ফরম্যাট বদলে ডিপিএল কেন, কী উদ্দেশ্যে?

এম. নাজমুল ইসলাম

২১ মে ২০২১

ফরম্যাট বদলে ডিপিএল কেন, কী উদ্দেশ্যে?

মিরপুর স্টেডিয়ামে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের ট্রফি উন্মোচন অনুষ্ঠান। দেশের একমাত্র লিস্ট `এ` প্রতিযোগিতা এবার রূপ নিয়েছে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের। ছবি: বিসিবি

আগামী ৩১ মে নতুন করে শুরু হচ্ছে করোনার কারণে স্থগিত হয়ে যাওয়া ২০১৯-২০ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ। ঐতিহ্যগতভাবে ৫০ ওভারের এই লিগ রূপ নিয়েছে টি-টোয়েন্টির। কিন্তু এর পেছনে অন্য কোনো কারণ লুকিয়ে নেই তো? সিসিডিএমের এক সময়ের সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যানের এমনই সন্দেহ। `সামনেই বিসিবি নির্বাচন`–এটা জানা থাকলে এই সন্দেহের কারণটা বুঝতে কোনো সমস্যা হবে না।

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের (ডিপিএল) যে স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাট, সেটা কিন্তু ৫০ ওভারের। বাংলাদেশের ডোমেস্টিক ক্রিকেটে যতগুলো ৫০ ওভারের খেলা হয়, তার মধ্যে একমাত্র ডিপিএলই লিস্ট 'এ' স্বীকৃতি পায়। এবারের যে লিগটা নতুন করে কর্তৃপক্ষ শুরু করতে চাচ্ছে, সেটা স্থগিত হয়ে যাওয়া ২০১৯-২০ মৌসুমের লিগ, এমনিতে যে লিগটা ২০১৯-য়ের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। সিসিডিএম অন্য যে লিগগুলো আয়োজন করে; ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন, থার্ড ডিভিশন–সব কিন্তু ওই সময়ের আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু প্রিমিয়ার লিগের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি, এমনকি ২০২০-য়ের জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি কিংবা মার্চেও শুরু করা যায়নি ডিপিএল। তারপর লিগ শুরু হলো, আর করোনা মহামারীও দেখা দিল বলে লিগটা স্থগিত হয়ে গেল।

এখানেই আমার দুটো প্রশ্ন আছে। এর আগে আমরা দেখেছি, সিসিডিএমের ক্যালেন্ডার থেকে ঢাকা লিগের পুরো একটা মৌসুম (২০১৩-১৪) হারিয়ে যেতে। এর একটাই কারণ দেখানো হয়েছিল, 'বিভিন্ন কারণে সিজন শুরু করার জন্য যথেষ্ট সময় নাই, আর সিজন শুরু করলেও তা শেষ করতে করতে পরবর্তী সিজনের সময় চলে আসবে। তো এই সিজন শুরু করলে এই সিজনটাও ঠিকমতো শেষ করা যাবে না, আর পরের সিজনটাও ঠিকঠাক শেষ করতে ঝামেলায় পড়তে হবে।' যে কারণে ২০১৩-১৪ মৌসুম পুরো বাদই হয়ে গেল, আবার ডিপিএল হলো নতুন ২০১৪-১৫ মৌসুমে।

কথাটা এ কারণে বলছি, আপনি যদি সময়কালটাকে নির্দিষ্ট রাখেন এবং সেই সময়ের মধ্যে লিগ শেষ করতে না পারেন, তাহলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। তো ২০১৩-১৪তে এক বছরের জায়গায় দেড় বছর লাগছিল বলেই ডিপিএলের একটা আসর বাতিল করা হলো, অথচ এবার কিন্তু তিন বছর (২০১৯-২১) লাগছে এটি শেষ করতে। অতীতে যেসব যুক্তি দেখিয়ে একটা মৌসুমে ডিপিএল বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, সেসব সিদ্ধান্তের আলোকে এই মৌসুমটাও এমনিতেই বাতিল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু সিসিডিএম এর সাম্প্রতিক তোড়জোড় অন্য কথাই বলছে।

এমন অবশ্য কেউ বলতেই পারেন যে, বৈশ্বিক একটা মহামারীর এই সময়ে ব্যতিক্রম তো হতেই পারে। হ্যাঁ, এবার যেহেতু করোনার কারণে বিশেষ একটা অবস্থা, মৌসুমটা দীর্ঘায়িত হতেই পারে। তবে সেক্ষেত্রে তো ফরম্যাটটাকে একই রাখতে হবে, অন্য সবগুলো লিগ যেভাবে হয়েছে। সিসিডিএমের অন্য লিগগুলো; ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড ডিভিশন, থার্ড ডিভিশন থেকে এই প্রিমিয়ার লিগ তো আলাদা না। কিন্তু বাকি তিনটা লিগের ফরম্যাট থেকে একদমই আলাদা করে দিয়ে ২০ ওভারের প্রিমিয়ার লিগ আয়োজন করাটা কতটুকু যুক্তিযুক্ত, আমি জানি না। আগে যদি প্রিমিয়ার লিগের কোনো খেলাই যদি না হতো, তা-ও একটা কথা ছিল। কিন্তু কিছু খেলা তো হয়েছিল, সে সব খেলার রেজাল্টকে পুরোপুরি বাদ দিয়ে আবার নতুন করে কার স্বার্থে শুরু করা হচ্ছে, এই সিদ্ধান্তটাও বুঝতে পারছি না আমি।

এভাবে হন্তদন্ত হয়ে প্রিমিয়ার লিগ পুনরায় আয়োজন করার চেষ্টা দেখেই আমার মনে আরও একটা প্রশ্ন জাগছে। এবার যেহেতু ভোটের বছর, হয়তো এমন কিছু একটা আছে যে, লিগটা শেষ না করলে কাউন্সিলরদের যে একটা প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকে, সেই সমীকরণটা পুরোপুরি বদলে যাবে।

এভাবে হন্তদন্ত হয়ে প্রিমিয়ার লিগ পুনরায় আয়োজন করার চেষ্টা দেখেই আমার মনে আরও একটা প্রশ্ন জাগছে। এবার যেহেতু ভোটের বছর, হয়তো এমন কিছু একটা আছে যে, লিগটা শেষ না করলে কাউন্সিলরদের যে একটা প্রভাব-প্রতিপত্তি থাকে, সেই সমীকরণটা পুরোপুরি বদলে যাবে। মানে, কে কাউন্সিলর হবে, কে হবে না; এমন কিছু হয়তো বা পরিবর্তন হয়ে যাবে লিগটা শেষ না করা গেলে। কারণ বিসিবির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, লিগ শেষে যে স্ট্যান্ডিংটা হয়, তার ভিত্তিতে কাউন্সিলরশিপ ঠিক হয়। সেই গঠনতন্ত্রেই কিন্তু বলা আছে, কোনো মৌসুমের খেলা যদি কোনো কারণে শেষ করা না যায়, তবে ওই মৌসুমের কোনো কিছুই আমলে নেওয়া যাবে না। সর্বশেষ সমাপ্ত মৌসুমের ভিত্তিতেই সবকিছু বিবেচনায় নিতে হবে। যে ২০১৯-২০ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগই এখনো শেষ হয়নি, নিয়মের বাইরে গিয়ে সেটিকে জোর করে শেষ করা হচ্ছে দেখে বলে আমার মনে প্রশ্ন জাগছেই। সিসিডিএমের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আমি এখন সরাসরি জড়িত নেই, দূর থেকে দেখছি বলেই হয়তো প্রশ্নটা আরও জোরালো হয়ে উঠছে।

ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ ঐতিহ্যগতভাবেই ৫০ ওভারের লিগ, দেশের একমাত্র লিস্ট `এ` প্রতিযোগিতাও। ছবি: বিসিবি

যুক্তির খাতিরে কেউ হয়তো বলতে পারেন যে, ফরম্যাটে বদল হলেও লিগের নিয়ম-কানুন, যেমন সুপার লিগ, রেলিগেশন–সব তো আগের মতোই আছে। আর প্রিমিয়ার লিগের দলগুলোর কোনো একটা রেলিগেটেড হলেই বা কী আসে যায়! তাদের কাউন্সিলরশিপের তো কোনো পরিবর্তন হয় না। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, পছন্দসই কোনো একটা দলকে সুপার লিগে ওঠাতে পারলেই অতিরিক্ত একটা কাউন্সিলরের সমর্থন নিশ্চিত করা যায়। তাই, প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো রেলিগেটেড হোক কিংবা সুপার লিগে উঠুক, সবার কাউন্সিলরশিপ থাকার কারণে ভোটের সিজনে এর তেমন বিশেষ প্রভাব দেখা যায় না। কিন্তু একই সিজনের শেষ হওয়া অন্য সব লিগ, যেমন তৃতীয়, দ্বিতীয় এবং প্রথম বিভাগের খেলায় নিশ্চিত করা সকল সমীকরণ ঠিক রাখতেই প্রিমিয়ার লিগ শেষ করা ছাড়া আর কোনো পথ খোলা নেই সিসিডিএমের সামনে। তা নিয়মের ভেতরে থেকে হোক কিংবা বাইরে গিয়ে!

জানি, অনেকে ক্রিকেটারদের আর্থিক দিকটির কথা বলবেন। অনেক ক্রিকেটারের জন্যই ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ রুটিরুজির মূল মাধ্যম। এটাই যদি বিবেচনা হয়, তাহলে সিসিডিএম তো চাইলে লিগের ফরম্যাট না বদলে প্রিমিয়ার লিগের ক্লাবগুলোকে নিয়ে অন্য কোনো নাম দিয়ে একটা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে পারত। করোনাকালেই তো আমরা এ ধরনের টুর্নামন্ট হতে দেখেছি।  

যাঁরা ক্রীড়া সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত আছেন, ঘরোয়া ক্রিকেটের হালচাল কাছ থেকে দেখছেন, তাঁরা জানেন, বেশ কয়েক বছর ধরে ঢাকার বিভিন্ন ক্রিকেট লিগে কী হচ্ছে। মাঠে ক্রিকেটারদের পরিবর্তে কে কীভাবে খেলছে। কর্মকর্তারা কে কোথায় খেলছে, মাঠে আম্পায়াররা কীভাবে খেলছে। আমি শুনেছি, যারা এই অনিয়মগুলোর প্রতিবাদ করতে চাচ্ছে, তারা অনেকেই বিভিন্নভাবে অপদস্থ হয়েছে। অনেকে তাই সেভাবে প্রতিবাদ করার সাহসও পায় না।

খেলাটাকে ভালোবাসি বলেই এর সঙ্গে ছিলাম বা এখনো আছি। তবে সবকিছু যেভাবে চলছে, সত্যি বলছি, এখন আর এভাবে টিকে থাকতে ভালো লাগছে না।

আমার নিজের কথাই বলি, ২০০৪ সাল থেকে আমি একটা ক্লাব চালাই, যেটা ২০১১ সালে ফার্স্ট ডিভিশনে ওঠে। সেই সুবাদে আমি বিসিবির একজন কাউন্সিলর। তো ২০১৬ সালে আমার দলটাকে রেলিগেটেড করার একটা চেষ্টা করা হলো, কিন্তু আমি অনেক টাকা খরচ করে একটা শক্ত টিম তৈরি করেছিলাম, সেই চেষ্টা তাই ঠেকিয়ে দিতে পারলাম। তবে পরের বছর আমরা আর তা ঠেকাতে পারলাম না। বলতে গেলে আমাদের এক রকম জোর করেই সেকেন্ড ডিভিশনে নামিয়ে দেওয়া হলো। ২০১৮ সালে চেষ্টা চলল সেকেন্ড ডিভিশন থেকে থার্ড ডিভিশনে রেলিগেটেড করে দিতে। একদম শেষ ম্যাচে গিয়ে কোনোরকমে রেলিগেশন সেভ করি আমরা। অথচ মাঠে যারা খেলা দেখতে যান, তারা সবাই জানেন কোথায় কী হচ্ছে না হচ্ছে। আমাদের কিছুই করার নেই। প্রতিবাদ করেও কিছুই করতে পারিনি।

সংগঠক হিসেবে ক্রিকেটের সঙ্গে যুক্ত আছি দীর্ঘদিন। গত প্রায় দুই দশক ধরে এই খেলাটার পেছনেই সময় দিলাম, অর্থ দিলাম। আজ পর্যন্ত কেউ বলতে পারবে না, এত বছরে এই খেলাকে পুঁজি করে বা কাউন্সিলর হিসেবে বিসিবি থেকে আর্থিক কোন সুবিধা নিয়েছি। ক্রিকেটে গত প্রায় দুই দশকে একাই যত টাকা খরচ করেছি, আমার অনেক কষ্টে রোজগার করা টাকা, এর এক টাকাও রিটার্ন আসেনি। অফিসিয়ালি রিটার্ন আসার কোনো ব্যবস্থাই তো নেই বাংলাদেশের খেলাধুলা জগতে। তবুও খেলাটাকে ভালোবাসি বলেই এর সঙ্গে ছিলাম বা এখনো আছি। তবে সবকিছু যেভাবে চলছে, সত্যি বলছি, এখন আর এভাবে টিকে থাকতে ভালো লাগছে না।

আমি নিজেও এই সিসিডিএম-এর সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান ছিলাম একটা সময়। তখনও চেষ্টা করেও পরিস্থিতির বিশেষ কোনো পরিবর্তন করতে পারি নাই। আপনি এটিকে আমার অপারগতা বলতে পারেন, পারিপার্শ্বিক অবস্থার শিকারও বলতে পারেন। আমি জানি, এই লেখা প্রকাশের পরও পরিস্থিতি হয়তো বদলাবে না, যা হওয়ার তা-ই হবে।

তারপরও কেন তাহলে এই কথাগুলো বলছি?  'কেউ বলে না, আমি বললাম'– বলতে পারেন, এরকম একটা মনের শান্তি পেতেই আর কি!

লেখক: এম. নাজমুল ইসলাম, ক্রীড়া সংগঠক ও কাউন্সিলর, বিসিবি।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×