্কচিহ্নিত দিনের আদল দিয়েছে। আম্পায়ারের সিদ্ধান্তের বিপরীতে সাকিবের উইকেট ভাঙা 'ওয়েল ব্যালান্সড কিক' ক্রীড়া চৈতন্যের প্রতিযোগিতা কাতর স্বচ্ছ-সুন্দরের ভারসাম্য এলোমেলো করে দিয়েছে। দৃশ্যটি ঘরে বসে পর্দায় দেখে এবং দৃশ্য-পরবর্তী প্রতিক্রিয়ার খণ্ডন-উত্তাপে পুড়তে পুড়তে দেখেছি দ্বিখণ্ডিত সাকিব আল হাসানকে; কোথাও তিনি বিপ্লবী মহানায়ক, আবার কারও কারও কাছে ধিক্কারে জর্জরিত খলনায়ক। তাৎক্ষণিকতার রেশ কাটাতে কাটাতে বিপরীতমুখী চরিত্রচিত্রণ জোড়া লাগিয়ে দেখি, এক অনাচারক্লিষ্ট ক্রিকেট পরিবেশের চিত্র ফুটে উঠেছে। সাকিবের অবয়ব সেখানেই সামান্য ছায়া ফেলে।

অনেক সময়ই আমরা দেখতে পাই, বোলার আপিল করলেই তাৎক্ষণিকভাবে আম্পায়ার আঙুল তোলেন না, বরং কিছুটা সময় নিয়ে নিজের মস্তিষ্কে একটা রিপ্লে দেখে নেওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। আমরা তো এমনও দেখেছি, তারস্বরে আবেদন করে করে প্রায় হাল ছেড়ে দিয়েছেন বোলার, আম্পায়ারের আউটসূচক অঙ্গুলি উর্ধ্বাকাশমুখী হলো এরপর। কিন্তু এদিন আমরা কী দেখলাম, পাঠককে তা একটু মনে করতে অনুরোধ করছি। আম্পায়ারকে চিন্তাভাবনার যথেষ্ট সময় দেওয়ার আগেই সাকিবের লাথি পড়েছে স্টাম্পে। 'জেন্টলম্যানস্ গেম' বলে পরিচিত যে খেলা, সেই খেলায় এ ধরনের আচরণ যে মোটেই সমর্থনযোগ্য না, এটা আসলে বলার কোনো প্রয়োজন পড়ে না।

সাকিবের উইকেট-ভাঙা কিক। ছবি: বিসিবি

এই কয়েক দিন আগেই অন্তর্জালের দুনিয়া মুখরিত ছিল 'সাকিবই কি সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার', 'অলরাউন্ডারের মানদণ্ডে সাকিব কি ছাড়িয়ে গেছেন সোবার্সকেও'-জাতীয় আলোচনায়। কিন্তু মাঠের খেলায় সর্বময় কর্তা হিসেবে মনোনীতদের চূড়ান্ত অসম্মান করে সাকিব যে উদাহরণ সৃষ্টি করলেন, তারপর সাকিব আর গ্যারি সোবার্সের তুলনামূলক আলোচনায় আমি একটু বিব্রত বোধই করব।

আম্পায়ারের সঙ্গে অসদাচরণের পর সাকিব আরেকটি বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন খালেদ মাহমুদ সুজনের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে। শুনেছি, পরস্পরের দিকে তেড়ে আসার মতো অপ্রীতিকর ঘটনাও নাকি ঘটেছে। অথচ, গেল কয়েক বছরে বাংলাদেশ জাতীয় দলের নির্ভরশীলতার জায়গা দুজনই। সাকিব আল হাসানের অপরিহার্যতার কারণ নতুন করে বলাটা বাহুল্যই হবে, আর গণমাধ্যমের বরাতে যতটুকু খবর পাই, বিদেশ সফরে গেলে ক্রিকেটাররা নাকি আস্থা খুঁজে পান সুজনের ম্যানেজারিতেই। জাতীয় দলের এই অবিচ্ছেদ্য দুই সদস্যের মাঝেই যদি আক্রোশের বীজাণু ছড়িয়ে পড়ে, ভবিষ্যৎ সিরিজগুলোতে আমাদের দলের সাজঘর কতটুকু স্বস্তিদায়ক থাকবে, দলীয় সংহতি কতটুকু বজায় থাকবে--এই ভাবনাগুলো আমাকে শঙ্কিত করছে।

বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েছিলেন সাকিব-সুজন। ছবি: সাইফ চৌধুরী

আমাদের দর্শক মহলে সাকিবের এই প্রতিক্রিয়া কেমন প্রভাব ফেলবে, তা ভাবতে গিয়েও তো আমি আতঙ্কিত বোধ করছি। চরম বিপর্যয়েও আশায় বুক বাঁধেন, নিদারুণ ব্যর্থ এক সিরিজ কাটিয়ে ফেরত এসেছে দল, তবুও স্বপ্ন দেখেন ওই দলকে নিয়েই--আমাদের ক্রিকেটের মূল চালিকাশক্তি তো এমন সমর্থকরাই। ওই সমর্থকদের বিশ্বাসও তো ধাক্কা খেল বাস্তবতার দেয়ালে। সাকিবকে যদি প্রতীক হিসেবেই ধরি, তবে বলতে পারি, আমাদের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেটাররাই আস্থা রাখতে পারছেন না খেলা পরিচালনায় নিযুক্ত ব্যক্তিদের সিদ্ধান্তে। তাই যদি হয়, আমজনতা এ দেশের ক্রিকেট সামনে তরতর করে এগোবে--এমন আশায় বসতি গড়বেন কী করে!

সাকিব যা করেছেন, তাতে তাঁকে কাঠগড়ায় তুলে তাঁর তীব্রতম সমালোচনা করাই যায়। তা যে একেবারেই হচ্ছে না, তা নয়। সাকিব যা করেছেন, তার কোনোমতেই গ্রহণযোগ্য নয় মেনেও সাকিবের দিকটাও একটু বোঝার চেষ্টা করতে চাইছি। এর আগের দিনই কোথায় যেন একটা প্রতিবেদন দেখেছিলাম, যার প্রতিপাদ্য ছিল, মানসিকভাবে খুব স্বস্তিতে নেই সাকিব। এবারের ডিপিএলে ব্যাট হাতে আশানুরূপ পারফর্ম করতে পারছেন না, পরিবারের সঙ্গে তাঁর দূরত্বটা পৃথিবীর এপার-ওপার...সব মিলিয়ে নানাবিধ দুশ্চিন্তায় তিনি আক্রান্ত বলেই অনুমান করছি। সাকিবের এহেন আচরণ তাই মুহূর্তের আবেগের বিস্ফোরণ হওয়াও অস্বাভাবিক কিছু নয়। মানসিক অশান্তিতে ভুগতে থাকা মানুষ অনেক সময়ই নিজের আবেগে বেড়ি পরাতে ব্যর্থ হন।

ডিপিএলে আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্ন ওঠা নতুন নয়। ছবি: বিসিবি

সাকিবের এই কাণ্ড ধীরে ধীরে জমা হওয়া পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশও হতে পারে। এবারের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে আম্পায়ারিং নিয়ে প্রশ্নটা কিন্তু এবারই প্রথম উঠল না। এর আগেই ব্রাদার্স ইউনিয়ন বনাম ওল্ড ডিওএইচএসের ম্যাচে আমরা দেখেছি, ১ বলে ৩ রান প্রয়োজন ওল্ড ডিওএইচএসের--এমন সমীকরণে শেষ বলকে বৈধ হিসেবে ঘোষণা করেছেন আম্পায়ার, যেখানে সাদা চোখে বলটিকে ওয়াইড বলেই মনে হচ্ছিল। গতকাল মুশফিককে আউট না দেওয়ার পেছনে সাকিব কি তবে ভিন্ন কিছুরই ইঙ্গিত পাচ্ছিলেন? 

আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে আম্পায়ারের দায়িত্ব পালন করছিলেন যে দুজন, সেই ইমরান পারভেজ আর মাহফুজুর রহমান প্রসঙ্গে স্ততিবাক্যই শুনেছি খেলোয়াড় মহলে। ব্রাদার্স-ওল্ড ডিওএইচএস ম্যাচের এক প্রান্তের আম্পায়ার গাজী সোহেলও পেয়েছেন 'খুব ভালো'-র স্বীকৃতি। সেই তাঁরাই কেন এমন সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন এবার?

ওপর মহলের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে হয় আম্পায়ারদের, বাংলাদেশের ক্রিকেটে এটা আর এখন অজানা কোনো তথ্য নয়।। আজ সকালেই প্রথম আলোর ক্রীড়া বিভাগের প্রধান তারেক মাহমুদের একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম, যেখানে তিনি লিখেছেন, 'ভুল আউটের প্রতিবাদ জানিয়ে ব্যাটসম্যান উইকেটের ওপর বসে আছেন। খেলা বন্ধ। আম্পায়ার খেলোয়াড়কে অনুনয় করে বলছেন, "আমার কিছু করার নেই। আজ তোমাদের হারাতেই হবে। নইলে আমি আর ম্যাচ পাব না।" বছর দুয়েক আগে ফতুল্লা স্টেডিয়ামে এমন দৃশ্যেরও অবতারণা হয়েছে।' আমাদের ক্রিকেট পরিবেশই আম্পায়ারদের এমন পরিস্থিতিতে ঠেলে দিচ্ছে কি না, সেই সংশয়ও জাগছে।

ঘরোয়া ক্রিকেট নিয়ে এসব কথাবার্তা অনেক দিন ধরেই হয়ে আসছে। তবে এবার সামান্যতম স্খলন দেখলেও সংশয় দানা বাঁধছে বেশ বড় আকারে। এবার যে আবার নির্বাচনী মৌসুম।সুপার লিগের ছয় ক্লাব থেকে দুজন করে কাউন্সিলর থাকার অদ্ভুত যে নিয়ম, সেটা সুপার লিগে ওঠাটাকে খেলোয়াড়ি গৌরবের চেয়েও অন্য কারণে বেশি গুরুত্বপূর্ণ করে তুলেছে। অন্যান্য মৌসুমেই যেখানে আম্পায়ারদের ওপর এত প্রভাব খাটানোর অভিযোগ উঠেছে, এবার তো সেটি করার প্ররোচনা আরও বেশি। প্রশ্নটা বিসিবির গদি রক্ষা করা।

সালিবকে দেখা গিয়েছিল এমন রুদ্ররূপেও। ছবি: ইউটিউব

আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের সেই জৌলুস গত হয়েছে বেশ কয়েক বছর আগেই। কিন্তু মরা হাতির দামও যেহেতু লাখ টাকা, ম্যাচটি তাই বিসিবির তরফ থেকে বাড়তি সমাদর প্রত্যাশা করতেই পারত। বিসিবি কি তা দিয়েছিল? সাধারণত ম্যাচ শেষ হওয়ার রাতেই খেলোয়াড়ের শাস্তি বিধান করেন ম্যাচ রেফারি। সাকিবের ক্ষেত্রে সেজন্য ২৪ ঘণ্টারও বেশি অপেক্ষা করতে হলো। তাই, ম্যাচ রেফারি তাঁর কাজে কতটুকু দক্ষতার পরিচয় দিলেন, এই প্রশ্নও তোলা যায়। এবারের আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে রেফারির দায়িত্ব পালন করেছেন মোরশেদুল আলম, যিনি নিজে বিসিবির অধীনস্থ একজন চাকুরে। তাঁর বদলে নিয়ামুর রশীদ রাহুল কিংবা আরও অভিজ্ঞ কোনো ম্যাচ রেফারিকে ওই আসনে বসানোটা যৌক্তিক হতো বলেই মনে হচ্ছে। যেমন মনে হচ্ছে, ইমরান পারভেজ কিংবা মাহফুজুর রহমানের জায়গায় মাঠে শরফুদ্দৌলা ইবনে সৈকত, মাকসুদুর রহমান মুকুল বা গাজী সোহেলের কেউ থাকলে হয়তো এমন অপ্রীতিকর কিছু না-ও ঘটতে পারত।

প্রসঙ্গ সমাপনে বলতে চাই, আমাদের ক্রিকেটের নৈতিক পচন এখন সংক্রমণে পর্যায়ে উন্নীত। নৈতিকতায় উজ্জ্বল নতুন ক্রিকেট সমাজের জন্য প্রবলভাবে প্রয়োজন সাংগঠনিক সততা, আম্পায়ারদের ওপর খেলোয়াড়দের আস্থা। যা আমাদের খেলোয়াড়দের কেবল মাঠের ক্রিকেট নিয়েই ভাবতে উদ্বুদ্ধ করবে, করতে দেবে নিবিষ্ট অনুশীলন।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×