হেডলি `ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান` না ব্র্যাডম্যান `হোয়াইট হেডলি`?

উৎপল শুভ্র

৩০ মে ২০২১

হেডলি `ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান` না ব্র্যাডম্যান `হোয়াইট হেডলি`?

জ্যামাইকাকে সবাই বলে বব মার্লের দেশ, এখন হয়তো উসাইন বোল্টেরও দেশ। কিন্তু আমার কাছে চিরকালই তা জর্জ হেডলির দেশ। অস্ট্রেলিয়ানরা তাঁকে বলত `ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান`, যা শুনে জ্যামাইকানরা প্রতিবাদ করে বলত, কেন, ব্র্যাডম্যানকেই বরং `হোয়াইট হেডলি` বলো না!

প্রথম প্রকাশ: ৫ জুন ২০০৪। প্রথম আলো।

জর্জ হেডলির সঙ্গে দেখা হলো। কিংস্টনের স্যাবাইনা পার্কে স্বাগত জানালেন তিনিই। ব্যাটিং করছেন, হুক শটের ফলো থ্রুতে থাকা জর্জ হেডলি বললেন, স্যাবাইনা পার্কে স্বাগতম। সঙ্গী যারা ছিলেন, তারা শুনতে পেলেন না। আমি ঠিকই শুনলাম।

শুনতে পেলাম, কারণ অনেকের কাছেই জ্যামাইকা বব মার্লের দেশ হতে পারে, আমার কাছে চিরদিনই তা জর্জ হেডলির দেশ। গত পরশু দুপুরে স্যাবাইনা পার্কে ঢোকার মুখেই জর্জ হেডলির সঙ্গে দেখা। স্টেডিয়ামের মূল প্যাভিলিয়নের বাইরে উঁচু বেদিতে বসানো জর্জ হেডলি, মাত্রই একটা হুক করেছেন। পুরো মূর্তিটাই নিকষ কালো। মৃত্যুর ২১ বছর পরও জর্জ হেডলি সবাইকে স্বাগত জানিয়ে যাচ্ছেন স্যাবাইনা পার্কে।

খেলেছেন ব্র্যাডম্যান-যুগে। অনেকেরই বিশ্বাস, ইংল্যান্ড বা অস্ট্রেলিয়ায় জন্ম হলে ক্রিকেটের ওই সময়টা শুধু ব্র্যাডম্যান-যুগ না হয়ে হেডলি-যুগও হতে পারত। অস্ট্রেলিয়ানরা তাঁর নাম দিয়েছিল ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান, জ্যামাইকার অনেকে প্রতিবাদ করে বলতেন, হেডলিকে ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান বলছ কেন, তার চেয়ে ব্র্যাডম্যানকেই হোয়াইট হেডলি বলো না কেন!

মাত্র ২২টি টেস্ট খেলেছেন, তাতেই ৬০.৮৩ গড়ে ২১৯০ রান, ১০টি সেঞ্চুরি, যার ২টি ডাবল। এভাবে হিসাব হয় না, তারপরও করার জন্য করাই যায়। টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি সেঞ্চুরির মালিক সুনীল গাভাস্কারের সমান ১২৫টি টেস্ট খেললে হেডলির সেঞ্চুরি হতো ৫৫টি! ১৯২৯-৩০ সালে ইংল্যান্ড সফরে জর্জ হেডলির অভিষেক, টেস্ট সিরিজে তাঁর ৮টি ইনিংস এ রকম : ২১, ১৭৬, ৮, ৩৯, ১১৪, ১১২, ১০ ও ২২৩।

স্যাবাইনা পার্ক স্টেডিয়ামের বাইরে হেডলির ভাস্কর্য

ব্র্যাডম্যানের দলে বিল পন্সফোর্ড ছিলেন, স্ট্যান ম্যাককেব ছিলেন, ছিলেন আর্থার মরিস, অ্যালান কিপ্যাক্সের মতো আরও বড় বড় ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ছিলেন হেডলি একা। ক্যারিয়ারের পুরোটা সময়ই তাঁর ব্যাটের দিকে তাকিয়ে থেকেছে দল, কোনো দিন নির্ভার হয়ে খেলতে পারেননি। তারপরও ওই পারফরম্যান্স।

অথচ তাঁর টেস্ট ক্রিকেটার হওয়ারই কথা ছিল না। বার্বাডিয়ান বাবা আর জ্যামাইকান মায়ের সন্তান জর্জ হেডলিকে পড়াশোনার জন্য ১০ বছর বয়সে জ্যামাইকাতে তাঁর মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বাবা তখন পানামায়, পানামা খাল কাটায় ব্যস্ত। সেখান থেকে বাবা-মা আমেরিকায় গিয়ে সেখানে জর্জ হেডলির ডাক্তারি পড়ার সব কিছু চূড়ান্ত করে ফেলেছিলেন। এখানেই ডাক বিভাগের কাছে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ক্রিকেটের অসীম কৃতজ্ঞতা। পানামা থেকে হেডলির কাছে পাঠানো আমেরিকা যাওয়ার কাগজপত্র আসতে দেরি হওয়াতেই না আজ স্যাবাইনা পার্কের বাইরে জর্জ হেডলির ওই মূর্তি। স্টেডিয়ামের মূল প্যাভিলিয়নটির নাম জর্জ হেডলি স্ট্যান্ড।

ব্যাটিং করছেন জর্জ হেডলি। ছবি: উইকিমিডিয়া

জর্জ হেডলির যে বছর আমেরিকা চলে যাওয়ার কথা, সেই ১৯২৮ সালেই ইংল্যান্ডের একটি ফার্স্ট ক্লাস দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে আসে। সফরের উদ্দেশ্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজকে টেস্ট স্ট্যাটাস দেওয়া যায় কি না, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া। সময়মতো কাগজপত্র চলে এলে জর্জ হেডলির তখন আমেরিকায় মানুষের দাঁত নিয়ে পড়ে থাকার কথা (দন্ত চিকিৎসকই হতে চেয়েছিলেন)। আছি যখন, খেলি ভেবে ইংল্যান্ডের ওই দলের বিপক্ষে জ্যামাইকার ম্যাচটিতে খেললেন। খেলে ১৮ বছরের জর্জ হেডলির দুই ইনিংস ১৮ ও ২২৮। এরপর আর আমেরিকা কীভাবে যান? ক্রিকেট কর্মকর্তা আর সমর্থক সবাই মিলে জর্জ হেডলিকে এমনভাবে ধরলেন যে, তাঁর জ্যামাইকাতেই থেকে যেতে হলো। বাকিটুকু যেমন বলা হয়, ইতিহাস।

হেডলিকে ‘ব্ল্যাক ব্র্যাডম্যান না বলে ব্র্যাডম্যানকেই যারা হোয়াইট হেডলি ডাকা উচিত বলে মনে করতেন, তাঁদের সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিল বাজে উইকেটে দুজনের পুরো বিপরীত পারফরম্যান্স। সে সময় উইকেট ঢাকার নিয়ম ছিল না, এক পশলা বৃষ্টি হয়ে যাওয়ার পর সেই উইকেট হতো ব্যাটসম্যানদের চূড়ান্ত পরীক্ষা। পরীক্ষাটা বেশি হতো ইংল্যান্ডেই। ১৯৩৩ ও ১৯৩৯ সালে ইংল্যান্ড সফরে এ রকম স্টিকি উইকেটে ১৩টি ইনিংস খেলে সাতবার পঞ্চাশ পেরিয়েছেন হেডলি। রে রবিনসনের কালজয়ী বই বিটুইন দ্য উইকেটস-এ বাজে উইকেটে ব্র্যাডম্যান আর হেডলির ব্যাটিংয়ের একটা তুলনা আছে। সেখানে রবিনসন দেখিয়েছেন, যে ধরনের উইকেটে ১৩টি ইনিংসে হেডলির ৭টি ফিফটি, ব্র্যাডম্যানের ১৫ ইনিংসে সেখানে ফিফটি মাত্র ১টি। ব্র্যাডম্যানের গড় ১৬.৬৬, হেডলির ৩৯.৮৫।

জর্জ হেডলি: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের গ্রেট ব্যাটসম্যানদের নাম শুরু হয় তাঁকে দিয়েই। ছবি: উইকিমিডিয়া

হেডলির মূর্তি আর তাঁর নামে স্যাবাইনা পার্কের মূল প্যাভিলিয়নের নাম থেকেই পরিষ্কার, তাঁদের প্রথম কালো অধিনায়ককে ভোলেনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ। পরশু যে ট্যাক্সিতে করে মাঠ থেকে হোটেলে ফিরলাম, সেটির ড্রাইভার মূর্তিটা দেখিয়ে বললেন, দেখেছ, ওটা জর্জ হেডলি! আরেকটু আলাপ করতে গিয়ে দেখলাম, শুধু ওই নামটুকুই জানা তাঁর। বইপত্রের জ্ঞান থেকে জানি, জর্জ হেডলির বাড়ি ছিল এই কিংস্টনের রায়ে টাউন নামে শহরতলিতে। কিন্তু রায়ে টাউন কোথায়, অনেককে জিজ্ঞেস করেও তা উদ্ধার করতে পারলাম না এখনো। তবে হাল ছাড়িনি।

জ্যামাইকা এসেও বব মার্লে জাদুঘর দেখে না যাওয়াটা অনেকের ভুরু কুঁচকে দিতে পারে। মার্লে মার্লের জায়গায় থাকুন, আমার কাছে জ্যামাইকাতে এসে জর্জ হেডলির বাড়ি না দেখে ফেরাটাই বেশি অপরাধ হবে বলে মনে হচ্ছে

সংযোজন: সুনীল গাভাস্কার যে সর্বোচ্চ সেঞ্চুরির মালিক নেই আর, তা তো জানেনই। ৫১ টেস্ট সেঞ্চুরি নিয়ে এখন সেই সিংহাসনটা তাঁরই এক স্বদেশির।  'শচীন টেন্ডুলকার' নামটা কি লেখার দরকার আছে? আর বব মার্লে জাদুঘরে পরে ঠিকই গিয়েছি। তাঁর বাড়িটাকেই তো জাদুঘরে রূপ দেওয়া হয়েছে। সেখানে ২০০৪ সালের এই ট্যুরে একবারই গিয়েছিলাম। ২০০৭ বিশ্বকাপের সময় অনেকবার। সেই গল্প পরে কোনো এক সময় বলা যাবে। 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×