বিদায়বেলায় একটাই আক্ষেপ ছিল গ্রিনিজের

জন্মদিনে গ্রিনিজ-স্মৃতি-২

উৎপল শুভ্র

১ মে ২০২১

বিদায়বেলায় একটাই আক্ষেপ ছিল গ্রিনিজের

বিশ্বকাপ প্রস্তুতির সময় বিকেএসপিতে বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের সঙ্গে। ছবি: গেটি ইমেজেস

বাংলাদেশের ক্রিকেটে গ্রিনিজ-অধ্যায়ে আনন্দ-বেদনা-বিতর্ক সবই আছে। আইসিসি ট্রফি জয়ের পর সম্মানসূচক নাগরিকত্ব পাওয়া কোচকেই দুই বছরের মাথায় বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচের আগে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। নর্দাম্পটনে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই ম্যাচের আগে ওই ঘটনার পর গর্ডন গ্রিনিজকে আর খুঁজে পাইনি ইংল্যান্ডে। সানডে টাইমসে প্রকাশিত তাঁর সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে লিখেছিলাম এই লেখাটা।

প্রথম প্রকাশ: ২ জুন ১৯৯৯। প্রথম আলো।

গর্ডন গ্রিনিজ এখনও ইংল্যান্ডেই আছেন, জুনের শেষে ফিরে যাবেন তাঁর দেশ বারবাডোজে। এর আগে বারবাডোজ সরকারের পর্যটন বিভাগে কাজ করবেন যে কথা শোনা গিয়েছিল, এখন দেখা যাচ্ছে সেটি ঠিক নয়। সরকারি চাকরিই করবেন গ্রিনিজ, তবে সেটি কোচিং সংশ্লিষ্টই, স্কুল পর্যায়ে কোচিং করাবেন বাংলাদেশ সাবেক কোচ।

এমনিতেই ‌‘সাবেক’ হয়ে যেতেন তিনি বিশ্বকাপের পর, জুন পর্যন্ত চুক্তি ছিল, কিন্তু এর মধ্যে তো আর কোনো খেলাই নেই। তবে সে পর্যন্ত অপেক্ষা করেনি বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড। পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের আগের রাতে ‌‌‘বিশ্বকাপে আপনাকে আর প্রয়োজন নেই’ চিঠি ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। গ্রিনিজ বাংলাদেশের কোচ না হলে যাঁরা নিজেদের জন্য না হলেও তাঁদের ছেলেমেয়েদের জন্য তাঁর অটোগ্রাফ নিতে দৌড়াতেন, সেই বিসিবি কর্তাদের কেউ নিজে চিঠিটা দেয়ার সৌজন্যটুকুও দেখাননি। তা পাঠিয়ে দিয়েছেন তরুণ এক ক্লাব কর্মকর্তার হাত দিয়ে।

গর্ডন গ্রিনিজের বিষয়টি ভালো লাগার কথা নয়। ‌সানডে টাইমস পত্রিকাকে গ্রিনিজ জানিয়েছেন, বিদায় নেওয়ার ধরনটি নিয়ে কী করা যায়, তা নিয়ে আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছেন তিনি। বেশ কয়েক মাস আগেই দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন, অনেক সাধ্য-সাধনা করে বিশ্বকাপ পর্যন্ত থেকে যেতে রাজি করা হয় তাঁকে, এ কথা জানিয়ে গ্রিনিজ বলেছেন, ‌‘এটা মানহানিকর একটা ব্যাপার, কারণ যেভাবে এটি করা হয়েছে তাতে আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে মনে হওয়া স্বাভাবিক।’

বিসিবি তো আসলে এটাই করাতে চেয়েছে। নইলে পরদিন যাঁর দায়িত্ব এমনিতেই শেষ হয়ে যায়, তাঁকে আগের রাতে ওই চিঠি দেয়াটা একটা ‌‘শিক্ষা’ দেওয়ার চেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। বাংলাদেশের এখনই টেস্ট স্টাটাস পাওয়া ক্ষতিরই কারণ হবে, এই বিশ্বাস থেকে সরেননি গ্রিনিজ। কারণও দেখিয়েছেন, 'এখনও শীর্ষস্থানীয় কোনো টেস্ট প্লেয়িং দেশে খেলতে গেলে তাতে বাংলাদেশের ক্ষতিই হবে। বরং টেস্ট খেলুড়ে দেশগুলোর ‌‘এ’ দলের সঙ্গে নিয়মিত খেলা উচিত।উচিত কেনিয়া-স্কটল্যান্ড এ সব দেশে ট্যুর করা। আমি বাংলাদেশিদের আহত করেছি বলে বিরাট শোরগোল হয়েছে, কিন্তু আসলে আমি কী বলতে চেয়েছি, তা জানানোর মতো যোগাযোগটাই তো ছিল না ক্রিকেট এস্টাবলিশমেন্টের সঙ্গে।’

গ্রিনিজ চাইলে অনেক কথাই বলতে পারতেন, তবে নিজের দুঃখের কথা জানিয়েই থেমে গেছেন, ‌‘আমার দুঃখ, বাংলাদেশে যেভাবে কাজটা শেষ করতে চেয়েছিলাম, তা পারলাম না।’

পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচের দিন একদম অনাহূতভাবেই মাঠে এসেছেন গ্রিনিজ, সেদিনেরর কথাও বলেছেন তিনি, ‌‘পাকিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে আমার আসার কথা ছিল না, কারণ আগের রাতে আমাকে বলে দেওয়া হয়েছিল, আমাকে আর প্রয়োজন নেই। তারপরও আমি মাঠে গেছি।’ সেই যাওয়ার জন্য কম গঞ্জনা সইতে হয়নি তাঁকে। তিন বছর বাংলাদেশে কাটিয়ে টুকটাক বাংলা তো বোঝেনই। ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে যখন মাঠে ঢুকছিলেন, ম্যানেজার তানভীর মাজহার তান্নার মন্তব্যটি কি বুঝতে পেরেছিলেন তিনি? ‌‘কোনো লাজলজ্জা নেই, চিঠি দিয়ে দিয়েছি, তারপরও মাঠে এসেছে’-এ কথা বলে ম্যানেজার সাহেব গ্রিনিজকে যতটা নির্লজ্জ প্রমাণ করতে পেরেছেন, তার চেয়ে বেশি নামিয়ে এনেছেন নিজেকেই।

এমনই দুশ্চিন্তাতেই কেটেছিল গ্রিনিজের ১৯৯৯ বিশ্বকাপ, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে। ছবি: গেটি ইমেজেসতিন বছর যে দলের সঙ্গে তাঁর নাড়ির সম্পর্ক, তা ছিঁড়তে কষ্ট হচ্ছিল বলেই মাঠে এসেছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। অবাঞ্ছিতের মতো বসে রয়েছেন ড্রেসিংরুমের বাইরে। অনেক কটু-কাটব্যও ছুটে গেছে তাঁর দিকে। শেষ পর্যন্ত লাঞ্চের সময় নীরবে চলে গেছেন তিনি। অধিনায়ক বুলবুলকে মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন, ‌‘তোমাদের ভালো খেলতেই হবে।’ যেভাবে তাঁকে বিদায় নিতে হলো, কোনো খেলোয়াড়েরই তা পছন্দ হয়নি। ‌‘গর্ডনের দিকে তাকাতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল’-বলেছেন বুলবুল। সহ-অধিনায়ক সুজনের দুঃখ, ‌‘কোনো একটা জয় পেলে গর্ডন বাচ্চাদের মতো হয়ে যেত। এমন একটা জয়ের পর ও নেই, ওকে খুব ফিল করছি। খেলোয়াড়েরা সবাই তো ওকে সমান পছন্দ করত না, তারপরও জিজ্ঞেস করে দেখুন, ওকে এভাবে বিদায় দেয়ায় সবাই কষ্ট পেয়েছে।’

ড্রেসিংরুমে আর দলের বাসে কর্মকর্তাদের ভিড়, ম্যাচে যে ১২ জন খেলোয়াড় সুযোগ পায়, তাঁদের বাইরে আর কারও টাকা না পাওয়া-এসব নিয়ে ক্ষোভটা ছিল আসলে খেলোয়াড়দেরই। তাঁদের পক্ষ থেকে গর্ডন গ্রিনিজ টিম মিটিংয়ে তুলেছিলেন কথাগুলো। সেটাই কাল হয়েছে তাঁর। বোর্ডের শীর্ষস্থানীয় এক কর্তা উল্টো বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁর ড্রেসিংরুমে উপস্থিতি নিয়ে প্রশ্ন তুললে প্রশ্ন উত্থাপনকারীকেই সরে যেতে হবে। ঢাকায় গ্রিনিজবিরোধী মিছিলও নাকি হয়েছে এখানকার ইঙ্গিতেই। গর্ডন গ্রিনিজ এসব কিছুই বলেননি সানডে টাইমসকে। অভিযোগের সুরটাই নেই তাঁর কথায়।

বরং বাংলাদেশের তিন খেলোয়াড়ের নাম করেছেন, যাঁরা কাউন্টিতে সফল হতে পারে। ওপেনার মেহরাব হোসেন অপি আর দুই পেসার হাসিবুল হোসেন শান্ত ও সফিউদ্দিন আহমেদ বাবু। তবে কাউন্টিতে সাফল্যের জন্য একটু বয়স বেশি হয়ে গেছে তিনজনেরই, প্রকাশ পেয়েছে এই শঙ্কাও।

পাকিস্তানের বিপক্ষে অবিস্মরণীয় জয়ের আনন্দ তাঁর ভাগ্যে জুটল না। এটা নিয়ে দুঃখ নেই গ্রিনিজের। বাংলাদেশ জিতেছে, এতেই তিনি খুশি। তবে একদিন হয়তো পাকিস্তানের সঙ্গে টেস্ট খেলবে বাংলাদেশ, কিন্তু সেদিন তাঁকে তা দেখতে আমন্ত্রণ জানাবে না বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড...এই দুঃখটা গর্ডন কাথবার্ট গ্রিনিজকে ভালো পোড়ায়!

সংযোজন: লেখাটা শেষ হয়েছিল যে সম্ভাবনার কথা বলে, শেষ পর্যন্ত তা সত্যি হয়নি। বিসিবি ও গ্রিনিজের মধ্যকার বিরোধে দেড় বছরের প্রলেপ পড়ায় ২০০০ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের অভিষেক টেস্টে ঠিকই বিসিবির আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন গর্ডন গ্রিনিজ। এসেওছিলেন তিনি। সেই টেস্ট ম্যাচ যে পাকিস্তানের সঙ্গে হয়নি, হয়েছিল ভারতের সঙ্গে, তা তো আপনি জানেনই।

আরও পড়ুন: গ্রিনিজের হাত ধরে স্বপ্ন পূরণের একেবারে কাছাকাছি

                    আইসিসি ট্রফি জয়ের পর গর্ডন গ্রিনিজের একান্ত সাক্ষাৎকার

                    বারলোর প্রথম সংবাদ সম্মেলন এবং গ্রিনিজ-তিক্ততার স্মৃতি

                    আগের মতোই আছেন গর্ডন গ্রিনিজ

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×