সাকিবের ব্যাটে চড়ে অভাবনীয় এক জয়
ফাইনালে বাংলাদেশ
উৎপল শুভ্র
২০ মে ২০২১
আগেই জানা ছিল, ফাইনাল খেলতে হলে হারাতেই হবে শ্রীলঙ্কাকে, যাদের সঙ্গে এর আগে ২৪ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র একটিতে। নেট রানরেটের বাকি যে শর্তটা ছিল, শ্রীলঙ্কার কাছে জিম্বাবুয়ের বিশাল পরাজয়ের পর সেটিও পূরণ হয়ে গেল। কিন্তু কাল ম্যাচ শুরুর আগে আশরাফুলরা জানলেন, নেট রানরেটের আসলে কোনো মূল্যই নেই। দু`দলের পয়েন্ট সমান হলে দেখা হবে মুখোমুখি লড়াইয়ের ফল, বাংলাদেশকে তাই জিততে হবে বোনাস পয়েন্টসহ। ২০০৯ সালের ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে সেই `অসম্ভব`কে সম্ভব করেছিল সাকিবের অসাধারণ এক ইনিংস।
প্রথম প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০০৯। প্রথম আলো।
জয় উদযাপনের এই রীতিটা বেশ কিছুদিন ধরে চর্চিত বাংলাদেশ দলে। ড্রেসিংরুমে সবাই মিলে ‘আমরা করব জয়’ গানটা গাওয়া। কালও ম্যাচ শেষে মিরপুরের ড্রেসিংরুম বুকের গভীরে থাকা জয়ের প্রত্যয়ের সোচ্চার ঘোষণায় মুখরিত। আশরাফুলরা তো গাইলেনই, গাইলেন বিদেশি কোচ-ফিজিও-ট্রেনারও!
একটু আগে প্রবল পরাক্রান্ত শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যেভাবে জিতেছে বাংলাদেশ, তাতে গানটা একটু বদলে ‘আমরা করেছি জয়’ও গাওয়া যেত! বাংলাদেশ জয়ের অপেক্ষায় থাকবে কেন, জয় তো তারা করেই ফেলেছে!
এমন জয়, যেটির মহিমা শুধুই আরেকটি ম্যাচ জয়ে সীমাবদ্ধ নয়। বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিতেছে, জিতেছে ম্যাচ শুরুর আগে হঠাত্ আবির্ভূত টুর্নামেন্টের ব্যতিক্রমী নিয়মের বিপক্ষে। জিম্বাবুয়ে-বিপর্যয়ের পর চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা সমালোচনা আর অপমানের ঝড়ের বিপক্ষেও কি নয়! সব জয় করে বাংলাদেশ ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালে, অতি আশাবাদীও যেটির আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে পরাজয়ের পরই সমীকরণটা জানা হয়ে গিয়েছিল সবার। ফাইনাল খেলতে হলে হারাতেই হবে শ্রীলঙ্কাকে, যাদের সঙ্গে এর আগে ২৪ ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ জিতেছে মাত্র একটিতে। নেট রানরেটের বাকি যে শর্তটা ছিল, শ্রীলঙ্কার কাছে জিম্বাবুয়ের বিশাল পরাজয়ের পর সেটিও পূরণ হয়ে গেল। কিন্তু কাল ম্যাচ শুরুর আগে আশরাফুলরা জানলেন, নেট রানরেটের আসলে কোনো মূল্যই নেই। কারণ এর আগে যেটি কারও পড়ে দেখারই সময় হয়নি, টুর্নামেন্টের সেই নিয়মে লেখা আছে—দু'দলের পয়েন্ট সমান হয়ে গেলে সবার আগে দেখা হবে মুখোমুখি লড়াইয়ের ফল। বাংলাদেশকে তাই শুধু জিতলেই হবে না, জিততে হবে বোনাস পয়েন্টসহ। যে বোনাস পয়েন্ট পাওয়ার শর্ত হলো, প্রতিপক্ষের চেয়ে ১.২৫ গুণ বেশি রানরেটে জেতা। এটা শুনে কী মনে হয়েছিল বাংলাদেশ দলের? শুধু এভারেস্টে উঠলেই চলবে না, উঠতে হবে পিঠে সোয়া মণ ওজনের একটা বস্তা নিয়ে!
মনে হয়ে থাকলেও খেলা দেখে একদমই তা বোঝার কোনো উপায় থাকল না। কুয়াশার কারণে ৩১ ওভারে নেমে আসা ম্যাচে টস জেতাটা অবশ্যই খুব কাজে এসেছে। কিন্তু কুয়াশায় একটু ভেজা-ভেজা উইকেটই তো শ্রীলঙ্কাকে ১৪৭ রানে শেষ করে দেওয়ার নিশ্চয়তা ছিল না। সে জন্য উইকেটকে কাজে লাগাতে হতো। সেটি কীভাবে লাগাতে হয়, অতীতে আরও অনেকবারের মতো কালও তা সতীর্থদের দেখিয়ে দিলেন মাশরাফি বিন মুর্তজা।
তৃতীয় বলে থারাঙ্গার উইকেটখচিত তাঁর প্রথম ওভারটি গ্লেন ম্যাকগ্রার কাছেও স্বপ্নসম মনে হতে বাধ্য। পরের ওভারে বোল্ড করলেন সাঙ্গাকারাকে। ক্যাচ না পড়লে পঞ্চম ওভারে ফিরিয়ে দিতেন জয়াসুরিয়াকেও। ৪২৩ ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিংড়ে দিয়ে ‘মাতারা হারিকেন’ যখন আতঙ্ক হয়ে ওঠার পথে, দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে তাঁকে থামালেন দারুণ এক ফিরতি ক্যাচ নিয়ে। ম্যাচশেষে আশরাফুল সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন, বাংলাদেশের সব জয়েরই পূর্বাভাস লুকিয়ে থাকে মাশরাফির প্রথম স্পেলে।
কাল পেস বোলিংয়ে মাশরাফির যে দুই সঙ্গী, তাঁদের একজনের এটি দ্বিতীয় ম্যাচ, অন্যজনের অভিষেক। যাঁর অভিষেক, সেই রুবেল হোসেনের কাছে মাশরাফির সঙ্গে বোলিং করাটা রীতিমতো স্বপ্নপূরণ। আর অভিষেকে যা করলেন, তা স্বপ্নকেও ছাড়িয়ে যাওয়া। রুবেলের বোলিংয়েই শীতের ঝরাপাতার মতো টুপটাপ খসে পড়ল শ্রীলঙ্কার শেষ পাঁচ উইকেট। যার একটি নিয়েছেন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে আগের ম্যাচে অভিষিক্ত মাহবুবুল। ১৮ বলের গতিময় এক বিধ্বংসী স্পেলে বাকি চারটিই রুবেল। ৪/৩৩—শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের তো সেরাই, বাংলাদেশের কোনো বোলারের সেরা ওয়ানডে-অভিষেকও।
কিন্তু মাশরাফি-রুবেলের এমন বোলিংও শুধু দূর দিগন্তে জয়ের আভাসটাই ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিল, এর বেশি কিছু নয়। সে পর্যন্ত পৌঁছুতে তখনো যে পাড়ি দেওয়ার ছিল মহাদুর্গম এক পথ! বাংলাদেশ যখন ব্যাটিং করতে নামল, একই সঙ্গে যেন খেলতে হচ্ছিল দুটি ম্যাচ। জিততে হলে ৩১ ওভারে করতে হবে ১৪৮। কিন্তু তাতে শুধু শ্রীলঙ্কাকে হারানোর তৃপ্তিটাই মিলবে। ফাইনাল খেলতে না পারার অতৃপ্তিতে সেটির মুছে যাওয়া ঠেকাতে ১৪৮ করতে হবে ২৪.৫ ওভারের মধ্যে। তা হলেই বোনাস পয়েন্ট, তা হলেই ফাইনাল।
শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে যেনতেন একটি জয় পেলেই যেখানে বর্তে যায় বাংলাদেশ, সেখানে আবার এমন শর্ত! মুরালি-মেন্ডিসদের বিপক্ষে এই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করার আশা কীভাবে করবেন আপনি? সেই আশা আরও দুরাশায় রূপ নিল, ইনিংসের চতুর্থ ওভারের মধ্যে যখন ১১ রানে ৩ উইকেট নেই! এর চেয়েও বিপদ সংকেত হয়ে এল দুই ওপেনারের রান আউট হয়ে যাওয়া। যা স্পষ্টই বুঝিয়ে দিল, সবকিছু ছাপিয়ে ‘চাপ’টাই হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ।
সাকিবের ব্যাটিং দেখে কে তা বলবে! এই বাঁহাতি বাংলাদেশ দলের হাতে গোনা খেলোয়াড়দের একজন, যাঁর হৃদয়ে সত্যিকার পেশাদারি গর্ব। ব্যক্তিগত ও দলীয় ব্যর্থতা দুটিই যাঁকে ‘মরমে দহে’। গত বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যাটিং-বোলিংয়ে তাঁর স্বপ্নযাত্রা, কিন্তু কাল যা করলেন, মাঝে-মধ্যে সেটিকে মনে হচ্ছে প্রত্যাশারও অতীত। মুরালি-মেন্ডিস যুগল আতঙ্ককে যেভাবে জয় করলেন, তা দেখতে বিশ্বের অনেক নামীদামি ব্যাটসম্যানের এই ইনিংসটির ভিডিও জোগাড় করতে তৎপর হয়ে ওঠার কথা! ১০টি চার ও ২টি ছয়ে সাজানো ৬৯ বলে অপরাজিত ৯২—সাকিবের চোখ ধাঁধানো স্ট্রোক প্লেতেই ইনিংস মাঝপথে আসার আগেই সংশয়াতীত হয়ে গেল বাংলাদেশের জয়।
কিন্তু ওই যে বললাম, বাংলাদেশকে একই সঙ্গে পেতে হতো দুটি জয়। টিভি পর্দায় কত বলে কত রান—এই হিসাবের পাশেই তাই ভেসে উঠছিল 'আসল' জয়ের সমীকরণ। বোনাস পয়েন্টসহ জিততে এত বলে এত রান। সেই হিসাব যখন বলছে ২৯ বলে চাই ৩৬, তখনই কুলাসেকারার তিন বলের মধ্যে স্কুপ করে একটি চার ও এক্সট্রা কভারের ওপর দিয়ে একটি ছয় মেরে সেটিকে ২৬ বলে ২৬ রানে নামিয়ে আনলেন সাকিব।
কুলাসেকারার আগের ওভারেই আশরাফুলের আউট হয়ে যাওয়াটাও তখন আর কোনো ব্যাপার মনে হচ্ছে না। তবে এই জয়ে সাকিবের সঙ্গে আশরাফুলের চতুর্থ উইকেট জুটিটি অবশ্যই বড় ব্যাপার। ৯১ রানের জুটিতে আশরাফুলের অবদান মাত্র ২৫—সাকিব-মাহাত্ম্য বোঝাতে এটাই বোধ হয় যথেষ্ট।
শেষটা সাকিবের ব্যাটে হলেই জয়টা সর্বাঙ্গীণ সুন্দর হতো। তাঁর অবশ্য-প্রাপ্য সেঞ্চুরিটাও হয়ে যেত তাতে। এ নিয়ে তাঁর আফসোস থাকবে কি, মেন্ডিসের পর পর দুই বলে চার ও ছয় মেরে যেভাবে ম্যাচটা শেষ করেছেন নাঈম, তাতে সাকিবকেই বরং বেশি উল্লসিত দেখাল।
দলকে জিতিয়ে ফিরতে পারেন না বলে দুঃখ ছিল তাঁর। এত বড় সেই দুঃখটা যেভাবে ঘুচেছে, ছোটখাটো অপ্রাপ্তি যে তাতে বুদ্বুদ্ তুলে সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে যায়।