মুরালির ব্যাটে যেদিন বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গ

শেষটাই তাহলে সব?

উৎপল শুভ্র

২০ মে ২০২১

মুরালির ব্যাটে যেদিন বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গ

শিরোপা হাতে শ্রীলঙ্কা দল। একটু এদিক-ওদিক হলেই ছবিটা হতে পারত বাংলাদেশেরও। ছবি: এএফপি

মাত্র ১৫৩ রানের লক্ষ্য দাঁড় করানো গিয়েছিল বলে জয়টা অলীক স্বপ্নই ছিল। কিন্তু ৬ রানে ৫ উইকেট তুলে নিয়ে বাংলাদেশের বোলাররা সেই অলীক স্বপ্নকেই সত্যি বানাতে শুরু করেছিলেন। শেষ পর্যন্ত যদিও সেই স্বপ্ন সত্যি হয়নি। বাংলাদেশের স্বপ্নভঙ্গের নায়ক হয়ে দাঁড়িয়ে গেছেন ব্যাটসম্যান মুরালিধরন। এক ওভারেই ২০ রান দিয়ে ``খলনায়ক`` মাত্র দ্বিতীয় ম্যাচ খেলতে নামা রুবেল। ২০০৯ ত্রিদেশীয় ওয়ানডে টুর্নামেন্টের স্মরণীয় সেই ফাইনাল।

প্রথম প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০০৯। প্রথম আলো।

বাংলাদেশ: ৪৯.৪ ওভারে ১৫২ শ্রীলঙ্কা: ৪৮.১ ওভারে ১৫৩/৮ ফল: শ্রীলঙ্কা ২ উইকেটে জয়ী

কাল রাতে কি রুবেল হোসেন একটুও ঘুমুতে পেরেছেন? মোহাম্মদ আশরাফুল?

ক্রিকেট প্রায়ই যেন জীবনের মিনিয়েচার। কখনো হাসায়। কখনো কাঁদায়। কাল যেমন কাঁদাল রুবেলকে। আশরাফুলকে। বাংলাদেশের প্রতিটি খেলোয়াড়কে। ম্যাচ শেষে পাওয়া সাধারণ্যের যে প্রতিক্রিয়া, তাতে বোধ হয় পুরো বাংলাদেশকেই।

জীবনের মতোই কখনো কখনো ক্রিকেট বড় বেশি নিষ্ঠুরও। সেই নিষ্ঠুরতার পরিচয় এর আগে আর এতটা পায়নি বাংলাদেশ দল। মুলতানের কথা উঠছে, ফিরে-ফিরে আসছে ফতুল্লা। ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১ উইকেটে হারতে হওয়া সেন্ট ভিনসেন্ট ওয়ানডে। শেষ পর্যন্ত হতাশা আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে মিরপুরে ত্রিদেশীয় সিরিজের ফাইনালই। শুরুতে যেটিতে বাংলাদেশের জেতার কোনো প্রশ্নই ছিল না, একসময় বাংলাদেশের জয়টাই যাতে হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে সম্ভাব্য ফল এবং শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ যেটি জিততে পারল না। আর কোনো ক্রিকেট ম্যাচ এমন দুকূলপ্লাবী আবেগে ভাসায়নি বাংলাদেশকে। মুলতান-ফতুল্লাও দেখেনি মিরপুরের মতো এমন রোরুদ্যমান ড্রেসিংরুম।

ভারত কোনো ওয়ানডে ম্যাচ হারলে ভারতীয় এক স্যাটেলাইট টিভিতে ম্যাচ কা মুজরিম (ম্যাচের অপরাধী) নামে একটা অনুষ্ঠান আমজনতা খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে। এই অনুষ্ঠানে ভারতের পরাজয়ের জন্য একজন-দুজন খেলোয়াড়কে দায়ী করে তাদের আচ্ছামতো বাক-ধোলাই দেওয়া হয়। অগ্রণী ভূমিকায় থাকেন সাবেক বাঁহাতি স্পিনার বিষেণ সিং বেদি।

কালকের ফাইনাল শেষ হতে না-হতেই দেখা গেল, কোনো আলোচনা-টনা ছাড়াই জনতা ম্যাচ কা মুজরিম-এর ব্যাপারে সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছে। তিনি মোহাম্মদ আশরাফুল। অপরাধ’—ব্যাটসম্যানের নেওয়া পাওয়ার প্লের প্রথম ওভারে ২০ রান দেওয়ার পরও আবারও রুবেলের হাতেই বল তুলে দেওয়া। ওই ২০ রানের সবই মুত্তিয়া মুরালিধরনের ব্যাট থেকে। রুবেলের পরের ওভারে তিনিই নিলেন ১২ এবং এরপর আর এক বল লাগলেও ম্যাচ আসলে তখনই শেষ! বল হাতে শ্রীলঙ্কাকে অসংখ্য ম্যাচ জিতিয়েছেন, তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় ব্যাট হাতে এনে দেওয়া এই জয়টাকে হয়তো সবার ওপরেই রাখবেন মুরালিধরন।

মুত্তিয়া মুরালিধরন! এবার নায়ক ব্যাট হাতে। ছবি: এএফপি

শুধু ম্যাচের ওই শেষটুকু দেখলে মোহাম্মদ আশরাফুলকে যে কেউই দাঁড় করাবেন কাঠগড়ায়। এমন স্নায়ুক্ষয়ী উত্তেজনাময় সময়ে কেন তিনি মাত্র দ্বিতীয় ওয়ানডে খেলতে নামা রুবেলের ওপর তুলে দিলেন এই গুরুদায়িত্ব? কেন আগেই শেষ করে দিলেন মাশরাফি বা নাজমুলের ১০ ওভার? কেন রুবেল ২০ রান দেওয়ার পরও কেন আবার তাঁকেই বল দিলেন?

পরাজয়ে শেষ হওয়া ম্যাচ খুবই যৌক্তিক করে তুলছে প্রশ্নগুলোকে। কিন্তু শুধু শেষটা মনে না রেখে রিওয়াইন্ড করে একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখুন তো এই পরাজয়ে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি কাতর আশরাফুলকে আসামি বানানোটা একটু বেশিই নিষ্ঠুরতা হয়ে যায় কি না! ৩৭ ও ৪২তম ওভারেই মাশরাফি ও নাজমুলের শেষ ওভার দুটিও খরচ করে ফেলার যুক্তি তো খুঁজে পাওয়াই যায়। তখন ম্যাচের অবস্থা এমন যে, আস্কিং রেট কোনো ব্যাপার হবে বলেই মনে হয়নি। বাংলাদেশ করতে পেরেছে মাত্র ১৫২, পুরো ওভার খেলা হলে শ্রীলঙ্কার জয় তাই অবধারিত। বাংলাদেশের জয় পাওয়ার একটাই পথশ্রীলঙ্কাকে অলআউট করা। মাশরাফি ও নাজমুলকে নিয়ে জুয়াটা আশরাফুলকে তাই খেলতেই হতো। আগের ম্যাচে তৃতীয় পাওয়ার প্লেতে রুবেল যেভাবে উড়িয়ে দিয়েছেন শ্রীলঙ্কার টেল এন্ডারদের, তাতে তাঁর ওপর ভরসা রাখাটাকেও অস্বাভাবিক বলা যাচ্ছে না। কিন্তু ২০ রান দিয়ে ফেলার অপরাধবোধে জর্জরিত ১৯ বছরের অনভিজ্ঞ তরুণকে আবারও অগ্নিপরীক্ষায় নামিয়ে দেওয়াটা? এটা যে বড় ভুল হয়েছে, সেটি নিশ্চয়ই আশরাফুল নিজেও বুঝতে পারছেন।

কিন্তু এই ভুলেই কি মুছে যাবে বাংলাদেশের বীরত্বময় লড়াই! মাত্র ১৫২ রানের পুঁজি নিয়েও অসাধারণ বোলিং-ফিল্ডিংয়ে এটিকে ওয়ানডে ইতিহাসের অন্যতম সেরা ম্যাচে পরিণত করার কৃতিত্ব! হায়, পরাজিতের বীরত্বের বুঝি কোনোই মূল্য নেই, নইলে এমন একটা ম্যাচ খেলার পর কেন ঢিল পড়বে বাংলাদেশ দলের বাসে?

উইকেট তোলার উল্লাসে ভাসছেন রুবেল-আশরাফুল। কে জানত, দিনশেষে শূলে চড়তে হবে দুজনকেই! ছবি: এএফপি

আসলে দোষটা বাংলাদেশ দলেরই! লাঞ্চের সময়ই যে ম্যাচ শেষ বলে ধরে নিয়েছিলেন সবাই, সেই ম্যাচকে কেন তারা রাঙাবে এমন স্বপ্নের রঙে! ২৭৯৫টি ওয়ানডে ম্যাচ এর আগে যা কখনো দেখেনি, ৬ রানে ৫ উইকেট ফেলে দেওয়ার সেই অভূতপূর্ব ঘটনার জন্ম দিয়ে পুরো ক্রিকেট-বিশ্বের চোখ কেন মিরপুরের দিকে টেনে আনবে তারা! কেন পরাক্রান্ত শ্রীলঙ্কাকে কম্পমান বানিয়ে জয়টাকে মনে করাবে শুধুই সময়ের ব্যাপার!

বাংলাদেশ বাজে ব্যাটিং করেছে, ১৫২ রানে অলআউট হয়েছেএ পর্যন্ত তো ঠিকই ছিল! এরপর নিয়মমতো শ্রীলঙ্কা ৭ বা ৮ উইকেটে জিতে গেলেও ঠিকই থাকত! কিন্তু প্রথম বলেই দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ে সনাৎ জয়াসুরিয়াকে রান আউট করে দিয়ে কেন পুরো দলকে জাগিয়ে তুললেন সাকিব আল হাসান? কেন নতুন বলে আগুন ঝরিয়ে একের পর এক উইকেট তুলে নিলেন নাজমুল-মাশরাফি? সাঙ্গাকারা যখন ম্যাচ বের করে নিচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে, তখন কেন সাকিব তাঁকে ফেরানোর এক বল পরই তুলে নেবেন কুলাসেকারাকেও?

শ্রীলঙ্কা তখন ৪৩.৩ ওভারে ৮ উইকেটে ১১৪। জয়ের জন্য ৩৯ বলে চাই ৩৯ রান, উইকেটে ফারভিজ মাহারুফের সঙ্গে মুত্তিয়া মুরালিধরন। শুধু মিরপুর স্টেডিয়ামই নয়, মোহাম্মদ আশরাফুলের হাতে তখন ট্রফি দেখতে পাচ্ছে পুরো বাংলাদেশই।

সেই ট্রফি হাত থেকে ফেলে দেওয়ার কষ্টটা আশরাফুলের সবচেয়ে বেশি হতে পারে, কিন্তু তা বুঝতে বয়েই গেছে আমাদের!

আরও পড়ুুন:  সাকিবের ব্যাটে চড়ে অভাবনীয় এক জয়

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×