২০০৭ বিশ্বকাপ ক্রিকেট

‘রানার জন্য’ খেলবে বাংলাদেশ

উৎপল শুভ্র

২৮ এপ্রিল ২০২১

‘রানার জন্য’ খেলবে বাংলাদেশ

রানার ম্যাচে রানা-স্মরণ। পোর্ট অব স্পেনে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচের আগে পালন করা হয় এক মিনিটের নীরবতা। ছবি: গেটি ইমেজেস

বিশ্বকাপে পরদিন ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রথম ম্যাচ। সকাল-সকাল ভোরে পোর্ট অব স্পেনের হিলটন হোটেলে বাংলাদেশ দলের কাছে পৌঁছাল সেই ভয়াবহ দুঃসংবাদ। সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছেন মানজারুল ইসলাম রানা। বাংলাদেশের ওই দলের সবারই যাঁর সঙ্গে অসংখ্য স্মৃতি। শোকাচ্ছন্ন বাংলাদেশ দল মনে মনে তখনই প্রতিজ্ঞা করেছিল, পরদিনের ম্যাচটা তারা রানার জন্যই খেলবে। খেলেওছিল।

মাঝখানে আরও ২৪ ঘণ্টা। আবার হয়তো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের ভাবনায় ফিরে আসবেন টেন্ডুলকার-সৌরভ-জহির খানরা। ফিরে আসবে বিশ্বকাপের রোমাঞ্চ, উত্তেজনা, টেনশন। আসতেই হবে। পেশাদারদের যে সবকিছু ভুলে নিজের কাজটা করতে হয়। বাংলাদেশ দলও তা-ই করবে। মাঠে নামবে বিনা যুদ্ধে ভারতকে সূচ্যগ্র মেদিনীও না দেওয়ার প্রতিজ্ঞায় আবারও শাণিত হয়ে।

তবে ম্যাচ শুরুর ২৪ ঘণ্টা আগে যখন এই প্রিভিউ লিখছি, বাংলাদেশ দলের কারোরই বিশ্বকাপ নিয়ে আলোচনা করার মতো অবস্থা নয়। টেন্ডুলকার-শেবাগরাও মন থেকে উধাও। সেখানে শুধুই হাজারো স্মৃতির কোলাজ। সেখানে শুধুই মানজারুল ইসলাম রানা।

ঘুম থেকে উঠেই পেয়েছেন এই মর্মান্তিক দুঃসংবাদ—রানা আর নেই! অনেকের ঘুম ভাঙিয়েছে মোবাইলে বয়ে আসা রানার মৃত্যুসংবাদ। রুমের দরজা খুলে আশরাফুল দেখেন, করিডরে বসে আছেন টিমমেটরা। অনেকে কাঁদছেন। ‘পুরো টিমটা এলোমেলো হয়ে গেছে। আমরা কেউ এটা মানতেই পারছি না’—বলার সময় আশরাফুলের চোখে ভাসছে সেই অনূর্ধ্ব-১৭ দল থেকে রানার সঙ্গে খেলার টুকরো টুকরো স্মৃতি। ‘ট্যুরে গেলে সারা দিনই ওর সঙ্গে মারামারি করতাম। দারুণ ছেলে ছিল।’

ছিল? হ্যাঁ, মানজারুল ইসলাম রানা এখন অতীত কাল। ছিল। ছিলেন। বেশ কিছুদিন ‘ছিলেন’টা ব্যবহত হতো শুধু বাংলাদেশ দলে থাকার প্রসঙ্গে—বাংলাদেশ দলে ছিলেন। মানজারুল ইসলাম রানার কোনো কিছুই এখন আর বর্তমান কাল নয়। সবই অতীত। সবই ‘ছিলেন’।

বাংলাদেশ দল থেকে প্রথম যেবার বাদ পড়লেন, এর কদিন পর হাবিবুল বাশার তাঁর বাড়িতে একটা পার্টি দিয়েছিলেন। মানজারুলও ছিলেন। বারবার বলছিলেন, ‘সুমন ভাই, দেখবেন আমি ঠিকই ফিরে আসব।’ বলতে বলতে হাবিবুল বাশারের কণ্ঠটা ধরে এল। মানজারুল ইসলামের আর ফেরার উপায় নেই। এমন এক জগতে চলে গেছেন, যেখান থেকে কেউ ফেরে না।

বাংলাদেশের এই দলের অনেকেরই বিশ্বকাপ অভিষেক হবে এ ম্যাচে। প্রথম ম্যাচেই সামনে পরাক্রান্ত ভারত। গত পরশু রাতে বাংলাদেশ দলের নবীনতম সদস্যকে দেখেও ‘বিশ্বকাপ অভিষেক’, ‘পরাক্রান্ত প্রতিপক্ষ’ কোনো কিছুই বোঝার উপায় ছিল না। বিশ্বকাপটা যেন উৎসবের মঞ্চ আর তাতে পা রাখতে অধীর বাংলাদেশ দল। ভারত, তাতে কী? ওদের কি আমরা হারাইনি?

২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর ইতিহাসেই একটু আলাদা হয়ে আছে। প্রলয়ঙ্করী সুনামি সেদিন তছনছ করে দিয়েছিল বিস্তীর্ণ জনপদ। উন্মত্ত সাগর হাজার হাজার মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আর না-ফেরার সেই জগতে, যেটি কাল মানজারুল ইসলাম রানারও স্থায়ী ঠিকানা হয়ে গেল।

ম্যাচের আগে ফিরে ফিরে আসছিল ২০০৪ সালের ভারত-বধের স্মৃতি। যেটির অংশ হয়ে ছিলেন মানজারুল ইসলাম রানাও। ছবি: গেটি ইমেজেস

২০০৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর দিনটি বাংলাদেশের ক্রিকেটেও আলাদা হয়ে আছে। সুনামির সেই দিনে ভূমিকম্প হয়ে বাংলাদেশ দল সাড়ে পাঁচ বছর পর আবারও নাড়িয়ে দিয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বকে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর সেদিনই প্রথম আবার ‘দৈত্য-বধ’। এবার ভারত। পরের ১৪ মাসের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া আর শ্রীলঙ্কা-বধের বীজটাও রোপিত হয়েছিল অবিস্মরণীয় সেই শততম ওয়ানডেতেই। সেই ম্যাচের খুঁটিনাটি এমনিতেই বাংলাদেশের সাংবাদিকদের মুখস্থ। গত দু-তিন দিন অসংখ্যবার স্মৃতিচারণা করতে করতে আরও বেশি জ্বলজ্বলে হয়ে উঠল সেসব। আফতাবের ৬৭, মাশরাফির অলরাউন্ড নৈপুণ্য, নর্দাম্পটনের পাকিস্তানের বিপক্ষে ওই ম্যাচের মতো এটিরও রান আউটে সমাপ্তি—বিশ্বকাপ কাভার করতে আসা বাংলাদেশের সাংবাদিকরা বারবার ফিরে গেলেন সেই দিনে। ফিরিয়ে নিয়ে গেলেন ভারতীয় সাংবাদিকেরা।

ভারতীয় সাংবাদিকেরা এমনিতে বাংলাদেশের ক্রিকেটের খুব একটা খোঁজখবর রাখেন না। বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচের প্রিভিউ লিখতে এত দিন তার প্রয়োজনও হয়নি। এবার পড়ছে। ভারতীয় দলের টিম মিটিংয়ে আফতাব-মাশরাফি-শাহরিয়ারদের ব্যাটিং-বোলিংয়ের চুলচেরা বিশ্লেষণ হচ্ছে বলে যে খবর পেয়েছেন। খবর পেয়েছেন, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে তামিম ইকবালের ব্যাটিংয়ের ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে না বলে কোচ গ্রেগ চ্যাপেলের কাছে ভারতের প্রস্তুতিটাকে অসম্পূর্ণ বলে মনে হচ্ছে! বাংলাদেশ এবার ভারতের কাছে আগের মতো ‘নামব, খেলব, জিতব’ ম্যাচ নয়।

শ্রীলঙ্কা-বারমুডা একপেশে ম্যাচের কমেন্ট্রি দিতে দিতে ভারতের সাবেক কোচ জন রাইট পরের ম্যাচটির জন্য অধীর অপেক্ষায় থাকার কথা জানিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচটা দারুণ হবে বলেই তাঁর ধারণা। শেষ পর্যন্ত মাঠে কী হয়, কে জানে! তবে বড় কোনো দলের সঙ্গে খেলার আগে এই সমীহটা বাংলাদেশ দলের জন্য একেবারেই নতুন।

ম্যাচের আগে সতীর্থদের মনোবল চাঙা রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল অধিনায়ক হাবিবুলের সামনে। ছবি: গেটি ইমেজেস

এটাও বোধ হয় নতুন যে, বড় দলের বিপক্ষে ব্যাটিংয়ের শুরুতে শুধু উইকেট না হারানোর মন্ত্রের সঙ্গে পাওয়ার প্লের ২০ ওভারে কমপক্ষে ১০০ রান তোলাটাও ঢুকে গেছে গেম প্ল্যানে। ‘পাওয়ার প্লের ২০ ওভারে ১০০ করতে হবে। কারণ বাকি ৩০ ওভারে ১৫০ রানের বেশি তোলা কঠিন। আর ভারতের যে ব্যাটিং লাইনআপ, তাতে প্রথমে ব্যাট করে ২৫০ রানের কম তুললে আমাদের চান্স নেই’—এই পরিকল্পনা সফল করতে তামিম ইকবালকে স্বভাবসুলভ আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করার লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছেন হাবিবুল বাশার। আফতাব আহমেদকে তা দেওয়ার দরকার নেই। তিনি একভাবেই ব্যাট করতে জানেন। শাহরিয়ার নাফীস ও তামিম ইকবাল ওপেনিং জুটির ব্যাপারে দেশ থেকেই মনস্থির করে এসেছে বাংলাদেশ দল। পুরো একাদশের ব্যাপারেই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল। সেটি নিয়ে অবশ্য একটু ভাবতে হচ্ছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজের উইকেট স্লো-লো হবে, ত্রিনিদাদের উইকেটে স্পিন ধরবেই—বিশ্বকাপ-পূর্ব এই ধারণা এরই মধ্যে ধাক্কা খাওয়ায় দ্বিতীয় স্পেশালিস্ট বাঁহাতি স্পিনার না তৃতীয় পেসার—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হচ্ছে। কাল সকালে টিম মিটিংয়ের পর তাই জাভেদ ওমর, রাজিন সালেহ ও শাহাদাত হোসেনকে বাইরে রেখে ঘোষিত হয়েছে ১২ জনের দল। যে দলে মোহাম্মদ রফিকের পাশে অবলিগ দিয়ে লেখা তাপস বৈশ্যর নাম। ম্যাচের আগে উইকেট দেখে তারপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

শোককে শক্তি বানানোর চেষ্টা করার সিদ্ধান্ত অবশ্য এরই মধ্যে চূড়ান্ত। প্রিয়জনের আকস্মিক অকালমৃত্যু বিশ্বকাপ তো বিশ্বকাপ, অসার মনে করায় এই জগৎসংসারকেই। কিন্তু যে গেছে, সে তো গেছেই। তাঁকে তো আর ফেরানোর উপায় নেই। তা মনে করিয়ে দিয়ে হাবিবুল দলকে বলেছেন, ‘এসো, আমরা রানার জন্য এই ম্যাচটা খেলি। রানার জন্য কিছু করি।’

এই ম্যাচে মানজারুল ইসলাম রানাও তাই থাকছেন। বাংলাদেশ দলের অদৃশ্য দ্বাদশ ব্যক্তি হয়ে।

 আরও পড়ুন: বিশ্ব কাঁপিয়ে বাংলাদেশের জয়

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×