বাংলাদেশের শ্রীলঙ্কা সফর ২০০৭

চতুর্থ দিন শুরু হতে না হতেই সব শেষ

উৎপল শুভ্র

২৯ এপ্রিল ২০২১

চতুর্থ দিন শুরু হতে না হতেই সব শেষ

আরেকটা উইকেট পড়ল! পাকা আমের মতো টুপটাপ ঝরে পড়েছিল বাংলাদেশের উইকেট। এসএসসি, কলম্বো, ২০০৭। ছবি: এএফপি

পাল্লেকেলেতে দ্বিতীয় টেস্টের তৃতীয় দিনে ৩৭ রানে শেষ ৭ উইকেট পড়েছে বাংলাদেশের। ১৪ বছর আগে কলম্বোর এসএসসিতে ২৭ রানে শেষ ৭ উইকেট হারিয়ে ইনিংসে হেরেছিল বাংলাদেশ। তখনকার বিবেচনায় ইনিংস পরাজয়টা বিস্ময়কর কিছু ছিল না, বিস্ময়কর ছিল চতুর্থ দিন সকালে আধঘণ্টার মধ্যে মাত্র ২৮ বলে শেষ ৫ উইকেট পড়ে যাওয়া। এক সময় যে বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ২২৭, সেই বাংলাদেশই ২৫৪ রানেই অলআউট! পুরস্কার বিতরণী হয়েছিল প্রায় বিরাণ মাঠে।

প্রথম প্রকাশ: ২৯ জুন ২০০৭। প্রথম আলো।

বাংলাদেশ: ৮৯ ও ২৫৪। শ্রীলঙ্কা ১ম ইনিংস: ৫৭৭/৬ (ডিক্লে.)। ফল: শ্রীলঙ্কা ১ ইনিংস ও ২৩৪ রানে জয়ী

টেলিভিশন ভুল বুঝিয়ে থাকতে পারে। সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাবের একমাত্র যে অংশটায় কিছু দর্শক ছিল, টেন স্পোর্টসের ক্যামেরাম্যান বারবার শুধু সেই জায়গাটাই ক্যামেরায় ধরেছে, যা থেকে টেলিভিশন দর্শকদের মনে হতেই পারে, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টেস্ট দেখতে বুঝি দর্শকে উপচে পড়ছে গ্যালারি। আসল ঘটনা হলো, টেস্টের প্রথম তিন দিন তিন-চার শ দর্শকও মাঠে এসেছেন কি না সন্দেহ।

কাল টেস্টের পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হলো প্রায় বিরান স্টেডিয়ামে। দর্শকদের কেউ একটু দেরি করে মাঠে এসে থাকলে হয়তো অবাক হয়ে ভেবেছেন, বৃষ্টি-টৃষ্টি নেই, ঝকঝক করছে রোদ, খেলা হচ্ছে না কেন!

দুপুর ১২টার দিকে বাংলাদেশ থেকে ফোন এল। ওই প্রশ্ন নিয়েই—কী ব্যাপার, খেলা হচ্ছে না কেন? সকালে উঠে টেলিভিশন ছাড়তে একটু দেরি হয়েছে, টেন স্পোর্টসে তখন কলম্বো টেস্টের হাইলাইটস দেখাচ্ছে। বৃষ্টি-টৃষ্টি নাকি!

টেস্ট শুরু হওয়ার আগের কয়েক দিন কলম্বোর আকাশ প্রায় নিয়মিত কান্নাকাটি করলেও টেস্ট শুরু হওয়ার পর একেবারে সুবোধ বালক হয়ে গেছে। এক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়েনি প্রথম তিন দিন, কালও নয়। তারপরও বেলা ১১টার সময়ই সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব মাঠশূন্য পড়ে থাকার কারণ, বাংলাদেশের শেষ ৫ উইকেটের পাকা আমের মতো টুপটাপ ঝরে পড়া। সময়ের হিসেবে আধঘণ্টা তাও অনেক শোনাচ্ছে! বাংলাদেশের ইনিংস শেষ করে দিতে শ্রীলঙ্কান বোলারদের লেগেছে মাত্র ২৮ বল!

লাসিথ মালিঙ্গার ইয়র্কার আর মুরালিধরনের অফ ব্রেক-দুসরায় চোখে অন্ধকার দেখে মাত্র ২১ রান যোগ করতেই শেষ বাংলাদেশের শেষ ৫ উইকেট। গত পরশু বিকেলে একটা সময় বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৩ উইকেটে ২২৭, এটা মনে থাকলে আপনি হয়তো এতক্ষণে হিসেব করে ফেলেছেন, মাত্র ২৭ রানে পড়েছে বাংলাদেশের শেষ ৭ উইকেট!

হাতে ৫ উইকেট নিয়ে চতুর্থ দিন শুরু করেছিল বাংলাদেশ। মাত্র আধঘণ্টায় ২৮ বলের মধ্যেই সেই ৫ উইকেট তুলে নিয়েছিল শ্রীলঙ্কা। ছবি: এএফপি

আশ্চর্যবোধক চিহ্ন একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কী করা, বাংলাদেশের ক্রিকেট যে প্রতিনিয়তই আশ্চর্য করার ব্রত নিয়েছে। প্রশ্ন হতে পারে একটাই। প্রথম ইনিংসে ৮৯ রানে অলআউট হওয়ার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ২৭ রানে শেষ ৭ উইকেট হারানোর পাশে আশ্চর্যবোধক চিহ্ন দেবেন, না কি গত পরশু দ্বিতীয় ইনিংসের ৭৮.৪ ওভার শেষে ৩ উইকেটে ২২৭ দেখানো স্কোরবোর্ডের পাশে?

মোহাম্মদ আশরাফুল গত পরশু জানতে চাইছিলেন, এর আগে শ্রীলঙ্কার মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে বাংলাদেশের কয়টি টেস্ট চতুর্থ দিনের মুখ দেখেছে? একবারই। ২০০২ সালে এই মাঠেই বাংলাদেশের টেস্ট চতুর্থ দিনে গিয়েছিল। এর একটা বড় কারণ ছিল অরবিন্দ ডি সিলভা, মুত্তিয়া মুরালিধরন, সনাৎ জয়াসুরিয়াদের বিশ্রাম দিয়ে শ্রীলঙ্কার প্রায় ‘এ’ দল নামিয়ে দেওয়া। এবার শ্রীলঙ্কার পুরো শক্তির দলের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কায় খেলা ছয় টেস্টে মাত্র দ্বিতীয়বারের মতো চতুর্থ দিনে খেলা নিয়ে যেতে পারায় খুশি হতে চাইলে হতে পারেন। শুধু মনে করিয়ে দিই, মাঝখানে পাঁচ বছর গেছে, বাংলাদেশ টেস্ট খেলতে শুরু করার পর সাড়ে ছয় বছরেরও বেশি। টেস্ট ক্রিকেটের বাংলাদেশ এখনো চতুর্থ দিন আর পঞ্চম দিনের চক্করেই ঘুরে বেড়াচ্ছে।

৫ উইকেটে ২৩৩ রানে তৃতীয় দিন শেষ করার পর চতুর্থ দিনের চা-বিরতি পর্যন্ত শ্রীলঙ্কাকে মাঠে রাখার স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ। আশরাফুল অবশ্য এটাও বলে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশ চার ঘণ্টা ব্যাট করতে পারে, আবার এক ঘণ্টায় শেষ হয়ে গেলেও তিনি অবাক হবেন না। অবাক একটু হলেন। ৪.৪ ওভারের মধ্যে ৫ উইকেট পড়ে যাবে—এটা যে তাঁরও ধারণার বাইরে ছিল।

গত পরশু বাংলাদেশের প্রতিরোধ দেখার পর মাহেলা জয়াবর্ধনেরও একটু অবাক হওয়ার কথা। তবে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক তাঁর দলের বোলারদের কৃতিত্বকেই বড় করে দেখাতে চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। ‘বাংলাদেশের ড্রেসিংরুমে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে, আমি তা বলতে পারব না। তবে এটুকু বলতে পারি, আমরা জয় পেতে ক্ষুধার্ত হয়ে ছিলাম’—ম্যাচ-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে বললেন তিনি।

শ্রীলঙ্কার জয় পাওয়া নিয়ে তো কখনোই সংশয় ছিল না। তারপরও জয়াবর্ধনে ওই ক্ষুধার কথা বললেন, কারণ এই সিরিজটি শ্রীলঙ্কার কাছে শুধুই জয় পেয়েই সন্তুষ্ট থাকার নয়। সিরিজ শুরুর আগেই বলে দিয়েছিলেন, ‘আমরা খেলোয়াড় হিসেবে কে কতটা ভালো, সেটিকে চ্যালেঞ্জ করতে চাই।’ এ কারণেই ১ ইনিংস ও ২৩৪ রানে জেতার পরও ফিল্ডিংয়ে ক্যাচ পড়েছে বলে অসন্তুষ্টির কথা শোনা গেল তাঁর মুখে।

আবারও বাংলাদেশের হন্তারক সেই মুরালিই, দুই ইনিংস মিলিয়ে নিয়েছিলেন ৯ উইকেট। ছবি: এএফপি

ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়েছেন মুরালিধরন—এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশের বিপক্ষে তাঁর মুড়িমুড়কির মতো উইকেট পাওয়াটা নিয়মই হয়ে গেছে। ৭ টেস্টে ৫৯ উইকেট তারই প্রমাণ। আশরাফুল অবশ্য এবার এর মধ্যেও একটু ব্যতিক্রম দেখছেন। আরেকটি আঁধারময় টেস্ট ম্যাচে বাংলাদেশের জন্য আলোর রেখাটিও সেখানেই খুঁজতে চাইলেন তিনি, ‘মুরালি ৯ উইকেট নিয়েছে। এটা ও সব দলের বিপক্ষেই নেয়। তবে কাল (বুধবার) আমরা মুরালিকে খুব ভালো খেলেছি। ৩৪ ওভার বোলিং করে ২ উইকেটের বেশি নিতে পারেনি ও।’

শেষ পর্যন্ত ম্যান অব দ্য ম্যাচ অবশ্য সেই মুরালিই। বাংলাদেশের বিপক্ষে সাত টেস্টে চতুর্থবার। সব মিলিয়ে ১৭ বার। টেস্ট ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশিবার ম্যান অব দ্য ম্যাচ হওয়ার রেকর্ডটিও এখন তাঁর। অংশীদার অবশ্য আরও তিনজন—ওয়াসিম আকরাম, জ্যাক ক্যালিস ও শেন ওয়ার্ন। আরও দুটি টেস্ট বাকি, এই সিরিজেই মুরালিধরন রেকর্ডটিকে শুধুই নিজের করে না নিতে পারলে সেটিই হবে বিস্ময়।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×