‘আমি চাই, বলই আমার হয়ে কথা বলুক’

উৎপল শুভ্র

২৭ জানুয়ারি ২০২১

‘আমি চাই, বলই আমার হয়ে কথা বলুক’

ট্রেন্ট বোল্ট

ফাস্ট বোলার বললেই প্রথাগত যে চেহারাটা চোখে ভেসে ওঠে, এই কিউই সেখানে আশ্চর্য এক ব্যতিক্রম। মুখে হাসি নিয়েও যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার ফুলকি ছোটানো যায়, তার উজ্জ্বল এক উদাহরণও। নিউজিল্যান্ডের টিম হোটেলে একান্ত সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়ও দেখা মিলেছিল সেই সৌম্য-হাসিমুখ ট্রেন্ট বোল্টের।

প্রথম প্রকাশ: ৭ মার্চ, ২০১৯। প্রথম আলো।

উৎপল শুভ্র: প্রথমেই বলুন, মুখে হাসি নিয়ে এমন ভয়ংকর ফাস্ট বোলার হওয়া কীভাবে সম্ভব? 

ট্রেন্ট বোল্ট: স্মাইলিং অ্যাসাসিন (হাসি)! আমি আসলে একটু অন্যভাবে ভাবি। ভাবি, ফাস্ট বোলার হলেই কেন রাগী চেহারা নিয়ে থাকতে হবে! মুখে হাসি নিয়ে খেলাটা উপভোগ করা এবং একই সঙ্গে ভীতিকর ফাস্ট বোলার হওয়া কেন সম্ভব নয়! 

শুভ্র: সম্ভব যে, সেটা তো আপনি প্রমাণই করেছেন। তবে ফাস্ট বোলারদের সঙ্গে রাগে গনগনে চোখমুখ, গালাগালি এসব তো সমার্থক বলেই ধরে নেয় সবাই। আপনি যে অন্য রকম, এটা কি সহজাত, নাকি কোনো একপর্যায়ে এসে মনে হলো যে ‘না, আমি অন্যদের চেয়ে আলাদা হব?’

বোল্ট: আমার মনে হয়, এটা সহজাতই। আমি বলব, এটাই নিউজিল্যান্ডের ধরন। আমরা খেলার সঠিক চেতনাটা হৃদয়ে নিয়ে খেলি। কমপিটিটিভ হওয়ার জন্য তো রাগী চেহারা, গালিগালাজ, স্লেজিংয়ের দরকার নেই। আমি চাই, বলই আমার হয়ে কথা বলুক। এসব না করে মুখে হাসি রেখে আমি খেলাটা উপভোগ করতে চাই। 

শুভ্র: আপনার শারীরিক গড়ন, ভাবভঙ্গি কোনো কিছু দেখেই বোঝার উপায় নেই, আপনি কেমন গতির ঝড় তুলতে পারেন। এই গতিটাও কি সহজাত নাকি হঠাৎই কোনো পরিবর্তনের গল্প আছে? 

বোল্ট: আমার বড় ভাইও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছে। বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। ওর সঙ্গে খেলার সময় ছোট ভাই বলে আমাকে বোলিংই বেশি করতে হতো। তা করতে করতেই বোলার। জোরে বল করার ক্ষমতাটা আমার সব সময়ই ছিল। এ কারণেই ওয়াসিম আকরাম, ডেল স্টেইনকে আদর্শ মেনেছি সব সময়। 

শুভ্র: ওয়াসিম আকরামের বোলিংয়ের কোন দিকটি বেশি ভালো লাগত? 

বোল্ট: যেভাবে তিনি সুইং করাতেন। যেভাবে অ্যারাউন্ড দ্য উইকেট এসে বল করতেন, বিশেষ করে সাদা বলে, ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের জন্য বলকে যেভাবে রিভার্স সুইং করাতেন—সব মনে গেঁথে আছে। তাঁর বোলিং অ্যাকশনও আমার খুব পছন্দের। কেমন একটা হুড়মুড় ভাব ছিল, উইকেটে এসে খুব দ্রুত বল ছাড়তেন, হাত-পা দ্রুত নড়াচড়া করত। হয়তো তাঁর অ্যাকশনের সঙ্গে আমার কিছু মিল আছে। 

শুভ্র: ফাস্ট বোলিং নিয়ে ওয়াসিম আকরামের সঙ্গে কখনো কথা হয়েছে? 

বোল্ট: কয়েকবার। ২০১৫ আইপিএলে, যখন তিনি কলকাতায় (নাইট রাইডার্স), তখন প্রথমবার দেখা হয়েছিল। বোলিং করেছিলাম। তিনি বলেছিলেন, আমি যেভাবে বোলিং করি, সেটা তাঁর ভালো লাগে। আমার নায়কের সঙ্গে দেখা হওয়া, তিনি কীভাবে বোলিং করতেন সেটা বোঝার সুযোগ পাওয়া...সব মিলিয়ে সেটি ছিল দারুণ এক অভিজ্ঞতা। 

শুভ্র: আপনার বোলিংয়ে বাড়তি কিছু যোগ করতে বা নির্দিষ্ট কিছু নিয়ে কাজ করতে বলেছিলেন? 

বোল্ট: আমি সবচেয়ে বেশি জানতে চেয়েছিলাম, উপমহাদেশে কীভাবে বোলিং করতে হয়। নিউজিল্যান্ডে উইকেটে অনেক বাউন্স থাকে, গতি পাওয়া যায়। সুইংও পাওয়া যায় বলে সবকিছুই আলাদা। ভারত, আবুধাবি, দুবাই, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশেও একটু-আধটু সুইং পাওয়া যায়, তবে সেখানে উইকেটে গতি থাকে না। তাই তিনি যেভাবে রিভার্স সুইং করাতেন, তা-ও ওই গতিতে, সেটা আমার কাছে অবিশ্বাস্য ছিল। তাঁর কবজির ব্যবহারটাই ছিল এর মূলে। আমিও এটিই করার চেষ্টা করি। বল ছাড়ার সময় আসলে কবজির জোরটা লাগে। তবে ফাস্ট বোলিংয়ের ক্ষেত্রে মূল ব্যাপারটা হচ্ছে মানসিকতা। যত বেশি সম্ভব বোলিং করতে চাওয়া, কঠিন পরিস্থিতিতেও বল হাতে নেওয়া। আমার মনে হয় এটাই আমার বড় একটা শক্তির জায়গা। 

এই উল্লাস আরেকটি উইকেট পাওয়ার। লুকিয়ে রাখা ফাস্ট বোলারের আগুনটা ফুটে বেরোয় যখন

শুভ্র: আপনি এই মুহূর্তে বিশ্বের সেরা সুইং বোলারদের একজন। এই সুইং কি কখনো আপনাকে চমকে দিয়েছে? এমন হয় না যে কোনো দিন হয়তো মেঘলা আকাশ, মনে হচ্ছে ভালো সুইং হবে, কিন্তু হলো না। আবার কখনো হয়তো সুইংয়ের জন্য অনুকূল পরিবেশ না থাকার পরও বল সুইং করতে শুরু করল। এমন অভিজ্ঞতা কি হয়েছে আপনার? 

বোল্ট: হ্যাঁ, এমন তো হয়েছেই। হয়তো সবকিছু সুইং করানোর অনুকূল মনে হচ্ছে, কিন্তু কোনো কারণে বল সুইং করছে না। নির্দিষ্ট কোনো কারণ আছে কি না জানি না, তবে আমার মনে হয়, সাদা বলে আমি সবচেয়ে ভালো সুইং করাতে পেরেছি ২০১৫ বিশ্বকাপে। সত্যি বলতে এরপর আর সেভাবে সুইং পাইনি। জানি না কেন এমন হচ্ছে—বলের কারণে, নাকি আমার বল ছাড়ায় সমস্যা, নাকি কন্ডিশন, কে জানে। আরেকটা বিশ্বকাপ চলে আসছে, আশা করছি বল আবার সেভাবে সুইং করবে। 

শুভ্র: মাঝে মাঝে এমন দিনও কি আসে না, যখন মনে হয় আজ সব আমার ইচ্ছেমতো হবে। হাতে বলের স্পর্শটা ভালো লাগছে, শরীরটাও চনমনে...এমন কোনো ম্যাচের কথা মনে পড়ছে, যেটিতে এই অনুভূতি হয়েছে? 

বোল্ট: হ্যাঁ, অবশ্যই। মাঝে মাঝে ছন্দটা খুব ভালো বলে মনে হয়, বলটা হাত থেকে সুন্দরভাবে বেরোয়, হয়তো তেমন কষ্ট ছাড়াই উইকেট আসতে থাকে। অবশ্যই অমন দিনের চেয়ে খারাপ দিনই বেশি থাকে, তাই ওই দিনগুলোতেই আমাকে অনেক বেশি হাসতে দেখবেন। এমন দিন তো আর বেশি আসে না। গত বছর এখানে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে যখন গোলাপি বলে টেস্ট খেলেছিলাম, আমি আর সাউদি মিলে প্রথম ইনিংসে ১০ উইকেটের সবগুলোই নিয়েছিলাম। বলে অনেক সুইং হচ্ছিল, আমরা ওদের খুব কম রানে (৫৮) অলআউট করে দিয়েছিলাম। ওটা ছিল ওই রকম একটা দিন। 

শুভ্র: সাউদির সঙ্গে মিলে আপনি তো সেরা সুইং বোলিংয়ের বিবেচনায় সেরা এক জুটি গড়েছেন। এর রসায়নটা কী? 

বোল্ট: আমার মনে হয়, এটা দারুণ বন্ধুত্বের কারণে হয়েছে। ১০ বছরের বেশি সময় দেশের হয়ে খেলছি, এই পুরো সময়টাতেই আমরা দুজন খুব ভালো বন্ধু। এমন নয় যে আমরা ১০ বছর আগে একসঙ্গে বসে ঠিক করেছি, আমরা এটা-ওটা করব। টিম অসাধারণ বোলার, অনেক অভিজ্ঞ। আমার মনে হয় আমি যেদিকে সুইং করাই, ও তার উল্টো দিকে করায় বলে সমন্বয়টা ভালো হয়। আমরা দুজন মিলে স্মরণীয় অনেক কিছু করেছি। আশা করি, সামনে এমন আরও অনেক ভালো দিন আসবে। এসব নিয়ে হয়তো খুব বেশি কথা বলি না। আমাদের দুজনেরই এমন প্রতিদ্বন্দ্বিতার মেজাজ যে আমাদের নিজেদের মধ্যেও একটা প্রতিদ্বন্দ্বিতা আছে।

শুভ্র: নিজেদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা—ওয়াসিম-ওয়াকারের মতো? 

বোল্ট: স্বাস্থ্যকর প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা আমি খুব উপভোগ করি। 

শুভ্র: ২০১৫ বিশ্বকাপের কথা বলছিলেন। সেটিই কি ট্রেন্ট বোল্টের সেরা রূপটা দেখেছে? নিউজিল্যান্ড সেই বিশ্বকাপে যেভাবে খেলেছে, সব মিলিয়ে ওই বিশ্বকাপই কি আপনার সবচেয়ে গর্বের স্মৃতি? 

বোল্ট: অবশ্যই খুব প্রিয় স্মৃতি। ওই বিশ্বকাপে আমি যেভাবে বোলিং করছি, তাতে মনে হয় ওই কদিনেই আমি খেলোয়াড় হিসেবে অনেক পরিণত হয়ে উঠেছি। তখন আমি একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলাম। বিশ্বকাপ দলে নির্বাচিত হওয়ার আগে নিউজিল্যান্ডের হয়ে ১০টি মাত্র ম্যাচ খেলেছি। স্কোয়াডে থাকতে পেরেই তাই খুশি ছিলাম। ভাবিওনি যে আমি বিশ্বকাপে সব ম্যাচ খেলব, সর্বোচ্চ উইকেটশিকারিদের একজন হব। অনেক মধুর এক স্মৃতি ওই বিশ্বকাপ।

শুভ্র: আপনার অভিষেক টেস্টও তো স্মরণীয় এক স্মৃতি হয়ে থাকার কথা। শেষ মুহূর্তে খেলার সুযোগ পেলেন, আমি তো বলব, ম্যাচটাও আপনিই জিতিয়েছেন। দ্বিতীয় ইনিংসে আপনার ২৩ রান, নিউজিল্যান্ড জিতেছিল ৭ রানে। আপনিই তাই আমার ম্যান অব দ্য ম্যাচ...

বোল্ট: অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, অনেক বিশেষ একটা মুহূর্ত। আপনি যেটা বললেন, আমার ওই ম্যাচে খেলারই কথা ছিল না। সকালবেলা ড্যানিয়েল ভেট্টোরি চোটে পড়লেন, তিনিই আমাকে ক্যাপটা দিয়ে শুভকামনা জানালেন। অসাধারণ ছিল সেটা। মাঠে নামা, আমার প্রথম টেস্ট... মাইক হাসি ছিল আমার প্রথম উইকেট। সেই ২০১১ সালের ঘটনা, তারপরও এখনো সব মনে স্পষ্ট মনে পড়ে।

শুভ্র: আপনি এবং সাউদি তো আছেনই, এর বাইরে এই মুহূর্তে সেরা সুইং বোলার বলবেন কাকে? আপনি দেখেছেন, এমন বোলারদের মধ্যেই–বা কাকে সেরা মনে করেন? 

বোল্ট: ডেল স্টেইনকে আমার পরিপূর্ণ একটা প্যাকেজ মনে হয়। দেশে, দেশের বাইরে সব জায়গাতেই পারফর্ম করতে পারেন। সুইং করাতে পারেন। আগেই বলেছি, আমার জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা তিনি। বোলিংয়ের সময় তাঁর চোখমুখ যেমন করেন, সেটি অবশ্য আমার চেয়ে আলাদা (হাসি)। এর বাইরে ভুবনেশ্বর কুমার অনেক স্কিলফুল একজন বোলার। দুই দিকেই সুইং করাতে পারে, নাকল-বলসহ আরও কিছু বৈচিত্র্য আছে। ভালো গতিও আছে। ওর বোলিং দেখতে রোমাঞ্চকর লাগে। টেস্ট ক্রিকেট, সাদা পোশাক....এ সবের সঙ্গে ট্রেন্ট বোল্টের এই উদযাপন দারুণ যায়, তাই না?শুভ্র: আপনি বোলিং করেছেন, এমন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে সেরা কে? 

বোল্ট: অবশ্যই বিরাট। সবাই-ই বিরাট কোহলির কথা বলবে। যেকোনো ফরম্যাটেই। ওর উপস্থিতিই চাপে ফেলে দেয়। 

শুভ্র: সেটি কীভাবে—শরীরী ভাষা দিয়ে? 

বোল্ট: ওহ, ও যেন বোলারকে খারাপ বল করতে বাধ্য করে। নিজের সেরা বলটা করলেও ও সেটা আরামে খেলে ফেলবে। তাই সবার আগে বিরাট। শিবনারায়ণ চন্দরপলকে বোলিং করতে সব সময়ই ঝামেলায় পড়েছি। যেভাবে দাঁড়াতেন, সেটাই আমাকে সমস্যায় ফেলে দিত। অথচ ঘটনা কি জানেন, বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের বিপক্ষে বোলিং করতেই কিন্তু আমি বেশি পছন্দ করি। অ্যালিস্টার কুকের বিপক্ষে বোলিং করাটাও কখনো কখনো কঠিন মনে হয়েছে। কারণ, কুক ছিল বল ছেড়ে দেওয়ার ওস্তাদ। আপনি খুব ভালো একটা বল করলেন আর দেখা গেল, ও সেটা দেখেশুনে ছেড়ে দিল। তখন কেমন হতাশ লাগে, ভাবুন একবার! এই তিনজনের কথাই বলব। 

শুভ্র: বাইরে থেকে আমরা দেখেছি, ব্রেন্ডন ম্যাককালাম কীভাবে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের দর্শনই বদলে দিয়েছেন। তাঁর নেতৃত্বে আক্রমণাত্মক উপভোগ্য ক্রিকেটের নতুন এক ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে নিউজিল্যান্ড। আপনার কাছে জানতে চাই, ম্যাককালাম আসলে কী বদলেছেন, কী করেছেন খেলোয়াড়দের মানসিকতা বদলে দিতে? 

বোল্ট: ব্রেন্ডন ছিল ভয়ডরহীন একজন নেতা। ওর খেলার ধরনটাই আগ্রাসী, সব সময়ই আক্রমণাত্মক। ওর নেতৃত্বের আসল কারিশমা ছিল, খেলোয়াড়দের মনে নিজেদের সামর্থ্য সম্পর্কে বিশ্বাস জাগানো। বলছিলাম না, ২০১৫ বিশ্বকাপের আগে আমি মাত্র ১০টির মতো ম্যাচ খেলেছিলাম। আর ও এসে হয়তো আমাকে বলল, ‘হেই, তোমার ওপর আমার পুরো আস্থা আছে। মাঠে নেমে মুখে হাসি নিয়ে খেলো। ওই ছোট্ট ছেলেটার কথা ভাব, যে বাড়ির পেছনের আঙিনায় বোলিং করার সময়ে খেলাটার প্রেমে পড়েছিল। খেলাটা উপভোগ করো।’ ওর এই ভাবনাটাই সংক্রামক হয়ে ছড়িয়ে পড়েছিল দলে। বিশ্বকাপের সময়টা ছিল অবিশ্বাস্য। আমি বলব, এর পুরো কৃতিত্বই ব্রেন্ডনের।

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×