একবার না পারিলে দেখ ছয়বার

উৎপল শুভ্র

৩ জুন ২০২১

একবার না পারিলে দেখ ছয়বার

চ্যাম্পিয়ন পাকিস্তান দলের অধিনায়ক মঈন খানের হাতে ট্রফি তুলে দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: গেটি ইমেজেস

বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেলেও এশিয়া কাপটা আক্ষেপের অন্য নামই হয়ে ছিল পাকিস্তানের জন্য। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের এই ট্রফিটা ধরা দিচ্ছিল না কিছুতেই। অবশেষে এই ঢাকাতেই প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ নিয়ে শিরোপা উৎসব করেছিল পাকিস্তান। ২০০০ সালের এশিয়া কাপের ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়েছিল ৩৯ রানে।

প্রথম প্রকাশ: ৮ জুন ২০০০। প্রথম আলো।

কিছুদিন আগেও পাকিস্তানি ফিল্ডিং ছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে হাসাহাসির বিষয়। শ্রীলঙ্কার ফিল্ডিং দেখে পাকিস্তান সমর্থকেরা আফসোসে পুড়ত—ইশ, আমাদের দল যদি মাঠে এমন চেহারায় দেখা দিত! সপ্তম এশিয়া কাপ ফাইনালটি যদি কারও দেখা প্রথম ক্রিকেট ম্যাচ হয়ে থাকে, তাহলে একটু পড়ে হতবাক হয়ে যাবেন তিনি। কারণ কাল বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে শ্রীলঙ্কার ফিল্ডিং নিয়েই হাসাহাসি হয়েছে আর পাকিস্তান করেছে চোখ ধাঁধানো ফিল্ডিং।

মঈন খান আর ইনজামাম-উল-হক শেষ ১০ ওভারে চার আর ছয়ের ফুলঝুরি ছুটিয়েছেন, মোহাম্মদ আকরাম তাঁর প্রথম ৪ ওভারের মধ্যেই তুলে নিয়েছেন ২ উইকেট, দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে ওয়াসিম আকরামও তা-ই—তবে এসব কিছুই নয়, দু'দলের পুরো বিপরীত চেহারার ফিল্ডিংই আসলে নির্ধারণ করে দিয়েছে ফাইনালের ভাগ্য। পাকিস্তানের ‘এশিয়া কাপ দুঃখ’-ও মুছেছে এর মাধ্যমে। ওয়ানডে ক্রিকেটের প্রায় সব শিরোপা জয়ের পরও পাকিস্তানের বড় একটা আক্ষেপ হয়ে ছিল এই এশিয়া কাপ। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাওয়ার পরও কাগজে-কলমে মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্ব পাওয়া হয়নি তাদের। ষষ্ঠবারের চেষ্টায় তা পেল পাকিস্তান। শারজা এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজে টানা দুটি ওয়ানডে টুর্নামেন্ট জয়ের পর এই এশিয়া কাপ সাফল্যে হলো শিরোপার হ্যাটট্রিকও।

আরেকটি ব্যাপারও হয়েছে এর সঙ্গে। বাংলাদেশের মাটিতে পাকিস্তানের সাফল্য না পাওয়ার ইতিহাসেরও সমাপ্তি হলো এতে। গত বছর মার্চে এই মাঠেই অনুষ্ঠিত ফাইনালে শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছিল তারা, ’৯৭ সালে জিতেছে সার্ক ক্রিকেটও। তবে বাংলাদেশে সত্যিকার ওয়ানডে টুর্নামেন্ট জিতল পাকিস্তান এই প্রথম। ’৮৮ সালে দ্বিতীয় এশিয়া কাপ, ’৮৯ সালে এশীয় যুব ক্রিকেট এবং ’৯৮-এর জানুয়ারিতে ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ ব্যর্থতার যন্ত্রণাটা প্রথমবারের মতো এশিয়া কাপ জিতে নিশ্চয়ই ভুলে গেছে পাকিস্তান।

টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করা পাকিস্তান গড়েছিল বিশাল একটা সংগ্রহই। ৫০ ওভারে ২৭৭ রানের ইনিংসে হাফ সেঞ্চরি আছে ৩টি—তারপরও সাঈদ আনোয়ার (৮২), ইনজামাম-উল-হক (৭২), ও মঈন খান (৫৬)-এর চেয়েও এতে বড় ‘কৃতিত্ব’ শ্রীলঙ্কান ফিল্ডারদের। আরও নির্দিষ্ট করে বললে শ্রীলঙ্কানদের ক্যাচ ছাড়ার প্রতিযোগিতার। এই পর্যায়ের ক্রিকেটের জন্য অবিশ্বাস্য দৃশ্যের অবতারণা ঘটিয়ে একের পর এক ক্যাচ ছেড়েছে শ্রীলঙ্কনরা। মোটামুটি পাকিস্তানের সব ব্যাটসম্যানই দুটি-তিনটি করে ইনিংস খেলেছেন এর কল্যাণে। তবে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগিয়েছেন তা মঈন খান। ১৬ ও ১৭ রানে দুবার ‘লাইফ’ পাওয়ার পর ইনজামামকে সঙ্গী করে শেষ ১০ ওভারে ১০৪ রান তুলেছেন পাকিস্তান অধিনায়ক, এর মধ্যে শেষ ৩ ওভারে এসেছে ৫৬! মঈন খানের রানও ৫৬, এজন্য তাঁকে খেলতে হয়েছে মাত্র ৩১ বল, মেরেছেন ৩টি চার ও ৪টি ছক্কা।

উপমহাদেশের উইকেটে একাধিকবার ২৭৭ রান সাফল্যের সঙ্গে তাড়া করার রেকর্ড আছে শ্রীলঙ্কার। তবে সে সবে মূল ভূমিকা রেখেছিল প্রথম ১৫ ওভারে তোলা ঝড়। সেই ঝড় তোলার জন্যই ওয়ানডে ক্রিকেটকে বদলে দেওয়া ওপেনিং জুটি সনাৎ জয়াসুরিয়া-রুমেশ কালুভিতারানা এক হয়েছিলেন আবার। কিন্তু কোনো বল খেলারই সুযোগ পেলেন না ‘কালু’। তৃতীয় বলেই জয়াসুরিয়ার ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে তিনি রান আউট। থ্রো'টি করেছিলেন সাঈদ আনোয়ার, ভালো ফিল্ডার হিসেবে যাঁর খ্যাতি ছিল না কোনোকালেই। আনোয়ারের এই্ কীর্তিতে আরও উজ্জীবিত হয়েই কি না, বাকি সময়টা দুর্দান্ত ফিল্ডিং করল পাকিস্তান। ইমরান নাজির, শহীদ আফ্রিদি এমনিতেই ভালো ফিল্ডার, ইনজামামের ইনজুরি মাঠে নামার সুযোগ করে দিয়েছিল (নাকি সুযোগ করে নিয়েছিল পাকিস্তান?) তরুণ শোয়েব মালিককেও। রীতিমতো দর্শনীয় হলো তাই পাকিস্তানের ফিল্ডিং। একটি ক্যাচও ফেলেনি তারা, পরে শহীদ আফ্রিদির দুর্দান্ত ডিরেক্ট থ্রোতে রান আউট হয়েছেন মাহেলা জয়াবর্ধনেও। সেটি ম্যাচের খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়ে, বলতে গেলে ম্যাচের ফলাফলও নিষ্পত্তি হয়েছে এই রান আউটটিতেই।

পাকিস্তানের বিপক্ষে ভালো খেলাটা যাঁর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, সেই মারভান আতাপাত্তুর সঙ্গে রাসেল আরনল্ডের গড়া ১৪.২ ওভারে ৭৯ রানের জুটিটি মাত্রই শেষ হয়েছে তখন। আরনল্ড যেভাবে খেলছিলেন তাতে পাকিস্তান নিশ্চিতভাবেই আতঙ্কিত বোধ করছিল, তবে ডিপ স্কোয়ার ক্যাচ দিয়ে আরনল্ড আউট হওয়ার পরও ম্যাচে অনিশ্চয়তা ছিল। ৬২ বলে শ্রীলঙ্কার প্রয়োজন তখন ৮২ রান। কঠিন, কিন্তু আতাপাত্তু-জয়াবর্ধনের একটা জুটি দাঁড়িয়ে গেলে তা একেবারে অসম্ভব কিছু ছিল না। কিন্তু সেই জুটিকে মাত্র ৬ রানের বেশি বাড়তেই দিল না শহীদ আফ্রিদির ডিরেক্ট থ্রো।

মারভান আতাপাত্তু এরপরও লড়ে গেছেন, এক ধরনের পরাজয় মেনে নিয়েই লড়ে যাওয়া। বেশিক্ষণ অবশ্য নয়, ক্ল্যাসিক্যাল ব্যাটসম্যানশিপের আরেকটি অনুপম প্রদর্শনীতে ওয়ানডেতে তাঁর চতুর্থ সেঞ্চুরির করার পরপরই কট বিহাইন্ড হয়ে গেছেন দ্বিতীয় স্পেলে ফেরা ওয়াসিম আকরামের বলে। প্রথম স্পেলে উইকেটশূন্য থাকা এই বাঁহাতি ‘গ্রেট’ই তাঁর একটি ট্রেডমার্ক ইয়র্কারে বোল্ড করেছেন একটি বিশাল ছক্কাসহ ১৬ বলে ২৪ রান করা উপুল চন্দনাকে। এই ২৪-ই শ্রীলঙ্কান ইনিংসে তৃতীয় সর্বোচ্চ স্কোর। আতাপাত্তুর ঠিক ১০০ রানের ইনিংসটি কাছাকাছি দাঁড়াতে পারে শুধু রাসেল আরনল্ডের ৪৪ বলে করা ৪১। আতাপাত্তু ও রাসেল আরনল্ডের ওপরও শ্রীলঙ্কা ভরসা করে নিশ্চয়ই, তবে এত বড় একটা টার্গেট তাড়া করতে যে দুজনের ওপর তাদের মূল নির্ভরতা, সেই জয়াসুরিয়া (২২) আর অরবিন্দ ডি সিলভা (২০) দুজনেই আটকে গেছেন ২০-এর ঘরে। শ্রীলঙ্কার ২৭৮ রান করতে না পারার মূল কারণ এটাই। মোহাম্মদ আকরামের বলে রির্টান ক্যাচ দেওয়ার আগে ভালোই খেলছিলেন জয়াসুরিয়া, কিন্তু অরবিন্দ ডি সিলভার ছায়া যেন ঘরে বেরিয়েছে উইকেটে, ৪৩ বল খেলেও তাঁর একটু বাউন্ডারি নেই, ভাবা যায়!

উল্টো দিকে পাকিস্তান ছিল উজ্জীবিত এক দল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে ৩৫ ঘণ্টার ৩৫ ঘণ্টার ভ্রমন শেষে ঢাকায় পৌঁছেই ক্লান্তিতে ঢুলুঢুলু  চোখ নিয়েও মঈন খান আর জাভেদ মিয়াঁদাদ ঘোষণা করেছিলেন, ‘এই একটি শিরোপা আমরা কখনও পাইনি। এবার তা পেতেই হবে।’ সেটি যে শুধু মুখের কথা নয়, টুর্নামেন্টের প্রতিটি ম্যাচই তার প্রমাণ রেখেছে পাকিস্তান। জয়ের তীব্র ইচ্ছে ফুটে বেরিয়েছে প্রতিটি খেলোয়াড়ের মধ্যে থেকে। টানা চারটি ম্যাচে পরিষ্কার ব্যবধানে জিতে সন্দেহাতীতভাবে টুর্নামেন্টের সেরা দল হিসেবেও প্রমাণ করেছে তারা নিজেদের। এই ট্রফিটি হাতে নেওয়ার জন্য কতটা অধীর হয়ে ছিল তারা—তাদের ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডং সব কিছু থেকেই বোঝা গেছে তা! সাফল্যের এমন উদগ্র ইচ্ছে থাকলে কোনো দলকে আটকানো যায় না।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×