‘আমি ছিলাম বিনোদনের ফেরিওয়ালা’
উৎপল শুভ্র
২৭ জানুয়ারি ২০২১
শারজা, ডাবলিন, জোহানেসবার্গ, কিংস্টন—এসব ঠিক আছে। এসবের সঙ্গে কিনা যোগ হয়ে গেল রাউজানের গহিরা! বিপিএলে চিটাগং কিংসের বাণিজ্যিক দূত ব্রায়ান লারার পিছু ধাওয়া করে যেতে হয়েছিল ফ্র্যাঞ্চাইজির মালিকের গ্রামের বাড়িতে। বাইরে উৎসুক দর্শকের উঁকিঝুঁকির মধ্যে সেখানেই ক্যারিবিয়ান ক্রিকেটের বরপুত্রের দীর্ঘ এই একান্ত সাক্ষাৎকার।
প্রথম প্রকাশ: ৩১ জানুয়ারি ও ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, প্রথম আলো।
উৎপল শুভ্র: এত বছর ক্রিকেট খেলার পর, যে ক্রিকেট একরকম জীবনই হয়ে গিয়েছিল আপনার, সেটি ছেড়ে দেওয়ার পর কখনো শূন্যতার একটা অনুভূতি হয়নি?
ব্রায়ান লারা: নট রিয়েলি। আমি মনে করি, আমার ক্যারিয়ারটা পরিতৃপ্তির স্বাদই দিয়েছে আমাকে। ১৭ বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে খেলেছি। এরও আগে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর হয়ে খেলেছি; খেলেছি স্কুল ক্রিকেট, বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে। কম তো আর খেললাম না। অবসর নেওয়ার সময়ে আমার মনে হয়েছিল, সেটিই উপযুক্ত সময়। সিদ্ধান্তটা নেওয়ার অনেক কারণই ছিল। ছয় বছর পরে এসেও মনে করি, ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটাই নিয়েছি। জীবন এগিয়ে যাচ্ছে। এই ছয় বছরে অনেক কিছুই করেছি। এই যেমন আবার বাংলাদেশে এলাম চিটাগং কিংসের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হয়ে। আমি খুব সুখী। ক্রিকেট যে একেবারে খেলি না, তা নয়। মাঝে মাঝে চ্যারিটি ম্যাচ খেলার জন্য আবার প্যাড-ট্যাড পরি। সব মিলিয়ে আমি খুব ভালো আছি।
শুভ্র: ২০০৭ বিশ্বকাপে বারবাডোজে যে সংবাদ সম্মেলনে অবসরের ঘোষণা দিয়েছিলেন, সেটিতে আমি উপস্থিত ছিলাম। আপনার ঘোষণাটা এমন আকস্মিক ছিল যে, সাংবাদিকেরা সবাই হকচকিয়ে গিয়েছিল। আগেই ভেবে-টেবে ওই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিলেন, নাকি তা ছিল তাত্ক্ষণিক?
লারা: ওই বিশ্বকাপটা আমাদের পরিকল্পনামতো হয়নি। তবে সত্যি বলছি, ওই সময় আমার মনে হয়েছিল, দলটার নতুন একজন নেতা দরকার এবং তাঁর মাথার ওপর সাবেক অধিনায়ক বা বেশি সিনিয়র খেলোয়াড় না থাকাই ভালো। আমি মনে করি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভালোর জন্য ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্তটাই আমি নিয়েছিলাম।শুভ্র: গত বছর কলম্বোতে আইসিসি হল অব ফেমে অন্তভুর্ক্তির পর বক্তৃতা দেওয়ার সময় আপনার প্রয়াত বাবা প্রসঙ্গে খুব আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। আপনার জীবনে কি বাবার প্রভাবই সবচেয়ে বেশি?
লারা: অবশ্যই। ক্রিকেটার হিসেবে, মানুষ হিসেবে আমাকে আর কেউ এত প্রভাবিত করেনি। আমি ছিলাম বাবার শেষ সন্তান। আমাদের পরিবার ছিল অনেক বড়—১১ জন ভাইবোন। সবার ছোট হলে যা হয়, আমার সঙ্গে উনি প্রচুর সময় কাটাতেন। অন্য ভাইবোনেরা হয়তো এ জন্য আমাকে ঈর্ষাও করত। আমাদের সম্পর্কটাও ছিল দারুণ। ক্রিকেটের ব্যাপারে সব সময়ই তাঁর সমর্থন পেয়েছি। হি ওয়াজ আ গ্রেট ম্যান। আমি জীবনে যা করেছি, এতে তাঁর অনেক বড় অবদান আছে। আমার বোন অ্যাগনিসেরও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। আমার এত উপরে উঠে আসায় আমার পরিবার, প্রয়াত জোয়ি ক্যারু (ওয়েস্ট ইন্ডিজ ব্যাটসম্যান), স্যার গারফিল্ড সোবার্স...এমন আরও অনেকের অবদান আছে। তবে বাবা তো বাবাই। তাঁর কোনো তুলনা হয় না।
শুভ্র: আপনার ব্যাটিংয়ের মধ্যে একটা মাদকতা ছিল। তা বোঝাতে মায়াবী বলব না জাদুকরি, বুঝতে পারছি না। আপনার ব্যাটিং অন্যরা বিশ্লেষণ করেছে, আমরা অনেকে অনেক লেখা লিখেছি। কিন্তু আপনাকেই যদি কোনো নির্দিষ্ট কিছুর কথা বলতে বলি, যা ব্রায়ান লারাকে সবার চেয়ে আলাদা করে দিয়েছিল?
লারা: আলাদা কি না জানি না। এটা বলতে পারি, আমি রান করতে ভালোবাসতাম। সব সময়ই আমি রান করার সুযোগ খুঁজতাম। মনমানসিকতায় ও খেলায় আমি ছিলাম খুব আক্রমণাত্মক। রান ছিল আমার আত্মবিশ্বাসের জ্বালানি। আরেকটা ব্যাপার ছিল, কোনো মাইলফলক ছুঁলে আমি সেটিকেই যথেষ্ট মনে করতাম না। ব্যাটিং করতে আমি খুব ভালোবাসতাম। সেই স্কুল ক্রিকেটে খেলার সময় থেকেই আমি ছিলাম দলের মূল ব্যাটসম্যান। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ঢোকার পর তা হতে তিন-চার বছর লেগেছে। ডেসমন্ড হেইন্স, রিচি রিচার্ডসনরা অবসর নেওয়ার পর সেই দায়িত্বটা আমার ওপর পড়ল। আমি এই চাপটা খুব উপভোগ করতাম। চাপ যেহেতু বললাম, আমি সেটি ভালোভাবেই সামলেছি।
শুভ্র: ১৯৯৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের তখনকার প্রধান নির্বাচক ডেভিড হলফোর্ড আমাকে বলেছিলেন, আপনার মতো বল গ্যাপে মারতে তিনি আর কাউকে দেখেননি। আগের প্রশ্নটা মাথায় এল এ কারণেই...
লারা: হ্যাঁ, এটা আমি খুব ভালো পারতাম। খুব কম বয়স থেকেই আমি যখন ব্যাট করতাম, আশপাশে হয়তো ফুলের টব থাকত, গাছ থাকত—আমি ওসবের মধ্য দিয়ে মারতে পারতাম। আমি জানি না, সেটিই পরে কাজে লেগেছে কি না। তবে এটা বলতে পারি, আমি সব সময়ই দ্রুত রান করতে পছন্দ করতাম। বোলিং দলকে চাপে ফেলতে চাইতাম। এটাই ছিল আমার শক্তির দিক। ঠুকঠুক করে রান করাটা আমার কখনোই পছন্দ ছিল না। আমি চাপটা বোলারদের ওপর ফিরিয়ে দিতে চাইতাম। আসলে এক কথায় বলতে গেলে, ব্যাটিং জিনিসটাই আমার খুব প্রিয় ছিল।
শুভ্র: ফিল্ড প্লেসিং দেখার পর সেটি কি আপনার মনে আঁকা হয়ে যেত?
লারা: কিছুটা তো বটেই। কোন ফিল্ডার কোথায় আছে, কোথায় মারলে রান হবে না, পাঁচ বা দশ গজ ডানে বা বাঁয়ে মারলে রান পাওয়া যাবে—এমন একটা ছবি তো মনে আঁকা থাকতই। মাথার সামনে শুধু দুটি চোখ নিয়ে তো আর পুরো মাঠটা দেখা যায় না। তবে মাঠে কে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে, এমন একটা ছবি তো স্মৃতিতে থাকতই।
শুভ্র: শুধু স্যার গ্যারি সোবার্সের রেকর্ড ভেঙেছেন বলেই নয়; দুজনই বাঁহাতি, দুজনেরই উঁচু ব্যাক লিফট, দুজনই ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান—সব মিলিয়ে অনেকেই আপনাদের মধ্যে সাদৃশ্য খুঁজে পান। আপনি কি কখনো স্যার গ্যারিকে ব্যাটিং করতে দেখেছেন?
লারা: না, স্যার গ্যারির সঙ্গে যখন প্রথম দেখা হয়, তখন আমার বয়স ১৪। বারবাডোজে স্যার গারফিল্ড সোবার্স টুর্নামেন্টে খেলতে গিয়ে। স্যার গ্যারি প্রথম দেখেই আমার ব্যাটিং খুব পছন্দ করে ফেললেন। এর পর থেকেই উনি সুযোগ পেলেই আমার কথা উল্লেখ করতেন। এটা আমার জন্য খুব অনুপ্রেরণাদায়ী ছিল। তবে আমার সত্যিকার ব্যাটিং রোল মডেলের কথা যদি বলি, সেটি ছিলেন রয় ফ্রেডেরিকস। সত্তরের দশকে উনি ওয়েস্ট ইন্ডিজের পক্ষে ওপেন করতেন। আমিও তখন ওপেন করি। ফ্রেডেরিকসকে দেখে আমিও ব্যাটিংয়ের সময় কবজির কাছে বোতাম লাগানো লম্বা হাতা জামা পরতাম। আমি যদি কারও ব্যাটিং অনুকরণ করার চেষ্টা করে থাকি, সেটি হলেন রয় ফ্রেডেরিকস।
শুভ্র: ১৯৯৫ সালে শারজায় আমার নেওয়া আপনার প্রথম সাক্ষাৎকারেও আপনি এ কথা বলেছিলেন। তবে একই সঙ্গে বলেছিলেন, গর্ডন গ্রিনিজের টেকনিক, ডেসমন্ড হেইন্সের টেম্পারামেন্ট ও ধৈর্য, ভিভ রিচার্ডসের দাপট আপনার কেমন মন কেড়েছিল। আপনি কি মনে করেন, নিজের ব্যাটিংয়ে এই সবকিছুর সম্মিলন করতে পেরেছিলেন?
লারা: ওই কথাটা কেন বলেছিলাম, সেটি আগে ব্যাখ্যা করি। আমার প্রথম হিরো ছিলেন রয় ফ্রেডেরিকস। তাঁকে ব্যাটিং করতে দেখার পর যেটা হলো, আমিও তাঁর মতো বাঁহাতি, নিজেও ওপেনিং ব্যাটসম্যান, তাই...। তবে বয়স একটু বাড়ার পর যা হয়, আপনি একেক ব্যাটসম্যানের একেক ধরনটা বুঝতে শিখবেন। গর্ডন গ্রিনিজকে ওপেনিং করতে দেখা মানে ছিল দারুণ অভিজ্ঞতা। শিয়ার ক্লাস, সঙ্গে দুর্দান্ত টেকনিক। ডেসমন্ড হেইন্স ছিলেন সত্যিকার এক ফাইটার। দেখতে হয়তো গর্ডন গ্রিনিজের মতো রোমাঞ্চক ছিলেন না, তবে রান কিন্তু কম করেননি। উনি সারা দিন ব্যাট করতেন, কখনোই এমন মনে হতো না যে, সবকিছু তাঁর নিয়ন্ত্রণে আছে। অথচ দিন শেষে দেখা যেত, উনি তখনো আছেন। আর ভিভ রিচার্ডস তাঁর দিনে ছিলেন রীতিমতো বিধ্বংসী। এই যে একেক জনের একেকটা শক্তির জায়গা, সেগুলোকে একখানে করতে কে না চাইবে! আমার মনে হয়, টেলিভিশনে ওদের খেলা দেখে, পোর্ট অব স্পেনে গিয়ে খেলা দেখে, পরে খুব তরুণ বয়সে দলের অংশ হয়ে...আমি যা হয়েছি, সেটি তাঁরাই তৈরি করে দিয়েছেন। আমি সবার কাছ থেকেই কিছু না কিছু নিয়েছি।
শুভ্র: ভিভ রিচার্ডস কি আপনার দেখা সবচেয়ে বিধ্বংসী ব্যাটসম্যান?
লারা: অবশ্যই উনি আমার দেখা সেরা ব্যাটসম্যান। টেন্ডুলকারকেও আমি ওখানেই রাখব। এই দুজনের মধ্যে একজনকে বেছে নেওয়া কঠিন। কথাটা বলে ফেললাম। তবে আমি মনে করি, ভিন্ন যুগের ব্যাটসম্যানদের তুলনা করাটাই ঠিক নয়, বরং প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অসাধারণত্ব উপভোগ করা উচিত। এই দুজনই অসাধারণ। আমি যে এই দুজনকেই ব্যাট করতে দেখেছি, এটাকে বড় পাওয়া বলে মানি।
শুভ্র: টেন্ডুলকারের কথা তুলে ভালোই করলেন। এরপর এই প্রসঙ্গেই আসতাম। এখন যেমন ফুটবল বিশ্বে মেসি-রোনালদো, নব্বইয়ের দশকে ক্রিকেটে তেমনই বড় তর্ক ছিল—টেন্ডুলকার, না লারা? ৩৭৫ ও ৫০১ করে আপনি এগিয়েও গিয়েছিলেন, কিন্তু কেন যেন মনে হয়, পরে আপনি নিজেই এই রণে ভঙ্গ দেন। আসলেই কি তাই?
লারা: ১৯৯৫ সালের পরের বছর তিনেক সময়টা আমার জন্য ছিল খুব কঠিন। বিশ্বরেকর্ড করে ফেলার পর তা নিয়ে যা হয়েছে, সেটি ছিল বড় একটা চাপ। এটা সামলাতে আমার একটু সময় লেগেছে। আমার ক্রিকেটের তাতে ক্ষতিই হয়েছিল। তবে ১৯৯৮-১৯৯৯ এর দিকে আমি আগের রূপে ফিরে আসি। এর পর থেকে বয়স ধরে ফেলার আগ পর্যন্ত আমি অনেক সাফল্যই পেয়েছি।
আমার ক্যারিয়ারটা আসলে তিনটা পর্যায়ে ভাগ করা যায়। ১৯৯৫-এর আগে, ১৯৯৫-এর পরে এবং ১৯৯৮ থেকে শেষ পর্যন্ত। উত্থান-পতন হয়তো ছিল, তবে আমি কোনো কিছুর সঙ্গেই আমার ক্যারিয়ারটা বিনিময় করতে রাজি নই। আমি এটি উপভোগ করেছি। সামর্থ্যের সবটুকু উজাড় করে দিয়েছি। অনেক কিছু শিখেছিও। শুধু ক্রিকেটার হিসেবে নয়, মানুষ হিসেবেও। আমি পরিণত হয়েছি। আমার ক্যারিয়ার নিয়ে আমি খুব গর্বিত।
শুভ্র: ব্রায়ান লারাকে ব্রায়ান লারা বানিয়েছে ওই থ্রি সেভেনটি ফাইভ। ওটাই বদলে দিয়েছে আপনার জীবন। এত দিন পর, ১৯৯৪ সালের অ্যান্টিগার কথা ভাবলে কী মনে হয়?
ব্রায়ান লারা: মনে পড়ে পরের সময়টার কথা। এটা ছিল খুব কঠিন। সান্তা ক্রুজ নামে ছোট্ট একটা গ্রাম থেকে উঠে এসে আমি যখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ও বিশ্ব ক্রিকেটে নিজেকে ব্যাটসম্যান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছি, তখন হঠাৎ করেই সব বদলে গেল। পরিবর্তনটা এমন রাতারাতি হলো যে এটার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া ছিল খুব কঠিন। এর পর যা হয়েছে, সেটিকে বলতে পারেন ট্রায়াল অ্যান্ড এরর। ভুল করেছি, তা থেকে শিখেছি। আবার ভুল করেছি, শিখেছি। আমি এর জন্য একদমই প্রস্তুত ছিলাম না। তবে এখন আর এ নিয়ে আক্ষেপ করি না। এটাই আমার চরিত্র গড়ে দিয়েছে। ওই সবকিছু মিলিয়েই আমি এই আজকের আমি বা ১০ বছর আগের আমি। ভালো-খারাপ যত অভিজ্ঞতা হয়েছে, সবকিছুই আমার। এটা নিয়ে আমার কোনো আফসোস নেই।
শুভ্র: ৩৭৫ দিয়েই শুরু হয়েছিল আপনার স্বপ্নযাত্রা। কাউন্টিতে গিয়ে ৫০১ করলেন। সেঞ্চুরি করাটা যেন সকালে নাশতা করার মতো একটা অভ্যাস হয়ে গেল (আট ইনিংসে সাতটি সেঞ্চুরি করেছিলেন লারা)। আপনার কি মনে হয়, ওই সময়টাই ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারার সেরা সময়?
লারা: আমি তা মনে করি না। নতুন ফেনোমেনা হিসেবে তখন হয়তো অনেক হইচই হয়েছে। তবে আমার সেরা সময় ওটা নয়। অবশ্যই ওই ছয়টি মাস ছিল বিশেষ কিছু। তবে আমি বিশ্বাস করি, ১৯৯৯-এর শুরুতে ওয়েস্ট ইন্ডিজে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে সিরিজে বা এর পর শ্রীলঙ্কায় (২০০১) আমি আরও পরিণত ব্যাটিং করেছি। তত দিনে নিজের খেলাটা আরও ভালো বুঝেছি, ১৯৯৪-এর তুলনায় প্রতিপক্ষও কিন্তু তখন আমার খেলা নিয়ে অনেক বেশি ভালো জানত। ১৯৯৮ সালের শেষ দিকে বা বলতে পারেন ১৯৯৯ সালের শুরু থেকে ব্যাটসম্যান হিসেবে আমার মনে হতো, সবকিছু আমার নিয়ন্ত্রণে আছে। আমি যেকোনো পরিস্থিতি সামলাতে প্রস্তুত।
শুভ্র: লোকে ৩৭৫ বা ৪০০ নটআউটের কথা হয়তো বেশি বলে, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বারবাডোজে একা ম্যাচ জেতানো অপরাজিত ১৫৩, সিডনিতে ২৭৭—আপনার প্রথম সেঞ্চুরি, শ্রীলঙ্কায় মুরালিকে পাড়ার বোলারের পর্যায়ে নামিয়ে এনে এক টেস্টের দুই ইনিংসে ডাবল সেঞ্চুরি ও সেঞ্চুরি...এমন অসাধারণ সব ইনিংস আছে আপনার। আপনার চোখে এর মধ্যে নাম্বার ওয়ান কোনটি?
লারা: আমি এমন রেটিং করতে পছন্দ করি না। তবে তার পরও বলছি। কারণ আপনি এত সব ইনিংসের কথা বললেন, অথচ বারবাডোজে ওই ১৫৩ নটআউটের এক সপ্তাহ আগে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষেই জ্যামাইকাতে ২১৩-এর কথা বললেন না। সবাই হয়তো ওই ইনিংসটিকে অন্য অনেক ইনিংসের চেয়ে ওপরে রাখবে না। তবে আমি রাখি। কারণ মাঠে ও মাঠের বাইরে যা হচ্ছিল, সেই ঝাপটাটা আমার গায়েই সবচেয়ে বেশি লাগছিল (দক্ষিণ আফ্রিকায় গোহারা হেরে আসার পর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম টেস্টে ৫১ রানে অলআউট হয়েছিল ব্রায়ান লারার ওয়েস্ট ইন্ডিজ)। এ কারণেই আমি মনে করি, ওই ইনিংসটা আমার জীবন ও আমার ক্রিকেটের জন্য একটা ডিফাইনিং মোমেন্ট। ওই ইনিংসটা এমন একটা আবেগময় অভিজ্ঞতা ছিল যে এখন তা ব্যাখ্যা করা কঠিন। আমার কাছে ওটা বিশেষ একটা ইনিংস হয়ে আছে। চিরদিন তা-ই থাকবে।
শুভ্র: স্টিভ ওয়াহ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছেন, সিরিজে আপনার এমন জ্বলে ওঠায় নাকি বড় ভূমিকা রেখেছিল জ্যামাইকাতে একটা ঝামেলা। আপনি নেটে ব্যাটিং করতে গিয়েছিলেন, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ানরা নেট ছাড়ছিল না। আপনি নাকি ভীষণ রেগে গিয়েছিলেন…
লারা: ও ঠিকই বলেছে। কথাটা ঠিক, তবে আমি ওই ঘটনার বিস্তারিততে যাচ্ছি না। স্টিভ ওয়াহর বইটাও আমি পড়িনি। তবে এটা ঠিক, ওই সকালে মানে জ্যামাইকা টেস্টের দ্বিতীয় দিন সকালে, ওই ঘটনা আমাকে খুব তাতিয়ে দিয়েছিল।
শুভ্র: নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে আপনার কি এমন কিছু লাগত? কথাটা কেন বলছি, মাইকেল আথারটন তাঁর আত্মজীবনীতে বলেছেন, তিনি তাঁর খেলোয়াড়দের বলে দিয়েছিলেন, আপনি ব্যাটিং করার সময় আপনাকে যেন কেউ কিছু না বলে...
লারা: না, এমন না যে নিজেকে উদ্দীপ্ত করতে আমার এমন কিছু লাগতই। তবে মাঠে যদি আমাকে চ্যালেঞ্জ করা হতো, সেটি শুধু বল দিয়ে নয়, মুখে কিছু বলেও, তাহলে আমি অমন কিছু করেই জবাব দিতাম। ওসব আমার ওপর নেতিবাচক প্রভাবের বদলে ইতিবাচক প্রভাবই ফেলত।
নিজেকে আমি বিনোদনের ফেরিওয়ালা হিসেবেই দেখেছি। আমার মনে হয়, ক্রীড়াবিদদের সবারই উচিত নিজেদের সেভাবেই দেখা। মানুষ এত কষ্ট করে টাকা খরচ করে মাঠে আসে বিনোদিত হতে, আপনাকে পারফর্ম করতে দেখতে।
শুভ্র: কোথাও পড়েছি, ম্যাথু হেইডেন আপনার রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে, এই খবরটা আপনি পেয়েছিলেন প্রায় শেষ রাতে। শোনার পর তাৎক্ষণিক অনুভূতিটা কী হয়েছিল?
লারা: সত্যি বলছি, আমি ভারমুক্তির আনন্দ পেয়েছিলাম। আপনাকে একটু আগেই তো বললাম, ৩৭৫ করার পর কিছুদিন খুব কঠিন যাওয়ার পরে চিন্তাভাবনায় আমি অনেক পরিণত হয়ে গিয়েছিলাম। বলতে পারেন, হেইডেন ওই রেকর্ড ভাঙার বছর চারেক আগে থেকে মানে ১৯৯৯ সাল থেকেই আমি সবকিছু নতুন চোখে দেখতে শুরু করেছিলাম। তত দিনে আমার কাছে খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে যে আমি কী করতে চাই, কী অর্জন করতে চাই। এসবের মধ্যে রেকর্ড কোনো বিবেচনাই ছিল না। বরং রেকর্ডটা করার পর কয়েক বছর এটা উল্টো একটা বোঝা হয়ে গিয়েছিল আমার জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমার জন্য দুর্ভাগ্য না (হাসি), বলছি ম্যাটি হেইডেনের দুর্ভাগ্যের কথা, ছয় মাস পর আবার ইংল্যান্ড সেই অ্যান্টিগায় এল। অ্যান্ড ইট হ্যাপেনড অ্যাগেইন।
শুভ্র: আপনি বিশ্ব রেকর্ড পুনরুদ্ধার করার পর আমি সেটিকে মোহাম্মদ আলীর হেভিওয়েট বক্সিং শিরোপা পুনরুদ্ধারের সঙ্গে তুলনা করেছিলাম। সবচেয়ে অবিশ্বাস্য দিক ছিল, সাধারণত যে বয়সে ব্যাটসম্যানরা বড় ইনিংস খেলতে পারেন, আপনি সেই বয়সটা পেরিয়ে গিয়েছিলেন (লারা তখন প্রায় ৩৫)। রেকর্ডটা ফিরে পাওয়ার জন্য কি আপনার মনে বাড়তি কোনো জেদ ছিল?
লারা: না, না...আমি তো বললামই, আমি বরং এতে ভারমুক্ত হয়েছিলাম। আমি যদি রেকর্ডটা আবার ফিরে পেতে চাইতাম, তা হলে কখনোই তা করতে পারতাম না। জীবনে আমি ব্যক্তিগত প্রেরণা থেকে যা যা করতে চেয়েছি, তার কোনো কিছুই করতে পারিনি।
শুভ্র: জীবনে যত অর্জন, তার মধ্যে সবচেয়ে বড় মনে করেন কোনটিকে?
লারা: আমার দুই মেয়ে (হাসি)। সুন্দর দুটি মেয়ে আছে আমার। হ্যাঁ, আমার খুব ভালো একটা ক্যারিয়ার ছিল। আরেকটা কথাও বলি, ক্যারিয়ারজুড়ে নিজেকে আমি বিনোদনের ফেরিওয়ালা হিসেবেই দেখেছি। আমার মনে হয়, ক্রীড়াবিদদের সবারই উচিত নিজেদের সেভাবেই দেখা। মানুষ এত কষ্ট করে টাকা খরচ করে মাঠে আসে বিনোদিত হতে, আপনাকে পারফর্ম করতে দেখতে। আমি আমার সামর্থ্যের সবটা দিয়ে তা করার চেষ্টা করেছি। তবে ক্রিকেটই তো সব নয়, ক্রিকেট মাঠের বাইরের জীবনে আমার দুটি মেয়ে আছে। ওই দুজন আমার কাছে স্পেশাল। ওরাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন।
শুভ্র: ক্রিকেট মাঠ থেকে একেবারে বেরিয়ে যাওয়ার আগে দর্শকদের কাছে আপনার শেষ প্রশ্ন ছিল, ‘ডিড আই এন্টারটেইন?’ আগে থেকেই কি ঠিক করে রেখেছিলেন যে এমন কিছু বলবেন?
লারা: না, ওই প্রশ্নটা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বেরিয়ে এসেছিল। মাঠ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার ওই মুহূর্তটাতে পুরো ক্যারিয়ার যেন চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। হঠাত্ মনে হলো, গত ১৭ বছর তুমি কী দিয়েছ? এটা করেছ, ওটা করেছ। কিন্তু আসলে তো খেলেছ মানুষকে খুশি করার জন্য। ক্রিকেট খেলা শুরুর দিনটি থেকে বাবার মুখে হাসি দেখাটা ছিল আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। স্কুল ক্রিকেট থেকে বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে যখন এগিয়ে যাচ্ছি, কী চাওয়া ছিল আমার? চাওয়া ছিল, বাবাকে খুশি করা, পরিবারকে খুশি করা। এটা করব, ওটা করব, এই রেকর্ড করতে হবে, ওই রেকর্ড...এমন কিছু নয়। আসলে তো ব্যাপারটা তোমার খেলা যারা ভালোবাসে, তাদের খুশি করা। ওই কথাটা তাই স্বতঃস্ফূর্তভাবেই মনে হয়েছিল, হৃদয়ের গভীর থেকেই উঠে এসেছিল প্রশ্নটা।
শুভ্র: এমন অনেক ব্যাটসম্যানের সঙ্গেই কথা হয়েছে, যাঁরা লারা হতে চাইতেন বা চান। আপনার কখনো কারও ব্যাটিং দেখে মনে হয়েছে, ইশ্, আমি যদি অমন ব্যাটিং করতে পারতাম!
লারা: না, না...অবশ্যই অনেকের আমার চেয়ে ভালো টেকনিক ছিল। নির্দিষ্ট কোনো বোলিং হয়তো কেউ আমার চেয়ে ভালো খেলেছে। তবে কাউকে দেখেই আমার মনে ঈর্ষা জাগেনি। মনে হয়নি, আহা, আমার কেন ওটা নেই। প্রকৃতিদত্ত যা ছিল আমার, সেটির জন্যই আমি কৃতজ্ঞতা মেনেছি। সেটি দিয়েই প্রকাশ করেছি নিজেকে। আমার কোনো আক্ষেপ নেই।
শুভ্র: ১৯৯৫ সালে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আপনাকে প্রশ্ন করেছিলাম, এমন তিনজনের নাম বলতে যাঁদের আপনি ডিনারে আমন্ত্রণ জানাতে চান। আপনি আর্নি এলস, মাইকেল জর্ডান ও মাইকেল জ্যাকসনের কথা বলেছিলেন। আর্নি এলসের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছে জানি, তাঁর সঙ্গে গলফও খেলেছেন অনেকবার। বাকি দুজনের সঙ্গে কি দেখা হয়েছে?
লারা: না, না, ওই দুজনের সঙ্গে দেখা হয়নি। তবে আমার মনে হয়, এত দিনে তালিকাটায় একটু পরিবর্তন হয়েছে। সেটিই তো স্বাভাবিক, তাই না?
শুভ্র: এখন তা হলে সেখানে কোন তিনটি নাম?
লারা: বারাক ওবামার সঙ্গে দেখা হওয়াটা ছিল খুব স্পেশাল। কয়েক মিনিটের জন্যই দেখা হয়েছিল। উনি মজা করে ব্যাটিং করেছিলেন। ভালোই লেগেছে। তবে ডিনারে আমন্ত্রণ জানাব কাকে, এটা যদি প্রশ্ন হয়, এখন হয়তো তা জানাব আমার মেয়েদের বয়ফ্রেন্ডদেরই (হাসি)। বড় মেয়েটা তো ষোলো হয়ে গেল! আসলে বিশ্বের নানা দেশে গিয়ে অনেক বিখ্যাত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়েছে, আমি তা খুব উপভোগও করেছি। আমার জীবনটা মন্দ না!
শুভ্র: নেলসন ম্যান্ডেলা ত্রিনিদাদে নেমে প্রথম প্রশ্নটাই নাকি করেছিলেন, ‘হোয়ার ইজ ব্রায়ান লারা?’
লারা: আমিও তা শুনেছি। তবে তখন আমি ওখানে ছিলাম না।
শুভ্র: পরে তো ম্যান্ডেলার সঙ্গে দেখা হয়েছে, তাই না?
লারা: হ্যাঁ, দেখা হয়েছে।
শুভ্র: একজন ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান হিসেবে নেলসন ম্যান্ডেলাকে কী চোখে দেখেন?
লারা: ওয়েস্ট ইন্ডিজে ম্যান্ডেলাকে সবাই খুব সম্মান করে। শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজ কেন, সারা বিশ্বই তো ওনাকে অন্য চোখে দেখে। গ্রেট ম্যান। সারা জীবন নীতি ও আদর্শের জন্য লড়ে গেছেন। উনি বোধ হয় এখন নব্বইয়ের ঘরে। আমার মনে হয়, উনি এমন একজন মানুষ, পুরো বিশ্বেই অনেক মানুষ যাঁকে আদর্শ মানে।
শুভ্র: ক্যারিয়ারে এত প্রাপ্তির মধ্যে কোনো আক্ষেপ কি নেই?
লারা: না, কোনো আক্ষেপ নেই। দারুণ একটা ক্যারিয়ার কেটেছে। এই বাংলাদেশে এসেও যে ভালোবাসা পাচ্ছি, তাতে আমি অভিভূত। এখনো আমি বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াই। আগেই বললাম, আমার দারুণ দুটি মেয়ে আছে। সব মিলিয়ে আমি খুব ভালো আছি। খুব ভালো।
লারার ৪০০ রানের ইনিংস নিয়ে পড়ুন: হারানো মুকুট ফিরে পেলেন রাজা