এক লঙ্কানের বিশ্বজয়

লাহোর ফাইনালে অরবিন্দ ডি সিলভার অমর সেই ইনিংস

উৎপল শুভ্র

১৪ মে ২০২১

লাহোর ফাইনালে অরবিন্দ ডি সিলভার অমর সেই ইনিংস

ফাইনাল জিতিয়ে ফেরার পর সতীর্থ-সাংবাদিক পরিবৃত অরবিন্দ ডি সিলভা

আজ থেকে অনেক বছর পর তাঁকে ঘিরে বসা নাতি-নাতনিদের যখন তার গৌরবের গল্প বলতে বসবেন বৃদ্ধ ডি সিলভা, একটি ইনিংসের স্মৃতিচারণা একেবারেই অন্যরকম করে তুলবে তাঁকে। নাতি-নাতনিরা অবাক হয়ে দেখবে এতক্ষণ ইয়ার্কি-ফাজলামোতে চারপাশ মাতিয়ে তোলা তাঁদের দাদু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন, অস্বাভাবিক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাঁর চোখ-মুখ। অনুমান করা কোনো সমস্যাই নয়–তখন লাহোরের সেই বিশ্বজয়ের রাতের গল্প বলছেন অরবিন্দ ডি সিলভা!

৭ মার্চ নয়, একদিন আগেই শুরু হয়ে গিয়েছিল তাঁর বিশ্বকাপ ফাইনাল। সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলতে আপত্তি করতেই পারেন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের যেকোনো তারকার ইন্টারভিউ চাওয়ার সময়ই এর মানসিক প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু অরবিন্দ ডি সিলভার প্রতিক্রিয়াটা হলো একটু ব্যতিক্রমী, ইন্টারভিউয়ের জন্য একটু সময় চাইতেই তিনি যেন অনুনয় করলেন, 'প্লিজ, আজ আর আমি একদম কথা বলতে চাই না। কাল ম্যাচ শেষে বলব।'

গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের দুই প্রান্তের নেটে তখন দুই ফাইনালিস্ট। ভিড়টা বেশি মার্ক টেলরের দলকে ঘিরেই। স্টিভ ওয়াহ-মার্ক ওয়াহ-শেন ওয়ার্নদের হাসিখুশিও দেখাচ্ছে বেশি। সে তুলনায় শ্রীলঙ্কান প্রান্তের আবহাওয়াটা একটু যেন গুমোট। শ্রীলঙ্কানরা এমনিতে খুবই হাসিখুশি, কিন্তু সেদিন তাদের হাবভাব এতটাই চরিত্রবিরুদ্ধ যে, আজও মনে আছে তা দেখে এক ভারতীয় সাংবাদিক বন্ধুর মন্তব্য। 'তিরাশির ফাইনালের আগের দিন লর্ডসে না থেকেও আমি নিশ্চিত বলতে পারি, সেদিনও ভারতের অবস্থা এমন করুণ দেখাচ্ছিল না’–ওর এ কথা বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়নি, শ্রীলঙ্কানদের দেখে এ রকম মনে হওয়ার কারণ ছিল। মনে হচ্ছিল ফাইনালের আগের দিন এসে হঠাৎই যেন জয়াসুরিয়া-মহানামা-ভাসরা বুঝতে পেরেছেন, কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছেন তাঁরা! অরবিন্দ ডি সিলভাকে গম্ভীর দেখাচ্ছে এদের চেয়েও বেশি। একটু আগে নেটে ব্যাটিং সেরে এসেছেন। তারপর থেকে একদমই চুপচাপ। তিনি দলের সহ-অধিনায়ক, তাই অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা, কোচ ডেভ হোয়াটমোর, ম্যানেজার দিলীপ মেন্ডিসের সঙ্গে আলোচনায় যোগ দিতে হচ্ছে মাঝে-মধ্যেই। তবে পর মুহূর্তেই যেন ভিড়ের মধ্যেও একা হয়ে যাচ্ছেন আবার। নেটের পাশে চেয়ার ছাড়াও হাতল লাগানো যে একটা বেঞ্চমতো ছিল, বেশির ভাগ সময় তারই এক কিনারায় বসে কী যেন ভাবছেন। তখনই কলকাতার সেমিফাইনালে খেলা অসাধারণ ইনিংসটির জন্য অভিনন্দন জানিয়ে ইন্টারভিউয়ের জন্য একটু সময় চাওয়া আর চাইতেই প্রায় অনুনয়ের ওই ভঙ্গি। এরপরও শ্রীলঙ্কা দল যে আধঘণ্টামতো গাদ্দাফিতে রইল, সে সময়টাতেও একই দৃশ্য, অরবিন্দ পিন্নাদুয়াগা ডি সিলভা যেন ধ্যানমগ্ন।

ফাইনালের আগে ডি সিলভা যেন ধ্যানমগ্ন ঋষি। ছবি: গেটি ইমেজেস

পরদিন, বলা ভালো, পরের রাতে রহস্যটা পরিষ্কার হলো। ব্যাখ্যা হতে পারে এটাই–অরবিন্দ ডি সিলভা বিশ্বকাপ ফাইনালটিকে তাঁর জীবনের সেরা রাত করে তোলার প্রতিজ্ঞায় আগের দিন থেকেই শাণিত করে তুলতে শুরু করেছিলেন নিজেকে। সে কারণেই তাঁর অমন ধ্যানমগ্ন চেহারা। অরবিন্দ ডি সিলভার বিশ্বকাপ ফাইনাল শুরু হয়ে গিয়েছিল একদিন আগেই!

লাহোরে বিশ্বকাপ ফাইনালের বছরখানেক পর শ্রীলঙ্কা এশিয়া কাপের সময় গাদ্দাফি স্টেডিয়ামের ওই দৃশ্যটি তিনি মনেই করতে পারলেন না। 'মনে হচ্ছিল, তখনই আপনার বিশ্বকাপ ফাইনাল শুরু গেছে'--এ কথাতেও শুধু সামান্য হাসি। চমকে দেওয়ার মতো কোনো প্রতিক্রিয়া অবশ্য আশাও করিনি। কারণ অরবিন্দ ডি সিলভার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে এমন উত্তর পাওয়ার অভিজ্ঞতাই বেশি। ব্যাট হাতে বোলারদের জন্য যেমন তিনি প্রায়ই দুঃস্বপ্নের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠেন, আরেকটি ক্ষেত্রেও তাঁকে তেমনি 'দুঃস্বপ্ন' বলে মানতে হবে। ইন্টারভিউ করার সাবজেক্ট হিসেবেও অরবিন্দ ডি সিলভা একরকম দুঃস্বপ্নই।

ব্যাট হাতে এমন বিধ্বংসী স্ট্রোক মেকার, অথচ কথা বলার সময় হাত দুয়েক দূর থেকে শোনা যায় না এমন মিনমিনে গলা, বেশির ভাগ প্রশ্নের এক-দুই লাইনের জবাব। সেসবও বেশির ভাগই 'আই প্লেড ওয়েল', 'আই ওয়ান্ট টু ডু ওয়েল ফর মাই কান্ট্রি' জাতীয়। '৯৬ বিশ্বকাপেই ফয়সালাবাদে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালের আগের দিন ইন্টারভিউ নিতে গিয়ে দেখলাম উত্তরগুলো আরও সংক্ষিপ্ত হয়ে গেছে। তাঁর হোটেল রুমে উপুড় হয়ে শুয়ে শরীর ম্যাসাজ করাতে করাতে আমাদের প্রশ্নের জবাব দিচ্ছিলেন ডি সিলভা। আমাদের মানে আমি আর কলকাতার 'আজকাল' পত্রিকার বন্ধু সাংবাদিক পার্থ রুদ্র। মনে আছে ইন্টারভিউ শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনই নোট বুক-টুক বন্ধ করে ফেলেছিলাম। ডি সিলভা এক-দুই লাইনের যেসব উত্তর দিচ্ছেন, তা নোট করার প্রয়োজন পড়ে না, এমনিতেই তা মনে রাখা সম্ভব। উত্তরের চেয়ে প্রশ্নগুলো মনে রাখাই বরং বেশি জরুরি। কারণ বেশির ভাগ উত্তর তো প্রশ্নের উত্তর 'হ্যাঁ' বা 'না' জাতীয়ই ।

হঠাৎই যে দু-একটা ব্যতিক্রম হচ্ছে, সেগুলোও ভয়ঙ্কর। একটি উদাহরণ দিই। ঠিক আগের মৌসুমে কেন্টের পক্ষে মাতিয়ে এসেছেন ইংলিশ কাউন্টি ক্রিকেট। দুটি ডাবল সেঞ্চুরিসহ বিস্তর রান করেছেন কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশিপে। তবে অরবিন্দ ডি সিলভা সেরা ইনিংসটি খেলেছিলেন ওয়ানডেতে। বেনসন অ্যান্ড হেজেস ওয়ানডে টুর্নামেন্টের ফাইনালে ৯৩ বলে ১২৬ রানের ইনিংসটি পরাজিত দলে থাকার পরও 'ম্যান অব দ্য ম্যাচ' বানিয়েছিল তাঁকে। এটি অবশ্য এমন কোনো ব্যাপার নয়। ব্যাপার হলো, আসিফ ইকবাল সেটিকে বর্ণনা করেছিলেন, ‘ওয়ান অব দ্য গ্রেটেস্ট ওয়ানডে ইনিংস' বলে, ইয়ান বোথাম অন্যতম-টন্যতম ব্যবহার না করে সরাসরিই বলেছিলেন, এটি তাঁর দেখা সেরা ওয়ানডে ইনিংস। অথচ বোথাম-আসিফ ইকবালের প্রশংসার কথা বলে-টলে যখন এই ইনিংসটির কথা তোলা হলো, পাঁচ শব্দ বিশিষ্ট এক বাক্যেই ডি সিলভার কথা শেষ, 'আই প্লেড ওয়েল দ্যাট ডে'। যেন ৯৩ বল খেলে করা ১২৬ রানের ইনিংসটিতে ডি সিলভা ভালো খেলেছিলেন কি না, এই সন্দেহে ভুগতে থাকায় তা নিরসনের জন্যই আমরা তাঁর কাছে গিয়েছি। মনে পড়ে ডি সিলভার হোটেল রুম থেকে বেরিয়ে পার্থকে বলেছিলাম, 'ওই যে একটা গল্প আছে না যে, এক লোক শুধু "ইয়েস", "নো", "ভেরি গুড"–এই তিনটি ইংরেজি শব্দই জানত, এটিও তো তেমনি "ইয়েস", "নো", "ভেরি গুড"--মার্কা ইন্টারভিউই হলো।'

কে জানে, পুরষ্কার বিতরণী মঞ্চে ইয়ান চ্যাপেল তাঁর মুখ থেকে কীভাবে কথা বের করেছিলেন!

সেটিই প্রথম নয়, এর আগেও অরবিন্দ ডি সিলভাকে ইন্টারভিউ করার অভিজ্ঞতাটা মোটামুটি এ রকমই হয়েছে। তারপরও গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে তাঁর ইন্টারভিউ-প্রার্থী হওয়ার কারণ ইডেন গার্ডেন। দুদিন আগে ভারতের বিপক্ষে সেমিফাইনালে যে ইনিংসটি খেলে এসেছেন ডি সিলভা, সেটিই তাঁর দিকে চুম্বকের মতো টানছিল সব সাংবাদিককে। স্কোরবোর্ডে ১ রান উঠতেই এর আগের ম্যাচগুলোতে শ্রীলঙ্কার সাফল্যের দুই সারথী সনাৎ জয়াসুরিয়া ও রুমেশ কালুভিতারানা নেই, এ অবস্থায় নামতে হয়েছে তাঁকে।

৯০ হাজার দর্শকের উল্লাসকে কান ফাটানোর পর্যায়ে তুলে দিয়ে একটু পরে অশঙ্কা গুরুসিনহাও আউট, ৩৫ রানে নেই তৃতীয় উইকেট। অথচ এর কিছুই তাঁকে স্পর্শ করছে না--এমন ভঙ্গিতে বাউন্ডারির পর বাউন্ডারি বেরিয়ে আসতে থাকল তাঁর ব্যাট থেকে। ৪৭ বলে ৬৬ রান, ৫৬-ই এসেছে ১৪টি বাউন্ডারিতে। অরবিন্দ ডি সিলভা ভারতকে ধ্বংস করে দিয়ে তারপরই ফিরলেন। কলকাতার সেই ইনিংস মাঠে বসে দেখা হয়নি। বিশ্বকাপ ফাইনাল কাভার করার অপেক্ষায় আমি তখন লাহোরে। সেখানকারই এক হোটেলে অবিশ্বাসভরা চোখে তাকিয়ে ছিলাম টিভি পর্দার দিকে। কোনো এলোমেলো মার নয়, নিখুঁত ক্রিকেটিং শট খেলেও কীভাবে বোলিংকে ধ্বংস করে দেওয়া যায়, তারই আদর্শ ডকুমেন্টারি হতে পারে ডি সিলভার ওই ইনিংস।

ফাইনালেও কি অমন একটা ইনিংস খেলার স্বপ্ন দেখছেন—ইন্টারভিউয়ের সুযোগ পেলে প্রথম প্রশ্ন হতো এটাই। উত্তর যেমনই দিন, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় এক দশক কাটিয়ে দেওয়ার পর অন্তত সাংবাদিকদের এসব প্রশ্ন অরবিন্দ ডি সিলভার অনুমান করতে পারারই কথা। সেই প্রশ্নের উত্তর মুখে না দিয়ে ব্যাট দিয়ে দেবেন স্থির করে রেখেছিলেন বলেই হয়তো ফাইনালের আগের দিন কথা বলেননি। প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, পরদিন বলবেন। বললেনও, তখনো তিনি সেই ডি সিলভাই । ক্লাইভ লয়েড ও ভিভ রিচার্ডসের পর মাত্র তৃতীয় ব্যাটসম্যান হিসেবে বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি, '৮৩-তে ভারতের মহিন্দর অমরনাথের পর একই বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল ও ফাইনালে ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ হওয়া প্রথম খেলোয়াড়–এমন কীর্তির পর অরবিন্দ ডি সিলভা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যটি জানালেন, তা হলো. তিনি ‘ভেরি হ্যাপি’। ম্যাচের পরিস্থিতির বিশ্লেষণ নয়, তাঁর ইনিংসের ভালোমন্দ নয়, ডি সিলভার একটা জবাবই ভাঙা রেকর্ডের মতো বাজল বারবার, 'দলের সিনিয়র মেম্বার হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি।'

অন্য সময় হয়তো বিরক্তি লাগত। এখন ভাবতে গেলেও তা লাগে। কিন্তু তখন অরবিন্দ ডি সিলভার সব কিছুই সুন্দর, বিনয়ের উদাহরণ হয়ে এটিও উল্টো কিছু নম্বর যোগ করে দিল তাঁর কীর্তির সঙ্গে। একটু আগে যে ইনিংসটি খেলে এসেছেন, দেখার পর অরবিন্দ ডি সিলভার সব কিছুতেই তখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে মুগ্ধতার উপাদান এবং তার সবই পরে বাড়াবাড়ি বলে মনে হওয়ার মতো নয়। ১৯৭৫ বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি করেছিলেন ক্লাইভ লয়েড, ভিভ রিচার্ডস ১৯৭৯-তে; দুই ‘গ্রেট' ব্যাটসম্যানের দুটি ‘গ্রেট’ ইনিংস, তবে দুজনের সেঞ্চুরিই ছিল প্রথমে ব্যাট করা দলের পক্ষে। বিশ্বকাপ ফাইনালের মতো দম বন্ধ করা উত্তেজনার ম্যাচে চেজ করতে নামা দলের পক্ষে করা সেঞ্চুরি একটু হলেও বাড়তি কৃতিত্ব দাবি করে। '৮৩-র বিশ্বকাপ ফাইনালে প্রথম চেজ করতে নেমে লয়েড-রিচার্ডসরা কী করেছিলেন, সেটিও তো দেখেছে সবাই–বিশ্বকাপ ফাইনালে তিন সেঞ্চুরিয়ানের মধ্যে অরবিন্দ ডি সিলভাকে তাই লয়েড-রিচার্ডসের চেয়ে একটু এগিয়েই রাখতে হয়।

'ভালো ব্যাটসম্যান’, ‘সাধারণ দলের অসাধারণ খেলোয়াড়’–এসব স্বীকৃতি অনেক আগেই পাওয়া। টেকনিক, স্ট্রোক প্লে–এসবের প্রশংসাও নতুন কিছু নয়; প্রশ্ন ছিল যা নিয়ে, সেটি তাঁর টেম্পারামেন্ট। ভালো খেলতে খেলতে, বোলারদের যখন মনে হচ্ছে তাঁর দাসানুদাস, তখনই যাচ্ছেতাই একটি শট খেলে আত্মহত্যা করে বসবেন তিনি–এই ভেবেই নিশ্চিন্ত থাকত প্রতিপক্ষ দল।

সেমিফাইনালের মতো অমন মহাবিপর্যয় হয়নি, তারপরও বিপর্যয় তো অবশ্যই, ফাইনালেও ডি সিলভাকে নামতে হয়েছিল ষষ্ঠ ওভারেই। এবার ২৩ রানেই নেই দুই ওপেনার। আবারও শ্রীলঙ্কান সমর্থকদের অশেষ প্রত্যাশার ভার কাঁধে নিয়ে ধীরে ধীরে উইকেটের দিকে এগোলেন ছোটখাটো মানুষটি। গৌরবের যে ক্ষীণ শিখাটি মিটমিট করে জ্বলছে দূরে, সেটির আলোয় আলোকিত হওয়ার মতো নৈকট্যে শ্রীলঙ্কাকে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে। এই 'দায়িত্ব' শব্দটিতে একটু বেশি জোর দিতে হয়, অরবিন্দ ডি সিলভার ইনিংসটিতে এটিই যোগ করেছে বাড়তি মহিমা।

'ভালো ব্যাটসম্যান’, ‘সাধারণ মানের শ্রীলঙ্কা দলের অসাধারণ খেলোয়াড়’–এসব স্বীকৃতি তাঁর অনেক আগেই পাওয়া। টেকনিক, স্ট্রোক প্লে–এসবের প্রশংসাও নতুন কিছু নয়; প্রশ্ন ছিল যা নিয়ে, সেটি তাঁর টেম্পারামেন্ট। ভালো খেলতে খেলতে, বোলারদের যখন মনে হচ্ছে তাঁর দাসানুদাস, তখনই যাচ্ছেতাই একটি শট খেলে আত্মহত্যা করে বসবেন তিনি–এই ভেবেই নিশ্চিন্ত থাকত প্রতিপক্ষ দল, ক্রিকেট বিশ্ব এই দৃশ্যের পুনরাভিনয়ই দেখে এসেছে এত দিন। ডি সিলভাও যেন ব্যাট করতে নামতেন তাঁর 'ম্যাড ম্যাক্স' নিকনেমটির প্রতি সুবিচার করার প্রতিজ্ঞা নিয়েই।

১৭ মার্চ সন্ধ্যায় লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ব্যাট হাতে যে লোকটি নামলেন, তাঁর নামও অরবিন্দ ডি সিলভা, কিন্তু তিনি অন্য এক ব্যাটসম্যান। প্রথম বলটিকেই বোলারের পাশ দিয়ে ড্রাইভ করে ৩ রান নিয়ে শুরু করা থেকে ঘণ্টা তিনেক পর যখন অর্জুনা রানাতুঙ্গাকে বুকে জড়িয়ে জয়োল্লাস করছেন, তখন পর্যন্ত অরবিন্দ ডি সিলভা মনঃসংযোগের এক প্রতিমূর্তি। বিশ্বকাপ জয়ের মুহূর্তটিতে মাঠে থাকতে চাই–এই প্রতিজ্ঞা করেই যেন নেমেছিলেন ব্যাট করতে, ব্যাট করার সময়ও এই প্রতিজ্ঞাই ফুটে বেরোচ্ছিল তাঁর পুরো অস্তিত্ব থেকে। সেমিফাইনালে স্ট্রোকের ছটায় লজ্জা পাইয়ে দিয়েছিলেন হাজার হাজার ওয়াটের ফ্লাডলাইটকেও।

সেমিফাইনালে স্ট্রোকের ছটায় ম্লান করে দিয়েছিলেন হাজার ওয়াটের ফ্লাডলাইটকেও। ছবি: গেটি ইমেজেস

ফাইনালেও তার পুনরাবৃত্তি করার ইচ্ছে জাগছিল না, তা নয়। অরবিন্দ ডি সিলভা গলা টিপে ধরেছেন সেই ইচ্ছের। স্ট্রোক খেলেছেন, তবে সে সবই কোচিং ম্যানুয়াল থেকে বেরিয়ে আসা নিখুঁত ক্রিকেটিং শট। শুধু ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং নয়, ওয়ানডেতেও যে শুদ্ধ ব্যাটিয়ের জায়গা আছে, যেন তা প্রমাণ করতেই সেদিন অরবিন্দ ডি সিলভার মাঠে নামা। তাতেও কি আর বাউন্ডারি আসছিল না? ভালোই আসছিল। মাঠে নামার দুই ওভার পর ইনিংসের অষ্টম ওভারে তাঁর প্রথম বাউন্ডারি ডেমিয়েন ফ্লেমিংকে করা লফটেড ড্রাইভ ছুটে গেল মিড উইকেট আর লং অনের মাঝখান দিয়ে। ৩ থেকে ৭-এ পৌঁছালেন ডি সিলভা। এর পরের চারটি বাউন্ডারিই এল জোড়ায় জোড়ায়, ডি সিলভার খেলা শটও তা-ই। ফ্লেমিংয়ের পরের ওভারে পর পর দু'বলে মারা দুটি বাউন্ডারিই ফ্লিক করে। পরের বাউন্ডারি-যুগল দ্বাদশ ওভারে শেন ওয়ার্নকে কাভার ড্রাইভের মাধ্যমে। পল রাইফেলের করা ইনিংসের ১৭তম ওভার থেকেও দুটি বাউন্ডারি, তবে এবার পর পর দু'বলে নয়। ২৪তম ওভারে মাত্র ৫০ বলে ফিফটিতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে স্টিভ ওয়াহকেও লেগ গ্ল্যান্স করে মারা হয়ে গেছে আরেকটি বাউন্ডারি। ৫০ বলে ৫০ রান, ৮টি বাউন্ডারি–অথচ অরবিন্দ ডি সিলভাকে একটিও এলোমেলো শট মারতে দেখেনি কেউ। ভাবা যায়!

নিখুঁত ক্রিকেটিং শটে খেলা এক ইনিংস। ছবি: গেটি ইমেজেস

হাফ সেঞ্চুরির পর আবার জোড়া বাউন্ডারি, এবার বোলার রাইফেল। অন্য প্রান্তে বাঁহাতি অশঙ্কা গুরুসিনহারও ভালো খেলতে থাকাটা ছিল বড় আশীর্বাদ। এ কারণেই বাড়তি কোনো দুশ্চিন্তা চেপে বসেনি ডি সিলভার মাথায়, নিজের পরিকল্পনামতো এগিয়ে নিতে পেরেছেন ইনিংসটিকে। রানও আসছিল অনায়াসে, ১১৬ বলেই হয়ে গেল সেঞ্চুরি পার্টনারশিপ। কাগজে-কলমে শ্রীলঙ্কার চেয়ে অনেক বেশি ধারালো অস্ট্রেলীয় বোলিংকে তখন মনে হচ্ছে নখদন্তহীন এক বৃদ্ধ বাঘ, নিয়মবিরুদ্ধ রকম চওড়া মনে হচ্ছে ডি সিলভা-গুরুসিনহার ব্যাটকে।

ক্রিকেট কোচিংকে নতুন মাত্রায় তুলে দেওয়া ববি সিম্পসনের একটি অবিশ্বাস্য ভুলও তখন স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ডে-নাইট ফাইনালের আগে অন্তত এক সেশনও রাতে প্র্যাকটিস না করার ভুল যে কীভাবে করলেন তিনি! লাহোরের রাত এমনই শিশিরভেজা যে, বোলারদের বিশেষ করে স্পিনারদের বল গ্রিপ করতেই গলদঘর্ম অবস্থা। শেন ওয়ার্নকে যে অমন শিক্ষানবিশ এক লেগ স্পিনারের পর্যায়ে নামিয়ে আনলেন শ্রীলঙ্কান ব্যাটসম্যানরা, তাতে এই শিশিরের ভূমিকাও কম নয়। সিম্পসন-টেলরের দৃষ্টি এড়িয়ে গেলেও রানাতুঙ্গা-মেন্ডিস-হোয়াটমোররা ঠিকই খেয়াল করেছিলেন বিষয়টি। এ কারণেই আগের পাঁচটি বিশ্বকাপ ফাইনালেই জিতেছে আগে ব্যাট করা দল–এই ইতিহাস জানা থাকার পরও টস জিতে অর্জুনা রানাতুঙ্গার অস্ট্রেলিয়ার হাতে ব্যাট তুলে দেওয়া।

সেই সিদ্ধান্তে অবাক ভাবটা কাটিয়ে ওঠার পর শ্রীলঙ্কার চেজ করার অসাধারণ সামর্থ্যকেই এর কারণ বলে ভেবে নিয়েছিলেন সবাই। আসল কারণটা বোঝা গেল রাতের বেলায়, যখন পরের বলটি নিয়ে ভাবার চেয়ে রুমাল দিয়ে বল মুছতেই বেশি ব্যস্ত দেখা গেল শেন ওয়ার্নকে। অস্ট্রেলীয় ফিল্ডিংয়ের সঙ্গে বেমানানভাবে এই যে দু-তিনটি ক্যাচ পড়ল, সেটির জন্যও শিশিরকেই দায়ী করেন অনেকে। টসে হারায় আগে-পরে ব্যাট করার ব্যাপারটি যেহেতু অস্ট্রেলিয়ার হাতে ছিল না, তাই শিশিরের ব্যাপারটি খেয়াল করলেও হয়তো খুব বেশি কিছু করার ছিল না সিম্পসনের, তবে আগে থেকেই অন্তত একটু প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগ পেত অস্ট্রেলীয় বোলাররা। ব্যাপারটি তাদের কাছে একদমই অপ্রত্যাশিত, মাঠে অস্ট্রেলীয়দের ভাবভঙ্গি থেকেই তা ছিল পরিষ্কার। সাফল্যের অমন দারুণ রেকর্ডের পরও বিশ্বকাপ শেষেই যে ববি সিম্পসনকে বিদায় নিতে হলো, তাতেও নাকি বড় ভূমিকা ওই শিশিরেরই।

সেঞ্চুরির দিকে তখন যে গতিতে এগোচ্ছেন ডি সিলভা, জয়ের দিকে তার চেয়েও দ্রুত এগোচ্ছে শ্রীলঙ্কা। সেঞ্চুরি না পাওয়ার শঙ্কাটা সেভাবে জেগে ওঠার আগেই কাজ সেরে ফেলাটা কর্তব্যজ্ঞান করে তাই ডি সিলভাও একটু উদ্যোগী হলেন।

শিশিরভেজা বল নিয়ে শেন ওয়ার্নদের দুর্দশা দেখে অরবিন্দ ডি সিলভার তো আর মন খারাপ করার কারণ নেই, তিনি ব্যাপারটি উপভোগই করছিলেন। গুরুসিনহাও তা-ই। তিনি অবশ্য পার্টনারশিপের সেঞ্চুরি হয়ে যাওয়ার পর আর বেশিক্ষণ থাকলেন না। তবে বিশ্বকাপের পর পরই সব ছেড়েছুড়ে অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী হয়ে যাওয়া এই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানের বিদায়ও তখন ডি সিলভার কপালে কুঞ্চন সৃষ্টি করার মতো কিছু বিপর্যয় নয়। হাতে তখনো ৭ উইকেট, বাকি ১৯.৪ ওভারে প্রয়োজন মাত্র ৯৪ রান, তার চেয়েও বড় কথা, ড্রেসিংরুমের সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখছেন দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের সঙ্গী এক মোটাসোটা লোককে। নেমেই রাইফেলকে চার মেরে অর্জুনা রানাতুঙ্গা বুঝিয়ে দিলেন, ম্যাচটিকে শেষ ওভার পর্যন্ত টেনে নেওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই তাঁর। ওয়ার্নকে পর পর দু'বলে চার আর ছয় মারতে দেখে আরও স্পষ্ট হলো সেই মনোভাব।

সেঞ্চুরির দিকে তখন যে গতিতে এগোচ্ছেন ডি সিলভা, জয়ের দিকে তার চেয়েও দ্রুত এগোচ্ছে শ্রীলঙ্কা। সেঞ্চুরি না পাওয়ার শঙ্কাটা সেভাবে জেগে ওঠার আগেই কাজ সেরে ফেলাটা কর্তব্যজ্ঞান করে তাই ডি সিলভাও একটু উদ্যোগী হলেন। ৪৬তম ওভারে মুখোমুখি হওয়া ১১৯তম বলটিতে লেগ গ্লান্স করেই ছুঁয়ে ফেললেন ম্যাজিক ফিগার। গ্যালারিতে শ্রীলঙ্কান পতাকার বিপুল সমারোহ দেখে সে রাতে লাহোরকে মাঝে-মধ্যেই কলম্বো বলে ভুল হচ্ছিল, দর্শকদের কাছ থেকে পাওয়া অভিনন্দনটা তাই স্মরণীয়ই হলো, তবে অরবিন্দ ডি সিলভার কাছে এরচেয়েও অনেক বড় প্রাপ্তি অন্য প্রান্ত থেকে এগিয়ে আসা ব্যাটসম্যানটির আবেগঘন আলিঙ্গন। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটের কঠিন সংগ্রামের দিনগুলোতে হাতে হাত রেখে লড়েছেন, আজ যখন শুধু তাঁদের ক্যারিয়ারের নয়, পুরো দেশের ইতিহাসেরই সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্তটি করমর্দনের দূরত্বে দাঁড়িয়ে, একটু আবেগাক্রান্ত তো তাঁরা হতেই পারেন। ডি সিলভা রানাতুঙ্গার সেই সুযোগও ছিল, বিশ্বকাপের মীমাংসা তো ততক্ষণে হয়েই গেছে। সে ওভারেরই শেষ বলে ১৩তম বাউন্ডারিটি মেরে দু'দলের স্কোর সমান করে দিলেন ডি সিলভা। যেন ইচ্ছে করেই অধিনায়কের হাতে তুলে দিলেন আনুষ্ঠানিকতা সারবার ভার।

১২৪ বলে অপরাজিত ১০৭, এর আগে বোলিংয়ে ৩ উইকেট, দুটি ক্যাচ–কোনো ম্যাচ একজন খেলোয়াড়ের এমন একক প্রদর্শনের মঞ্চে পরিণত হওয়ার ঘটনা সাধারণ ওয়ানডেতেও খুব বেশি ঘটে না, অথচ অরবিন্দ ডি সিলভা বিশ্বকাপ ফাইনালকেই বানিয়ে ফেললেন এমন।

`বিশ্ব`জয়ের পরে। ছবি: গেটি ইমেজেস

সে ইনিংসের তাৎপর্য শুধু শ্রীলঙ্কাকে বিশ্বকাপ জেতানোতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা একই সঙ্গে অরবিন্দ ডি সিলভাকে পাল্টে দেওয়ারও সূচনা। এরপর থেকেই 'ম্যাড ম্যাক্স’ নিকনেম ভুলিয়ে দেওয়ার মতো ধারাবাহিকতা তাঁর ব্যাটে, তিনি আর আগের সেই মাথা গরম ব্যাটসম্যান নন। মাস কয়েক পর দেশের মাটিতে সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ এর বড় প্রমাণ। চার ম্যাচে একবারও আউট না হয়ে ডি সিলভা খেললেন ৪৯, ১২৭, ৯৩ ও ৭৫ রানের চারটি ইনিংস। '৯৬ বিশ্বকাপ শুরু করেছিলেন ৩টি সেঞ্চুরি নিয়ে, পরের বিশ্বকাপটি আসতে আসতে সংখ্যাটি দাঁড়াল ১১। টেস্ট ম্যাচেও দেখা গেল অন্য এক অরবিন্দ ডি সিলভাকে। '৯৭ সালে অবস্থাটা এক সময় এমন দাঁড়াল, কলম্বোতে খেলা হলেই ডি সিলভা-আতঙ্কে ভুগতে শুরু করত প্রতিপক্ষ দলগুলো। '৯৭-এর এপ্রিল থেকে '৯৮-এর জানুয়ারির মধ্যে কলম্বোর দুই মাঠে (প্রেমাদাসা ও এসএসসি) যে ৫টি টেস্ট খেলেছে শ্রীলঙ্কা, তার প্রতিটিতে ডি সিলভার ব্যাট থেকে সেঞ্চুরি তো এসেছেই, জোড়া সেঞ্চুরিও এসেছে তাঁর দুটিতে। শুধু দেশেই বীরত্ব, তা নয়; মুরালিধরনের ঘূর্ণিজাদু আর জয়াসুরিয়ার ডাবল সেঞ্চুরির নিচে বাকি সবই চাপা পড়ে গেলেও '৯৮-তে ওভালে ইংল্যান্ডকে হারানোর কীর্তিতে অরবিন্দ ডি সিলভার ১৫২ রানের ইনিংসটিরও কিন্তু যৎকিঞ্চিৎ ভূমিকা ছিল।

ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় দাঁড়িয়ে অরবিন্দ ডি সিলভা আজ যখন পেছনে ফিরে তাকান, এ রকম অনেক সুখস্মৃতিই ভিড় করে আসে তাঁর মনে। তবে তার মধ্যেও একটি স্মৃতি অন্যরকম। আজ থেকে অনেক বছর পর তাঁকে ঘিরে বসা নাতি-নাতনিদের যখন তাঁর গৌরবের গল্প বলতে বসবেন বৃদ্ধ ডি সিলভা, একটি ইনিংসের স্মৃতিচারণা একেবারেই অন্যরকম করে তুলবে তাঁকে। নাতি-নাতনিরা অবাক হয়ে দেখবে এতক্ষণ ইয়ার্কি-ফাজলামোতে চারপাশ মাতিয়ে তোলা তাঁদের দাদু কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেছেন, অস্বাভাবিক উজ্জ্বল দেখাচ্ছে তাঁর চোখ-মুখ। অনুমান করা কোনো সমস্যাই নয়– তখন লাহোরের সেই রাতের গল্প বলছেন অরবিন্দ ডি সিলভা!

(লেখকের 'সেই সব ইনিংস' বই থেকে)।

আরও পড়ুন: ডি সিলভার একান্ত সাক্ষাৎকার: 'ব্যাটসম্যান টেন্ডুলকার, বোলার হ্যাডলি-ওয়াসিম আকরাম'

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×