শেষ অতৃপ্তিটাও ঘোচালেন মহানায়ক

উৎপল শুভ্র

২৭ জানুয়ারি ২০২১

শেষ অতৃপ্তিটাও ঘোচালেন মহানায়ক

শুরুর আগে এই অলিম্পিকের ‘পোস্টার বয়’ ছিলেন, শেষে এসে আরও বেশি। এখন যে তিনি ‘জীবন্ত কিংবদন্তি।’ খেতাবটা উসাইন বোল্ট নিজেই নিজেকে দিয়েছেন। আইওসি প্রেসিডেন্ট জ্যাক রগ শেষ পর্যন্ত একমত না হয়ে উপায় থাকেনি।

প্রথম প্রকাশ: ১৩ আগস্ট ২০১২। প্রথম আলো।

চার বছর পর পর একেকটি অলিম্পিক আসে আর অনপনেয় কিছু ছবি এঁকে যায়। বাংলাদেশ সময় কাল ভোররাতে পর্দা নেমে আসার পর লন্ডন অলিম্পিকও এখন হিরণ্ময় সব ছবির কোলাজ। এর মধ্যে কোন ছবিটি সবচেয়ে বেশি জ্বলজ্বল করছে মানুষের মনে? অথবা প্রশ্নটা যদি এমন হয়, অনেক দিন পর লন্ডন অলিম্পিকের দিকে ফিরে তাকালে কোন ছবিটি প্রথমেই ভেসে উঠবে চোখে?

জ্যাক রগ কোনো একটিকে বেছে নিতে পারছেন না। কাল সকালে সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্নটার উত্তরে ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট পর পর অনেকগুলো নাম বলে গেলেন। বোল্ট, ফেলপস, ক্রিস হয়...৮০০ মিটারে রুডিশার রেকর্ডভাঙা দৌড়টাও এখনো চোখে লেগে আছে তাঁর। শেষ দিকে রুডিশার পদক্ষেপগুলো রগের চোখে ‘বিউটি ইন অ্যাকশন’।

ক্রিস হয়ের নামটি বলেছেন হয়তো স্বাগতিকদের মন রাখতেই। এখানে সোনা জিতে ব্রিটেনের সফলতম অলিম্পিয়ান এই সাইক্লিস্ট। তবে বোল্ট-ফেল্পেসর পাশে তো বড়ই বিবর্ণ সেই কীর্তি। বেইজিংয়ের দুই নায়ক নায়ক এখানেও। দুজনই নায়ক! বোল্ট না হয় ঠিক আছে, তাই বলে ফেলপসও?

হ্যাঁ, ফেলপসও। বেইজিংয়ে আট ইভেন্টে পুলে নেমে আটটিতেই সোনা জয়ের অত্যাশ্চর্য কীর্তিই সর্বনাশটা করেছে। যে কারণে লন্ডনের ফেল্পসকে মনে হচ্ছে ‘ব্যর্থ’। অথচ লন্ডন অলিম্পিকেও সবচেয়ে বেশি সোনা জয়ের কীর্তিটি ফেল্পসের। ৭ ইভেন্টের একটিতেই শুধু পদক নেই। বাকি ৬টিতে ৪টি সোনা ও দুটি রুপা। বেইজিংয়ে একমেবাদ্বিতীয়ম ছিলেন। এখানে চার সোনা জয়ের কীর্তিতে তাঁর সঙ্গী যুক্তরাষ্ট্রেরই মেয়ে সাঁতারু মিসি ফ্র্যাঙ্কলিন।

ফেলপসের কল্যাণে এই অলিম্পিক ইতিহাসেরও সাক্ষী। সর্বকালের সফলতম অলিম্পিয়ান হয়ে গেলেন এখানেই। ১৮টি সোনা, ২টি রুপা, ২টি ব্রোঞ্জ—মোট ২২টি পদক! মাইকেল ফেলপস যদি ‘দেশ’ হতেন, তাহলে অলিম্পিকের সর্বকালীন সাফল্যের তালিকায় কত নম্বরে থাকতেন, এই জাতীয় অদ্ভুত আলোচনাও হয়েছে এই অলিম্পিকে। আর রেকর্ডটা কি ভাঙবে কোনো দিন, এই আলোচনা তো হওয়ারই কথা।

অলিম্পিক মানেই রেকর্ড ভাঙা-গড়ার খেলা। তবে এই অলিম্পিক ‘রেকর্ড’ গড়তে শুরু করেছে খেলা শুরুর আগে থেকেই। অলিম্পিক ইতিহাসে এই প্রথম সব দেশে নারী প্রতিযোগী। রক্ষণশীলতার দুর্গ ভেঙে প্রথমবারের মতো অলিম্পিকে এসেছে সৌদি আরব, কাতার, ব্রুনাইয়ের মেয়েরা। হ্যাঁ, মূল কৃতিত্বটা আইওসির। এই অলিম্পিকে নারী প্রতিযোগী বাধ্যতামূলক করে দেওয়াতেই ঘটেছে এই যুগান্তকারী ঘটনা।

‘নারীশক্তি’র প্রদর্শনী আরও আছে। যুক্তরাষ্ট্র দলে অলিম্পিক ইতিহাসে এই প্রথম ছেলের চেয়ে মেয়ে প্রতিযোগী বেশি (ছেলে ২৬১, মেয়ে ২৬৯)। অলিম্পিকে এসে যুক্তরাষ্ট্রের অলিম্পিক কর্মকর্তাদের হয়তো মনে হয়েছে, মেয়ের সংখ্যা আরও বেশি হলেই বোধ হয় ভালো হতো। যুক্তরাষ্ট্রের পদকের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই যে জিতেছে মেয়েরা!

সব দেশেই নারী প্রতিযোগীর মতোই ‘বিপ্লব’ অস্কার পিস্টোরিয়াসের ট্র্যাকে নামা। কৃত্রিম পা নিয়ে সুস্থ-সবল প্রতিযোগীদের সঙ্গে দৌড়, প্রত্যাশামতো ৪০০ মিটারের সেমিফাইনালেও উঠে পিস্টোরিয়াস ছাড়িয়ে গেছেন খেলার সীমানা। হয়ে উঠেছেন প্রতিকূলতার উজান বেয়ে সাফল্যের প্রতীক। সব মানুষের জন্য অনুপ্রেরণার গল্পও।

সেই অতৃপ্তিও ঘুচিয়ে দিলেন বোল্ট। ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে জ্যামাইকার শেষ লেগটা দৌড়ালেন। এই অলিম্পিকে প্রথম উজাড় করে দিলেন নিজেকে। তাতে যা হওয়ার তা-ই হলো, বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে খানখান! 

১০০ ও ২০০ মিটারের সোনা ধরে রাখার অভূতপূর্ব কীর্তি গড়ার পরই ‘কিংবদন্তি’ হয়ে গেছেন বোল্ট। তার পরও একটা অতৃপ্তি ছিলই। বোল্ট-ফেলপসদের সমস্যা হলো, তাঁদের বিচারটা হয় তাঁদেরই ঠিক করে দেওয়া মানদণ্ডে। যে কারণে চারটি সোনা জেতার পরও ফেলপসকে ‘ব্যর্থ’ মনে হয়। বোল্ট ‘স্প্রিন্ট ডাবল’ অক্ষুণ্ন রাখার প্রথম কীর্তি করার পরও আফসোস থাকে—বেইজিংয়ে তিনটি ইভেন্টেই বিশ্ব রেকর্ড গড়ে সোনা জিতেছিলেন। আর এখানে তো একটা বিশ্ব রেকর্ডও হলো না!

গত পরশু সেই অতৃপ্তিও ঘুচিয়ে দিলেন বোল্ট। ৪ গুণিতক ১০০ মিটার রিলেতে জ্যামাইকার শেষ লেগটা দৌড়ালেন। এই অলিম্পিকে প্রথম উজাড় করে দিলেন নিজেকে। তাতে যা হওয়ার তা-ই হলো, বিশ্ব রেকর্ড ভেঙে খানখান! আগের রেকর্ডটাও ছিল জ্যামাইকার। সেটিকে দশমিক ৮ সেকেন্ড কমিয়ে আনলেন বোল্ট-ব্লেকরা। বোল্ট ট্র্যাকে নামা মানেই অপার্থিব কিছুর প্রত্যাশা। সেটি মিটিয়ে দেওয়ার পর বোল্ট ব্যাটনটা স্মারক হিসেবে নিজের কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। নিয়মবিরুদ্ধ বলে কর্মকর্তারা রাজি হচ্ছিলেন না। সংবাদ সম্মেলনে কৌতুককর ভঙ্গিতে সেই ঘটনার বর্ণনা দিলেন বোল্ট, ‘অদ্ভুত সব নিয়ম! যখন বলা হলো, ব্যাটনটা না দিলে আমাদের নাকি ডিসকোয়ালিফাইড করে দেওয়া হবে, তখন দিয়ে দিলাম। পরে অবশ্য তা ফিরে পেয়েছি।’

রিলে-উত্তর সংবাদ সম্মেলনেই কিংবদন্তি বিষয়ে জ্যাক রগের ভিন্নমতের কথা উঠল। বোল্টের উত্তরটাও হলো তাঁর দৌড়ের মতোই, ‘আমি একটা প্রশ্ন দিয়ে উত্তর দিই—কিংবদন্তি হতে হলে আমাকে আর কী করতে হবে? আমি অলিম্পিকে দুটি ইভেন্টই (১০০ ও ২০০ মিটার) দুবার জিতেছি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সোনা জিতেছি। অনেকবার বিশ্ব রেকর্ড ভেঙেছি। আমি জানি না, আমাকে আর কী করতে হবে। এর পর যখন ওনার সঙ্গে দেখা হবে, তাঁকে জিজ্ঞেস করবেন মানুষ আগে কখনো করেনি এমন আর কী উনি আমাকে করতে বলেন।’

বোল্টের ওই পাল্টা তির ছোড়ার পর কাল সকালে জ্যাক রগের প্রাত্যহিক সংবাদ সম্মেলনে কেউ না-কেউ প্রশ্নটা করতেনই। করলেন এক ব্রিটিশ মহিলা সাংবাদিক। জ্যাক রগের উত্তরটা বাংলা করা খুব কঠিন, তবে প্রকারান্তরে বোল্টকে কিংবদন্তি বলে মেনেই নিলেন তাতে। বোল্টকে আইকন আগেই বলেছিলেন, সর্বকালের সেরা স্প্রিন্টারের স্বীকৃতিও দিলেন, সঙ্গে বললেন, ‘হি ইজ আ অ্যাকটিভ পারফরম্যান্স লেজেন্ড।’

‘অ্যাকটিভ পারফরম্যান্স লেজেন্ড’ মানে কী? এখনো পারফর্ম করে যাচ্ছেন, এমন কিংবদন্তি? উসাইন বোল্ট যে নিজেকে ‘জীবন্ত কিংবদন্তি’ বলছেন, তার মানেও তো এটাই হয়, নাকি?

‘অ্যাকটিভ পারফরম্যান্স লেজেন্ড’ বলুন বা জীবন্ত কিংবদন্তি—বাকি সব ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত লন্ডন অলিম্পিকের মহানায়ক ৬ ফুট ৫ ইঞ্চি লম্বা ওই লোকটাই!

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×