কাকতালীয়, ছেড়ে দেওয়া ওয়ানডে এবং একটি রেকর্ড

উৎপল শুভ্র

৮ মে ২০২১

কাকতালীয়, ছেড়ে দেওয়া ওয়ানডে এবং একটি রেকর্ড

কাকতালীয় ঘটনা কতই তো ঘটে ক্রিকেটে! এমসিসির শততম বার্ষিকীতে সভাপতি হিসেবে যেমন পাওয়া যায় মাইকেল কলিন কাউড্রেকে (নামের আদ্যক্ষর মেলালে `এমসিসি`ই হয় কিন্তু), ক্রিকেটের প্রথম টেস্ট আর ১০০ বছর পরের টেস্টের ফলাফলও মিলে যায় হুবহু। এই লেখাটি তেমন কিছু কাকতালীয় ঘটনারই সম্মিলন, সঙ্গে আছে ম্যাচ ছেড়ে দেওয়ার আর ব্যাট ক্যারি করার ইতিবৃত্তও!

প্রথম প্রকাশ: ৩ নভেম্বর ২০০৬। প্রথম আলো।

ক্রিকেট-ভক্ত বাবা ছেলের নাম রাখলেন মাইকেল কলিন কাউড্রে। সব বাবা-মা'ই অনেক ভেবেচিন্তে সন্তানের নাম রাখেন। এখানে চিন্তাভাবনাটা আরও বেশি হয়েছিল। এমন একটা নাম দরকার ছিল, যেটির আদ্যক্ষরগুলো মিলে এমসিসি হয়। এমসিসি মানে মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব, ক্রিকেটের আদি অভিভাবক এবং আইন প্রণেতা। সেই ছেলে বড় হয়ে ইংল্যান্ডের পক্ষে টেস্ট খেললেন, অধিনায়ক হলেন। প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে শততম টেস্ট খেলার কৃতিত্বও তাঁর। বাবা বোধ হয় এতটা আশা করেননি। যেটি বলার জন্য এত ভূমিকা–মেরিলিবোন ক্রিকেট ক্লাব, অর্থাৎ এমসিসির শততম বার্ষিকীতে দেখা গেল, সভাপতির নামও এমসিসি! মাইকেল কলিন কাউড্রে!

কাকতালীয় বলবেন?

ক্রিকেটে এমন কাকতালীয় ঘটনা অনেক। তবে এর মধ্যে সেরা তিনটি এমনই যে, ‘কাকতালীয়’-এর বদলে দৈব-নির্ধারিত বলে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়।

ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের ছবি।

• কাকতালীয় ঘটনা নম্বর এক–১৮৭৭ সালে মেলবোর্নে ইতিহাসের প্রথম টেস্টে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪৫ রানে জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। ১৯৭৭ সালে মেলবোর্নেই সাড়ম্বরে আয়োজিত শতবার্ষিকী টেস্টেও ফলাফল একই। ইংল্যান্ডকে ৪৫ রানে হারাল অস্ট্রেলিয়া!

• কাকতালীয় ঘটনা নম্বর দুই—প্রথম টেস্ট ম্যাচটি হয়েছিল যে মাঠে, ১৯৭১ সালে। প্রথম একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচটিও হলো সেই এমসিজিতেই। পরিকল্পনা করেই এমন করা হয়েছিল বলার উপায় নেই। বৃষ্টির কারণে টেস্ট ম্যাচ না হওয়ায় তড়িঘড়ি করে আয়োজিত হয়েছিল ৪৫ ওভারের ওই ম্যাচ। দৈব-নির্ধারিত তো আর এমনিতেই বলিনি।

• কাকতালীয় ঘটনা নম্বর তিন—এটি ওপরের ঘটনাটির সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথম টেস্টের মতো ইতিহাসের প্রথম ওয়ানডেতেও জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। সংক্ষিপ্ত স্কোরটা জানিয়ে দিই, কারণ এটি কাজে লাগবে। ইংল্যান্ড ৩৯.৪ ওভারে ১৯০, অস্ট্রেলিয়া ৩৫ ওভারে ১৯১/৫। চার বছর পর অস্ট্রেলিয়ায় আয়োজিত ওয়ানডেটির ভেন্যুও সেই মেলবোর্ন। প্রতিদ্বন্দ্বী দল দুটিও আবার ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। সে ম্যাচের সংক্ষিপ্ত স্কোর: অস্ট্রেলিয়া ৩৪.৫ ওভারে ১৯০, ইংল্যান্ড: ৩৭.১ ওভারে ১৯১/৭।

দু'ম্যাচেই প্রথমে ব্যাট করা দলের রান ১৯০। জয়ী দলের রানও এক, অমিল শুধু উইকেটে–৫ আর ৭। সেটিও মিলে যেতে পারত। ৫ উইকেটে ১৮২ রান করে ফেলার পর ব্যাপারটা বেশি কাকতালীয় হয়ে যাচ্ছে ভেবেই কি না, ওই স্কোরেই আউট হয়ে যান ইংল্যান্ডের দুই ব্যাটসম্যান মাইক ডেনেস ও কিথ ফ্লেচার!

★★★

ওভালে পাকিস্তানের টেস্ট ছেড়ে দেওয়া নিয়ে এত হইচই, ওয়ানডে ছেড়ে দেওয়া নিয়ে কিন্তু তা হয়নি। খেলতে অস্বীকৃতি জানিয়ে টেস্ট ম্যাচে হারার ঘটনা ওভালেই প্রথম, তবে ওয়ানডেতে তা ঘটেছে ১৮ বছর আগে। হঠাৎ করে এই প্রসঙ্গ টেনে আনার কারণ, এটি ঘটেছিল আজকের এই দিনেই অর্থাৎ ৩ নভেম্বরে। সালটা ১৯৭৮। ১৭ বছর বিরতির পর শুরু হওয়া ভারত-পাকিস্তান সিরিজে কালো দাগ হয়ে আছে এই দিনটি। ওভালে পাকিস্তানের না খেলাটা যেমন একটা প্রতিবাদ, শাহিওয়ালে ভারতের না খেলাটাও ছিল তা-ই। সিরিজ-নির্ধারণী তৃতীয় ওয়ানডেতে ভারতের জয়ের জন্য যখন ১৪ বলে ২৩ রান প্রয়োজন, হাতে ৮ উইকেট, তখনই অপরাজিত দুই ব্যাটসম্যান অংশুমান গায়কোয়াড় ও গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথকে ড্রেসিংরুমে ডেকে নেন ভারতীয় অধিনায়ক বিষেন সিং বেদি। কারণ ৩ ওভারে ভারতের ২৩ রান প্রয়োজন--এ অবস্থায় বোলিং করতে এসে টানা চারটি বাউন্সার করেছেন সরফরাজ নেওয়াজ। এর একটিও ব্যাটসম্যানের নাগালের মধ্যে না থাকার পরও আম্পায়ার ওয়াইড ডাকেননি। এর প্রতিবাদেই ম্যাচ ছেড়ে দেন বেদি, পাকিস্তান ২-১ ম্যাচে সিরিজও জিতে যায় তাতেই।

ওভালের সেই `ছেড়ে আসা` টেস্টে। ছবি: গেটি ইমেজেস

এই ওয়ানডের আগেই একটি টেস্টেও নিজস্ব ধরনে প্রতিপক্ষের 'অনৈতিক' কাজের প্রতিবাদ করেছিলেন বেদি। ১৯৭৬ সালে কিংস্টন টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্ট বোলারদের যথেচ্ছ বাউন্সারে গুরুতর আহত হন অংশুমান গায়কোয়াড় ও ব্রিজেশ প্যাটেল। বাকি ব্যাটসম্যানদেরও শরীরে চিহ্ন রেখে যায় ওই 'বাউন্সার বৃষ্টি'। এর প্রতিবাদে হাতে ৪ উইকেট রেখেই বেদি ইনিংস ডিক্লেয়ার করে দেন। ভারতের দ্বিতীয় ইনিংসে এই দু'জন ছাড়া আরও তিনজন ব্যাট করতে নামতেই পারেননি। স্কোরবোর্ডে তাঁদের নামের পাশে লেখা হয় অ্যাবসেন্ট 'হার্ট'।

★★★

এগুলো এমনই আক্ষেপের গল্প যে, এর কোনো সান্ত্বনা হয় না। ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আগে যত যা-ই করুন, বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ এবং প্রথম টেস্টে তো আর খেলার উপায় নেই। কারণ যত দূর জানি, জাভেদ ওমরের কাছে 'টাইম মেশিন' নেই।

হঠাৎ জাভেদ ওমরকে নিয়ে পড়ার কারণ হলো, ক্রিকইনফো ওয়েবসাইটে 'আস্ক স্টিভেন’ কলামটি (যেখানে ক্রিকেট সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেওয়া হয়) পড়তে গিয়ে দেখলাম, ক্রিকেটের একটি রেকর্ড জাভেদ ওমরে এসে থেমে আছে। অলআউট ইনিংসের আদ্যন্ত ব্যাটিং করে অপরাজিত থাকার রেকর্ড।

টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই আদ্যন্ত ব্যাটিংয়ের রেকর্ড আছে জাভেদের।

ওয়ানডেতে ইনিংসের জন্য নির্ধারিত ওভার শেষে ওপেনারের অপরাজিত থাকার ঘটনা আকছারই ঘটে। তবে অলআউট হয়ে যাওয়া ইনিংসে মাত্র আটজনের আছে এই কৃতিত্ব। অষ্টমজন জাভেদ ওমর।

২০০১ সালে হারারেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজের দ্বিতীয় ম্যাচে ৩০.৪ ওভারে মাত্র ১০৩ রানে অলআউট হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ, জাভেদ অপরাজিত ছিলেন ৩৩ রানে। এরপর আর কারও এই কৃতিত্ব নেই। আগে যে সাতজনের ছিল, তাঁরা হলেন: গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, সাঈদ আনোয়ার, নিক নাইট, ডেমিয়েন মার্টিন, রিডলি জ্যাকবস, হার্শেল গিবস ও অ্যালেক স্টুয়ার্ট।

এই আটজনের মধ্যে জাভেদ ওমর ছাড়া টেস্ট ও ওয়ানডে দুটিতেই অলআউট ইনিংসে আদ্যন্ত ব্যাট করার 'ডাবল' আছে শুধু গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ারের। তবে জাভেদের কীর্তির সঙ্গে ফ্লাওয়ারদের ছোট ভাইয়েরও তুলনা চলে না। জাভেদের ব্যাট ক্যারি করার কৃতিত্বটি যে ছিল টেস্ট অভিষেকেই (২০০০ সালের ওই জিম্বাবুয়ে সফরেই বুলাওয়েতে)। টেস্ট ইতিহাসে আর মাত্র দুজনই করতে পেরেছেন তা। সে দুটি সত্যিকার অর্থেই 'অনেক অনেক দিন আগের কথা'। ১৮৯০ সালে জে ই বার্নেট, ১৮৯৮-৯৯-এ পেলহাম ওয়ার্নার—এই দুই ইংলিশ ব্যাটসম্যানের কীর্তির পর এক শ বছরেরও বেশি বিরতি দিয়ে জাভেদ ওমর।

‘কাকতালীয়' দিয়ে লেখা শুরু করেছিলাম। কাকতালীয়ভাবে শেষে এসেও দেখা মিলছে কাকতালীয় আরেকটি ঘটনার। ওয়ানডের মতো টেস্ট ক্রিকেটেও ব্যাট ক্যারি করার সর্বশেষ কৃতিত্বটি জাভেদ ওমরের।

(বছর পনের আগের পরিসংখ্যান এখনো সেখানেই আটকে থাকলে সেটাই হতো অবাক করার মতো। জাভেদ ওমরের পর টেস্ট ক্রিকেটে ব্যাট ক্যারি করার ঘটনা ঘটেছে ১৫ বার, ডিন এলগার একাই করেছেন তিনবার। ওয়ানডের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা চার, সর্বশেষ যে কীর্তি গড়েছেন দিমুথ করুনারত্নে। টেস্ট-ওয়ানডে দুই ফরম্যাটেই ব্যাট ক্যারি করার কীর্তিতে জাভেদ-গ্রান্ট ফ্লাওয়ারদের সঙ্গে যোগ হয়েছে টম ল্যাথাম আর করুনারত্নের নামও।)

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×