সাকলায়েন মুশতাকের একান্ত সাক্ষাৎকার

`আমি ব্যাটসম্যানদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলব`

উৎপল শুভ্র

১১ জুন ২০২১

`আমি ব্যাটসম্যানদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলব`

সাকলায়েন মুশতাক

তারকা খ্যাতি জুটে গিয়েছিল ক্যারিয়ারের শুরুতেই। ওয়ানডেতে সবচেয়ে কম বয়সে, সবচেয়ে কম ম্যাচ খেলে দেড় শ উইকেটের মাইলফলক ছোঁয়ার পর তো আরও বেশি। কিন্তু পা দুটো সব সময়ই মাটিতেই ছিল পাকিস্তানি অফ স্পিনারের। ১৯৯৮ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপের সময় ঢাকার হোটেল রুমে সাকলায়েন মুশতাকের ইন্টারভিউয়ের আবরণে অন্তরঙ্গ আড্ডাই হয়েছিল। বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছিল যে এর অনেক আগেই।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ১৯৯৮। ভোরের কাগজ।

বয়স মাত্র ২১, খেলেছেন মাত্র ৭৮টি ওয়ানডে, অথচ তাঁর নামের পাশে উইকেটের সংখ্যা ১৫২। ওয়ানডেতে সবচেয়ে কম ম্যাচে উইকেটের সেঞ্চুরির রেকর্ডটি তাঁর, তাঁর চেয়ে কম ম্যাচ খেলে ১৫০ উইকেটও কেউ পায়নি। সবচেয়ে কম ম্যাচে, সবচেয়ে কম সময়ে এবং সবচেয়ে কম বয়সে আরেকটি মাইলফলকে পৌঁছানোর বিশ্ব রেকর্ড গড়ার পর সাকলায়েন মুশতাকের প্রথম যে প্রতিক্রিয়া, তাতেই লুকিয়ে আছে তাঁর সাফল্যের রহস্য। গতকাল ঢাকা স্টেডিয়াম থেকে হোটেলে ফিরেই দেওয়া এই একান্ত সাক্ষাৎকারের শুরুতে বলে ফেলেছিলেন, ‘আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি।’ তখন তিনি বিছানায় আধশোয়া। হঠাৎ করেই উঠে বসলেন এবং যোগ করলেন সংশোধনী, ‘নো, নো, আই অ্যাম নট ভেরি হ্যাপি। ইউ ক্যান সে আই অ্যাম হ্যাপি। এখনও আমি এমন কিছু করে ফেলিনি। যদি কোনোদিন সে রকম কিছু করতে পেরেছি বলে মনে হয়, সেদিন তোমাকে বলব, “আই অ্যাম ভেরি হ্যাপি”।’

এই ছবিটা ইন্টারভিউ নেওয়ার পরের বছরের। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হ্যাটট্রিকের পর সাকলায়েন মুশতাক। ছবি: গেই ইমেজেসবিশ্বের সেরা অফ স্পিনার হিসেবে তাঁকে এখন মেনে নিয়েছেন সবাই, তারপরও আত্মতৃপ্ত হওয়াটা সাকলায়েনের চরিত্রে নেই। তাঁর মুখে এর আগেও অনেকবার শোনা কথাটা উচ্চারিত হলো আবারও, ‘আমি নিজেকে এখনও ক্রিকেটের নিচু ক্লাসের ছাত্র মনে করি। আমি এখনও শিখছি। চিরদিনই শিখতে চাই।’ এই অতৃপ্তি সাকলায়েনের এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা, তবে তারপরও বিশ্বরেকর্ড নিয়ে গর্বটা প্রকাশ করতে সমস্যা নেই। সেটা করলেনও, যদিও সেটাকে গর্ব না বলে প্রতিজ্ঞা বলাই ভালো, ‘আমি আরও অনেক রেকর্ড গড়তে চাই।’ তার পরই শুধরে দিয়ে বললেন, ‘রেকর্ড গড়তে চাই, কথাটা ঠিক নয়। আমার স্বপ্ন যদি বলেন, তা হলো প্রতিটি ম্যাচে দেশের জন্য নিজেকে উজাড় করে দেওয়া, দেশকে ম্যাচ জেতানো। তা করতে পারলে রেকর্ড তো এমনিতেই হবে।’

তা হচ্ছেও। যে স্টেডিয়ামে কাল ওয়ানডেতে ১৫০তম উইকেট পেলেন সাকলায়েন, সেই ঢাকা স্টেডিয়াম তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বেশ আবেগময় একটি জায়গা অধিকারে নিয়ে বসে আছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সাকলায়েন তাঁর প্রথম বলটি করেছিলেন এই মাঠেই। পুরো আন্তর্জাতিক ম্যাচ অবশ্য নয়। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে দ্বিতীয় সার্ক ক্রিকেটে খেলতে এসেছিলেন সাকলায়েন। সেটিই ছিল তাঁর প্রথম ট্যুর, সে বছরই পাকিস্তানের ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেক তাঁর। তিন বছরে সাকলায়েন মুশতাক কোথায় এসেছেন, এটা ভেবে যে কারোরই বিস্ময় জাগে, সাকলায়েনের জাগে না?

‘এতটা আসব, তা হয়তো ভাবিনি। তবে আমি ক্রিকেট খেলতে ভালোবাসি। ছোটবেলা থেকেই আমি ক্রিকেট খেলি হৃদয় দিয়ে, সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে। তাই একদিন দেশের পক্ষে খেলব-এই বিশ্বাসটা আমার সার্ক ক্রিকেটের সেই শুরু থেকেই ছিল। মনে পড়ে, সার্ক ক্রিকেটে আমার প্রথম ম্যাচে খেলতে নেমে খুবই নার্ভাস ছিলাম আমি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আমার প্রথম বলটিতে ক্যাচ দিয়েছিল ব্যাটসম্যান, যদিও উইকেটকিপার তা ফেলে দিয়েছিল। সেই মূহুর্তেই আমার সব নার্ভাসনেস চলে গেল, একেবারেই রিল্যাক্সড হয়ে গেলাম। কেন যেন নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে, আমাকে দিয়ে হবে’-যেন স্বপ্নাবিষ্টের মতো তিন বছর পেছনে তাকালেন সাকলায়েন।

কাউন্টি দিল সারে’তে যোগ দিয়ে লর্ডসে খেলার আশৈশব স্বপ্ন পূরণ হয়েছে মুশতাকের। ছবি: গেটি ইমেজেস’৯৪-এর ডিসেম্বরের সাকলায়েনের সঙ্গে ’৯৮-এর জানুয়ারির সাকলায়েনের অনেক পার্থক্য। মানুষ হিসেবে একটুও বদলাননি বলে দাবি করলেন, রুমে ঢোকার পরই যেভাবে স্বাগত জানালেন, তাতে পাওয়া গেল তার প্রমাণও, তবে অফ স্পিনার হিসেবে তিনি পেরিয়ে এসেছেন অনেকটা পথ। গত মৌসুমে ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেটে খেলেছেন সারের পক্ষে। সেখানেই তাঁর জীবনের স্মরণীয়তম ঘটনাটি ঘটেছে। সেই ছোট্টবেলায় লাহোরের জরিফ মেমোরিয়াল ক্রিকেট ক্লাবে খেলার সময় কখনও প্র্যাকটিসে ফাঁকি দিলে সেই ক্লাবের কোচ আহমেদ হাসান পর দিন সাকলায়েনকে বলতেন, ‘কাল যে প্র্যাকটিস করে এলে না? কী, লর্ডসে খেলতে গিয়েছিলে?’

আহমেদ হাসান তাঁর সব ছাত্রকেই এ কথা বলতেন। তাদেরই একজনের সত্যি সত্যি একদিন লর্ডসে খেলার সুযোগ হলো। কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে মিডলসেক্সের সঙ্গে সারের ম্যাচ।লন্ডন থেকে লাহোরে কোচকে ফোন করে সাকলায়েন বললেন, ‘স্যার, কাল আমি লর্ডসে খেলতে যাচ্ছি।’ আনন্দে কথা জড়িয়ে গিয়েছিল কোচের। পরদিন সাকলায়েন মিডলসেক্সের প্রথম ইনিংসে হ্যাটট্রিকসহ ২ রানে ৫ উইকেট পান, দ্বিতীয় ইনিংসে পান আরও ৫ উইকেট। রূপকথার গল্প তো এসব উপাদানেই তৈরি হয়!

বিশ্বের সেরা ওয়ানডে বোলার হিসেবে অনেকেই তাঁর নাম করেন এখন। অথচ টেস্ট ক্রিকেটেও একই রকম সফল সাকলায়েন। তবে মাত্র ১৩ টেস্টে ৫৬ উইকেট নেওয়ার পরও কখনও কখনও বাইরে বসে থাকতে হয় তাঁকে। একজন স্পিনার খেলালে লেগ স্পিনার মুশতাক আহমেদের দিকেই বেশি পক্ষপাত থাকে পাকিস্তানের। এ নিয়ে আক্ষেপ থাকলেও তা প্রকাশ করলেন না সাকলায়েন, তবে জানালেন, এখন পর্যন্ত বোলিংয়ে তাঁর সবচেয়ে স্বপ্নের দিনটি এসেছিল টেস্ট ক্রিকেটেই। ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে প্রথম দুই টেস্টে আমি বাইরে বসে ছিলাম, কিন্তু ওই কদিনে আমি অনেক কিছু শিখছি। বোলিং প্র্যাকটিস করে গেছি, ওদের ব্যাটসম্যানদের দেখেছি। তারপর যখন তৃতীয় টেস্টে সুযোগ এলো, ৯ উইকেট নিয়ে আমি ম্যান অব দ্য ম্যাচ হলাম। সেদিন বোলিং করার সময় অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়েছিল আমার। যেন বাতাসের ঢেউ, বাতাসের মধ্য দিয়ে যাওয়া বলের গতিপথটাও পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম আমি। আমার হাতে বলটি ছিল যেন এক রিমোট কন্ট্রোল, যা দিয়ে আমি যা ইচ্ছে তাই করতে পারি। এ ধরনের অনুভূতি আগেও হয়েছে আমার, তবে কখনও এমন করে নয়।’

২০০১ সালে ট্রেন্টব্রিজে দুই সতীর্থ ওয়াকার ইউনিস ও মোহাম্মদ ইউসুফের সঙ্গে সাকলায়েন। ছবি: গেটি ইমেজেসএই পার্থক্যটা মাঝে মধ্যেই টের পান সাকলায়েন মুশতাক, কোনো ম্যাচে সবকিছুই নিজের নিয়ন্ত্রণে বলে মনে হয়, কখনও বা হঠাৎ করেই বোলিংটা সেভাবে এনজয় করতে পারেন না। তবে ব্যাটসম্যানদের জন্য দুঃখের ব্যাপার, দ্বিতীয় ব্যাপারটি ঘটে খুব কমই। তাদের জন্য আরেও দুশ্চিন্তার খবর হচ্ছে, সাকলায়েন মুশতাক তাঁর বোলিংয়ে নতুন দু’একটা অস্ত্র যোগ করার সাধনায় নেমেছেন। ‘দুদিকেই বল ড্রিফট করানো প্রায় আয়ত্তে চলে এসে গেছে। বিগ লুপিং একটা বলও প্র্যাকটিস করছি। আগামী দু’এক মাসের মধ্যেই এটি ম্যাচে করা শুরু করব’-সাকলায়েনের এ কথার পর মনে চিন্তাটা এলোই, এরপর ব্যাটসম্যানদের কী হবে?

মনের চিন্তাটা প্রশ্নাকারে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতেই সাকলায়েন এতক্ষণের সিরিয়াস ভঙ্গি পাল্টে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে তুললেন। তারপর ঘোষণা করলেন, ‘আমি ব্যাটসম্যানদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলব, ইনশাল্লাহ!’

সংযোজন: যে লর্ডসে প্রথম খেলে হ্যাটট্রিকসহ ২ রানে ৫ উইকেট নিয়ে ছেলেবেলার কোচকে ফোন করেছিলেন, এই ইন্টারভিউ নেওয়ার পরের বছর সেই লর্ডসেই বিশ্বকাপে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছেন সাকলায়েন। ওয়াসিম আকরামকে ছুঁয়েছেন ওয়ানডেতে দুটি হ্যাট্রটিকের কীর্তিতে। 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×