সময় থমকে আছে যে স্টেডিয়ামে

বিশ্বকাপ ২০০৬ ডায়েরি

উৎপল শুভ্র

১০ জুন ২০২১

সময় থমকে আছে যে স্টেডিয়ামে

বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়াম। ১৯৩৬ অলিম্পিকের মূল রঙ্গমঞ্চ, যে অলিম্পিক অন্য কোনোটার মতো নয়। ছবি: গেটি ইমেজেস

বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে গেলে আপনার জেসি ওয়েন্সকে মনে পড়বেই পড়বে, অ্যাডলফ হিটলারকেও। বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব সর্বশেষ ওই অলিম্পিক যেমন ওয়েন্সের কীর্তিধন্য, তেমনি সেটি আলাদা হয়ে আছে হিটলারের আরিয়ান শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের চেষ্টার কারণেও। ২০০৬ বিশ্বকাপের সময় ওই স্টেডিয়ামে উৎপল শুভ্রর মনে হয়েছিল, সময় থমকে আছে এখানে, যা বর্তমান থেকে এক টানে নিয়ে যেতে চায় ৭০ বছর পেছনে।

প্রথম প্রকাশ: ১৪ জুন ২০০৬। প্রথম আলো।

২৪২ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে স্টেডিয়ামটা ঠিকঠাক করা হয়েছে বিশ্বকাপ ফুটবলের জন্যই। তারপরও এই সুযোগে স্টেডিয়ামের ভেতরে না হোক, বাইরে হলেও জেসি ওয়েন্সের একটা মূর্তি-টুর্তি বানিয়ে ফেলতে পারতেন আয়োজকরা। মূর্তি না হলেও কোথাও কোনো একটা স্মারকচিহ্ন, তাহলে স্টেডিয়ামটা সম্পূর্ণ হতো।

বিশ্বকাপের ফাইনালও যোগ হতে যাচ্ছে এই মাঠের বায়োডাটায়, তারপরও এটির মূল পরিচয় তো বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়ামই। আর ১৯৩৬ সালের অলিম্পিক আর জেসি ওয়েন্স প্রায় সমার্থকই। তারপরও গত দু'দিন স্টেডিয়ামের চারপাশ তন্নতন্ন করে খুঁজেও জেসি ওয়েন্সের কোনো চিহ্ন পেলাম না। 

১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। ছবি: গেটি ইমেজেস

অলিম্পিকের চিহ্ন আছে। স্টেডিয়ামের মূল প্রবেশপথের পাশেই বিশাল তিনটি স্তম্ভে উৎকীর্ণ ৭০ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পূর্ব সর্বশেষ কোনো বৈশ্বিক ক্রীড়া আসরের ইতিহাস। মাঝখানের স্তম্ভে লেখা: একাদশ অলিম্পিক গেমস, বার্লিন, ১-১৬ আগস্ট, ১৯৩৬। দু পাশের দুটিতে সেই অলিম্পিকে সোনাজয়ীদের নাম। বাঁ পাশে ছেলেদের, ডান পাশে মেয়েদের। সবই জার্মান ভাষায় এবং মার্টিন শাফার্স নামে ২৭ বছর বয়সী জার্মান স্বেচ্ছাসেবকের সাহায্য ছাড়া মাঝেরটি বাদে বাকি দুটি স্তম্ভের মর্মোদ্ধার করার সাধ্য ছিল না।

জেসি ওয়েন্স একদমই নেই, এটা বলা অবশ্য ঠিক হলো না। স্টেডিয়ামের পাশের রাস্তাটাই তাঁর নামে। রাস্তার নামকরণের চেয়েও বেশি কিছু আশা করেছিলাম বলেই হয়তো সেটিকে তেমন কোনো ব্যাপার বলে মনে হলো না। বলতে পারেন, জেসি ওয়েন্সের চিহ্ন থাকবেই বা কেন? তিনি তো আর জার্মানির কেউ নন। ম্যারাডোনাই কি মেক্সিকোর? তারপরও মেক্সিকো সিটির আজটেকা স্টেডিয়ামের সামনে ঠিকই তো দাঁড়িয়ে গেছে ম্যারাডোনার মূর্তি। ১৯৮৬ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে সেই অবিস্মরণীয় দ্বিতীয় গোলের স্মারক। অথচ ১৯৩৬ অলিম্পিকে জেসি ওয়েন্স যা করেছিলেন, সেটির তাৎপর্যের কাছে ম্যারাডোনার গোল তো শুধুই একটা গোল। আর জেসি ওয়েন্স দেশ-জাতির সীমানা ছাড়িয়ে সব মানুষের জয়ের গল্প।

বিজয় মঞ্চে জেসি ওয়েন্স। ১৯৩৬ অলিম্পিকে ১০০ মিটারে সোনা জয়ের পর। ছবি: গেটি ইমেজেস

১০০ ও ২০০ মিটার দৌড়, লং জাম্প ও ৪০০ মিটার রিলেতে সোনা। এক অলিম্পিকে অ্যাথলেটিকসে চার সোনা জয়ের এই রেকর্ডের পুনরাবৃত্তি হতে প্রায় অর্ধ শতাব্দী লেগেছে। তবে ওয়েন্সের ওই কীর্তি তো শুধুই অ্যাথলেটিকসে আবদ্ধ থাকার নয়। সেটি স্মরণীয় ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য’—এই পতাকা তুলে ধরার কারণে। ১৯৩৬ বার্লিন অলিম্পিক ইতিহাসে পরিচিত ‘নাৎসি অলিম্পিক’ নামে। এডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদের আগুন জ্বালাতে শুরু করার আগেই বার্লিনের অলিম্পিক আয়োজক হওয়া নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল। ‘আরিয়ান’ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের যে ‘গুরুদায়িত্ব’ কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, সেটির একটি বাহন হিসেবেই অলিম্পিককে দেখেছিলেন হিটলার। জার্মানি পদক তালিকার শীর্ষে থাকায় সেই লক্ষ্য হয়তো পূরণও হয়েছিল, তবে জেসি ওয়েন্সের ওই অলিম্পিকের অবিসংবাদিত তারকা হয়ে যাওয়াটা একটু সমস্যাই করেছিল। হিটলারের অনেক গুণের মধ্যে বর্ণবাদও ছিল, কালো একজন আফ্রিকান-আমেরিকানের এমন হিরো হয়ে যাওয়াটা তো তাঁর মতাদর্শেরই পরাজয়।

ওয়েন্স প্রথম সোনাটি জেতার পর তাঁর সঙ্গে করমর্দন করতে হবে বলে হিটলার স্টেডিয়াম ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন বলেই এত দিন জেনে এসেছেন সবাই। ইদানীং আবার কেউ কেউ বলছেন, এটা মোটেই ঠিক নয়। সেই অলিম্পিকে হিটলার প্রথম দিনের পর কারও সঙ্গেই করমর্দন করেননি। প্রথম দিন শুধু জার্মান বিজয়ীদের অভিনন্দন জানানোর পর আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি থেকে তাঁকে বলা হয়, নিরপেক্ষতা বজায় রাখার স্বার্থে হয় তাঁকে সবার সঙ্গেই করমর্দন করতে হবে, নয়তো কারও সঙ্গেই নয়। হিটলার কারও সঙ্গেই না করার সিদ্ধান্ত নেন।

বার্লিন অলিম্পিক স্টেডিয়ামে খোদাই করে লেখা আছে ১৯৩৬ অলিম্পিকের সব বিজয়ীদের নাম। ছবি: গেটি ইমেজেস

স্টেডিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার কথাটা সত্যি হোক বা না হোক, ওয়েন্সের ওই সাফল্য যে হিটলারের উদ্দেশ্য পূরণের পথে একটা কাঁটা বলেই মনে হয়েছিল, এটা তো সত্যিই। সেই অলিম্পিকের আগে স্টেডিয়ামের সামনে নির্মিত বিশাল একটা ঘোড়ার সঙ্গে দাঁড়িয়ে থাকা একই উচ্চতার এক মানবমূর্তি এখনো আছে। মার্টিন শাফার্স জানালেন, ওই সময় সব কিছুতে জার্মানদের ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ দেখানোর নাৎসি প্রোপাগান্ডা থেকেই এটির সৃষ্টি। মার্টিন শিল্পমনা, চিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করা তাঁর নেশা এবং পেশা। হিটলার, তাঁর নাৎসি দর্শন, সেই সময়টাকে তিনি কীভাবে দেখেন?

এতক্ষণ খুব সপ্রতিভ মনে হওয়া মার্টিন ঘোড়া আর মানুষের ওই যুগলবন্দীর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘মিশ্র একটা অনুভূতি হয়। যা হয়েছে, তা হওয়া উচিত হয়নি—এ নিয়ে তো কোনো প্রশ্নই থাকতে পারে না। তবে এটাই বা আমাকে বলতে হবে কেন? আমার জন্ম ১৯৬৯ সালে, আমি তো এর কিছুর জন্যই দায়ী নই, অথচ আমাদের নিয়মিতই এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।’

কিছুদিন আগে অবশ্য মার্টিন শাফার্স একটা সান্ত্বনা পেয়েছেন। ‘আমেরিকা যখন ইরাকে হামলা করল, জার্মান সরকার এতে হাত মেলাতে রাজি হয়নি। এরপর থেকে কিছুটা ভালো বোধ করছি’—মার্টিনের মুখে আবার ফিরে এলো ঝকঝকে সেই হাসি।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×