দ্য মিরাকল অব বার্ন

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

রাইয়ান কবির

২০ মে ২০২১

দ্য মিরাকল অব বার্ন

ছবি: গেটি ইমেজেস

একটা দল পাঁচ বছর ধরে অপরাজিত। গ্রুপ পর্বে সেই দল কোনো এক দলকে হারিয়েছে ৮-৩ গোলের ব্যবধানে। অথচ ৮-৩ গোলের ব্যবধানে হেরে যাওয়া দলই ফাইনালে পাঁচ বছর ধরে অপরাজিত দলকে ৩-২ গোলে হারিয়ে জিতে নিল বিশ্বকাপ। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল ১৯৫৪ এর বিশ্বকাপ ফাইনালে। ‘দ্য মিরাকল অফ বার্ন’ নামেই খ্যাত সেই ফাইনাল।

১৯৪৬ সালের ২২ জুলাই ঠিক হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হওয়া প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশ। সেই সুবাদে ১৯৫৪ বিশ্বকাপ আয়োজনের দায়িত্ব পায় সুইজারল্যান্ড। স্বাগতিক দেশ আর ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দুই দলই তখন সরাসরি জায়গা পেত বিশ্বকাপে। ১৬ দলের বিশ্বকাপে বাকি ১৪ দলের ১১টিই আসে ইউরোপ থেকে। শেষ তিন দলের দুটি আসে আমেরিকা থেকে, অন্যটি এশিয়া থেকে।

‘মাইটি ম্যাগিয়ার্স’ নামে হাঙ্গেরির 'লেজেন্ডারি' দল কিংবা 'গোল্ডেন জেনারেশন' যা-ই বলা হোক না কেন, সে দলই ছিল ১৯৫৪ বিশ্বকাপের হট ফেভারিট। ফাইনালে ওঠার আগে শেষ পাঁচ বছরে ৩১ ম্যাচ খেলে সবগুলোতে অপরাজিত ছিল এই ‘মাইটি ম্যাগিয়ার্স’। তারা ছিল তখনকার অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন এবং ১৯৫৩ সালে হওয়া সেন্ট্রাল ইউরোপিয়ান ইন্টারন্যাশনাল কাপের চ্যাম্পিয়ন। প্রথম দল হিসেবে ইংল্যান্ডকে ইংল্যান্ডের মাঠে হারায় তারা। বিশ্বকাপের ঠিক আগে আগে বুদাপেস্টে ৭-১ গোলে ইংল্যান্ডকে বিধ্বস্ত করে হাঙ্গেরি।

হাঙ্গেরি দলের সব ফুটবলারই ছিলেন প্রফেশনাল, স্কিলের জন্য তাঁদের নামডাক ছিল বেশ। ফ্রন্ট লাইনে ফেরেঙ্ক পুসকাস, সান্দোর ককসিস; অ্যাটাকিং মিডে নান্দোর হিদেগুতি, ছিলেন গিউলা গ্রসিকসের মতো গোলকিপারও। আর সেই দলের কোচ ছিলেন হাঙ্গেরির ক্রীড়া উপমন্ত্রী গুস্তাভ সেবেস।

ফাইনালের আগে পশ্চিম জার্মানি ফুটবল দল। ছবি: গেটি ইমেজেস

গ্রুপ পর্ব, কোয়ার্টার ফাইনাল, সেমিফাইনাল শেষে ৪ জুলাই বার্নের ওয়াংডর্ফ স্টেডিয়ামে গড়ায় ফাইনাল, জার্মানি-হাঙ্গেরির মধ্যেকার সে ম্যাচটি পরিচিত 'দ্য মিরাকল অব বার্ন' নামেই। গ্রুপ পর্বের ৮-৩ জয়ের ম্যাচে পুসকাসকে হতে হয় জার্মানদের ‘মারধরের’ শিকার, মাঠই ছাড়তে হয় এক পর্যায়ে। সে ইনজুরি কাটিয়ে ফাইনালে ঠিকই নামেন পুসকাস। মাত্র ছয় মিনিটেই তাঁর গোলে এগিয়ে যায় হাঙ্গেরি। ককসিসের বল ব্লক করলেও সে বল গোলপোস্টের কাছ থেকে জালে জড়ান পুসকাস। জার্মান ডিফেন্সের ভুলে ঠিক দুই মিনিট পরেই আরও এক গোল দিয়ে বসে হাঙ্গেরি। এবার গোল করেন জিবর। ডিফেন্ডারের করা ব্যাকপাস গোলকিপার টনি টুরেকের উইক ফুটের দুর্বল বল কন্ট্রোলিংয়ের সুযোগ নিয়ে বলের দখন নেন জিবর। খালি জালে জড়িয়ে দেন বল। সব ম্যাচের মতো গোল উৎসবের প্রস্তুতি নেয় দর্শকরা।

গোল খেয়েই আক্রমণে যায় পশ্চিম জার্মানি। দশ মিনিটের সময় লেফট উইং দিয়ে বুজানস্কির পায়ের ফাঁক দিয়ে চলে যাওয়া ফ্রিটজ ওয়াল্টারের ক্রস থেকে গোল করেন ম্যাক্স মরলোক। ম্যাচের বয়স তখন আঠারো মিনিট, মরলোক ড্রিবলিং করে হাঙ্গেরির ডিফেন্স ভাঙার চেষ্টায় এগোলেও সেখানে বল ক্লিয়ার করেন লরেন্ত। কর্নার পায় জার্মানি। ওয়াল্টারের কর্নার এবার ক্লিয়ার করেন বুজানস্কি। দ্বিতীয় কর্নার থেকে গোল করে সমতা ফেরান রান।

ম্যাচ ২-২ এ সমতায় আসার পর হাঙ্গেরি শুরু করে পাল্টা আক্রমণ, দখল নেয় ম্যাচের। বেশ কিছু ভালো সুযোগও তৈরি করে তারা। ২৩ মিনিটের সময় লেফটব্যাক লান্টোসের চিপ করা ক্রস খুঁজে পায় ককসিসের মাথা, সেখান থেকে বল যায় হিদেগুতির কাছে। কিন্তু হিদেগুতির শট অসাধারণ দক্ষতায় ঠেকিয়ে দেন দ্বিতীয় গোল খাওয়ার মূল হোতা গোলকিপার টুরেক। চার মিনিট পর হিদেগুতির শট ফিরে আসে পোস্টে লেগে। ৪২ মিনিটের সময় গোল লাইন থেকে রান এর গোলমুখী শট ক্লিয়ার করেন বুজানস্কি।

পুসকাসের গোল বাতিল হয়ে যায় অফসাইডে। ছবি: এপি

দ্বিতীয়ার্ধে একদম অ্যাটাকিং মুডে দেখা যায় হাঙ্গেরিকে। একের পর এক সুযোগ তৈরি করতে থাকে তারা। বিরতির দুই মিনিট পর গোলমুখে শট নেন পুসকাস। কিন্তু বল চলে যায় সরাসরি টুরেকের হাতে। ৫৪ মিনিটে টথের শট দু'বার গোল লাইন থেকে ক্লিয়ার করেন জার্মান লেফটব্যাক কলমেয়ার। ৬৭ ও ৭৮ মিনিটে হাঙ্গেরি ভালো দুটি সুযোগ তৈরি করলেও ক্রসবার ও গোলকিপার টুরেকের কল্যাণে বেঁচে যায় জার্মানি।

ম্যাচের তখন বাকি ছয় মিনিট। জার্মান লেফট উইঙ্গার স্কাফার হাঙ্গেরির মিডফিল্ডার বজসিকের কাছ থেকে বল পেয়ে ক্রস করেন পেনাল্টি বক্সে। সেই শট পায়ে আসে আরেক উইঙ্গার রানের পায়ে। সেইখান থেকে বল পান সেন্টার ফরোয়ার্ড ওটামার ওয়াল্টার, নিচু জোরালো শটে গ্রসিকসে ফাঁকি দিয়ে তিন নম্বর গোল এনে দেন জার্মানিকে।

দুই মিনিট পরেই গোল শোধ করেন পুসকাস৷ তবে সে গোল বাতিল হয়ে যায় অফসাইডে। হাঙ্গেরিয়ান প্লেয়ারদের মতে লিং প্রথমে গোল দিতে চাইলেও ওয়েলশ লাইনসম্যান গ্রিফিতের সাথে আলোচনা করে বাতিল করেন গোল, যদিও টিভি ফুটেজে পুসকাসের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাচ্ছিল না।

বিশ্বজয়ের সাক্ষী জুলে রিমে ট্রফি হাতে ওয়াল্টার। ডানে একেল, একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিনিই বেঁচে আছেন এখনো। ছবি: গেটি ইমেজেস

শেষ বাঁশি বাজার সাথে সাথেই শেষ হয় হাঙ্গেরির সেই গোল্ডেন জেনারেশনের অপরাজিত থাকার দৌড় আর প্রথমবারের মত চ্যাম্পিয়ন হয় পশ্চিম জার্মানি।

১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অক্ষত থাকে ‘মাইটি ম্যাগিয়ার্স’। ১৯৫৬ সালে কোচ বদলের সাথে সাথে বাদ পড়েন পুসকাসসহ কয়েকজন ফুটবলার। ১৯৫৮ সালে এই দলের মাত্র চারজন জায়গা পান বিশ্বকাপে। ২০১৫ সালে হাঙ্গেরিয়ান ওই দলের শেষ মেম্বার বুজানস্কি মারা যান। দু'দল মিলিয়ে একমাত্র জার্মান দলের একেল এখনও বেঁচে আছেন সেই ম্যাচের সাক্ষী হয়ে।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×