অ্যান্ডি চলে যাওয়ায় খুশি হয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের তখনকার প্রধান নির্বাচক
জিম্বাবুয়ে দলকে নিজের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার!
উৎপল শুভ্র
২৮ এপ্রিল ২০২১
জিম্বাবুয়েতে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখতে বিশ্বকাপের ম্যাচে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার আর হেনরি ওলোঙ্গার কালো আর্মব্যান্ড পরে খেলতে নামাকে সাহসী প্রতিবাদ হিসেবেই দেখেছিলেন সবাই। কিন্তু, আলী শাহর কথা মানলে অ্যান্ডির এহেন কাজকর্ম অভিনয় মনে হতেই বাধ্য। উৎপল শুভ্রর সঙ্গে আলাপচারিতায় ফ্লাওয়ার ভাইদের বড়জনকে তো 'লোভী, অর্থগৃধ্নু, স্বজনপ্রীতি'সহ নানা অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন জিম্বাবুয়ের সেই সময়ের প্রধান নির্বাচক।
প্রথম প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০০৪। প্রথম আলো।
টেস্ট ক্রিকেটে আবির্ভাবের এক যুগ পরও জিম্বাবুয়ে যে বিশ্ব ক্রিকেটে সমীহজাগানো কোনো শক্তি হতে পারল না, হিথ স্ট্রিকের কাছে তার ব্যাখ্যা আছে। জিম্বাবুইয়ান অধিনায়কের সেই ব্যাখ্যা হলো, ‘এর একটাই কারণ। আমরা অনেক খেলোয়াড়কে হারিয়ে ফেলেছি। জিম্বাবুয়ের এই দলে মারে গুডউইন, নিল জনসন, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে যোগ করুন, অস্ট্রেলিয়াও আমাদের হালকাভাবে নেওয়ার সাহস পাবে না।’
গুডউইন-জনসন হঠাৎ করেই এসেছিলেন, হঠাৎ করেই চলে গেছেন। প্রথম জনের ক্রিকেটশিক্ষা অস্ট্রেলিয়ায়, দ্বিতীয় জনের দক্ষিণ আফ্রিকায়। ১৩ বছর বয়সে গুডউইনের পরিবার অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছিল, জনসন-পরিবার দক্ষিণ আফ্রিকায় যাওয়ার সময় নিলের বয়স ১০। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতেই জিম্বাবুয়েতে ফিরেছিলেন তাঁরা, কিন্তু এর চাইতে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা আর ইংল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে খেলাই আর্থিকভাবে বেশি লাভজনক মনে হওয়াতে খুব তাড়াতাড়িই মোহভঙ্গ ঘটেছে তাঁদের।
অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের ঘটনা তা নয়। তাঁর জন্ম হয়েছিল কেপটাউনে, তবে সেটি বাবা বিল ফ্লাওয়ারের কর্মসূত্রে ফ্লাওয়ার পরিবার তখন সেখানে ছিল বলে। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের শৈশবেই ফ্লাওয়ার পরিবার জিম্বাবুয়েতে ফেরে। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার আদ্যন্তই জিম্বাবুইয়ান, এ কারণেই তাঁকে হারানোর দুঃখটাও বেশি হওয়া স্বাভাবিক। হিথ স্ট্রিক যেমন সেদিন বললেন, ‘অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে যদি আমরা ফিরে পেতাম, অবশ্যই খুব ভালো হতো। কোন অধিনায়ক তাঁর দলে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারকে চাইবে না?’
এটা যদি একটা মত হয়, তাহলে অন্য মতও আছে। সেই মতটা এত জোরালো আর যিনি তা দিচ্ছেন, তিনি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, তা রীতিমতো এক চমক হয়েই এল। আলী শাহর স্থির বিশ্বাস, গত কিছুদিনে জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটে যদি ভালো কিছু ঘটে থাকে, তার একটি অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের দেশত্যাগ। আলী শাহর পরিচয়টা শুধুই সাবেক জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটার হলে এই কথাকে খুব বেশি গুরুত্ব না দিলেও চলত। কিন্তু ভদ্রলোক যে এখন জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটের প্রধান নির্বাচক।
অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার যে সাধারণ দলের অসাধারণ এক ব্যাটসম্যান ছিলেন, তা নিয়ে আলী শাহরও কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু তাঁর অভিযোগ, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার-অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল-ব্রায়ান স্ট্র্যাং মিলে জিম্বাবুইয়ান ক্রিকেটে এমন একটা চক্র তৈরি সৃষ্টি করেছিলেন যে, পারফর্ম না করলেও তাঁদের দলে রাখতেই হবে, এমন একটা চাপ সৃষ্টি হয়েছিল নির্বাচকদের ওপর। অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের দলে জায়গা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার প্রশ্নই ওঠে না, তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ কেউ বাদ পড়লেই নাকি হুমকি-ধমকি দিতেন তিনি। আলী শাহর দাবি, এঁদের কারণে ড্রেসিংরুমে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল যে, তরুণ খেলোয়াড়েরা সব সময় ভয়ে সিঁটিয়ে থাকত। অ্যান্ডির নেতৃত্বে এই তিনজন জিম্বাবুয়ে দলটাকে অনেকটা নিজেদের সম্পত্তি বলে ভাবতেন।
জিম্বাবুইয়ান দলে কালো খেলোয়াড়দের জন্য ‘কোটা’ পদ্ধতি আছে বলে যে অভিযোগ করেছিলেন অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, সেটিও মানলেন না আলী শাহ। তাঁর দাবি, ‘কোটা-ফোটা কিচ্ছু নেই। আমরা স্বাধীনভাবে শুধু যোগ্যতা অনুযায়ী দল নির্বাচন করি। আসল ঘটনা হলো, একসময় জিম্বাবুয়েতে ক্রিকেট ছিল শুধুই সাদাদের খেলা। কিন্তু কালো জনগোষ্ঠীর মধ্যে খেলাটি ছড়িয়ে দেওয়ার পর সেখান থেকেই বেশি প্রতিভা উঠে আসছে। স্বাভাবিকভাবেই দলেও ঢুকছে তারা। এটাই কেউ কেউ মেনে নিতে পারছে না।’
অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের বিরুদ্ধে আলী শাহর অভিযোগ এখানেই শেষ হচ্ছে না। অ্যান্ডি 'লোভী এবং অর্থগৃধ্নু' ছিলেন বলেও তার দাবি। দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে উদাহরণও দিলেন, ‘অ্যান্ডি হয়তো ইংল্যান্ডে খেলার অনুমতি চাইল, তখন কোনো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নেই বলে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ইউনিয়ন হয়তো সেই অনুমতি দিলও। কিন্তু দেখা গেল, সেখান থেকে ফিরে সে দাবি করে বসল, আমার অস্ট্রেলিয়া থেকে এত টাকায় খেলার অফার আছে। এখানে তা না পেলে আমি জিম্বাবুয়ের পক্ষে না খেলে অস্ট্রেলিয়াতেই খেলতে যাব। পরে হয়তো খোঁজ নিয়ে দেখা গেল, অস্ট্রেলিয়া থেকে যে পরিমাণ টাকার অফারের কথা বলেছে ও, তা মিথ্যে।’
বিশ্বকাপে কালো আর্মব্যান্ড বেঁধে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার আর হেনরি ওলোঙ্গার প্রতিবাদের ব্যাপারে আলী শাহর কোনো আপত্তি নেই। তাঁর আপত্তি শুধু ব্যাপারটিকে বেশি দূর টেনে নিয়ে যাওয়ায়, ‘প্রথম ম্যাচে ওরা এটা করল, ঠিক আছে। জিম্বাবুয়ের বেশির ভাগ মানুষ তা সমর্থনও করেছে। কিন্তু তাঁদের অনুরোধ করার পরও পরের ম্যাচেও একই কাজ করে জিম্বাবুয়ে দলের ক্ষতি করেছে ওরা। একটা খেলার বিশ্বমঞ্চকে আপনি রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার কাজে ব্যবহার করতে পারেন না।’
হেনরি ওলোঙ্গা এখন ইংল্যান্ডে। পত্রপত্রিকায়-টিভিতে সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন আর বলে বেড়াচ্ছেন, জিম্বাবুয়েতে ফিরলেই তাঁকে মেরে ফেলা হবে। ২০০৩ বিশ্বকাপে ওই কালো আর্মব্যান্ড বিতর্কের সময়ও অভিযোগ করেছিলেন, তাঁকে ধরার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় লোক পাঠিয়েছে জিম্বাবুইয়ান সরকার। ওলোঙ্গার নাম শুনেই আলী শাহ হাসলেন, ‘অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার যে তাঁকে ব্যবহার করেছে, ওলোঙ্গা তা বুঝতেও পারেনি। অ্যান্ডির কালো কাউকে দরকার ছিল, এ জন্যই ওলোঙ্গাকে সঙ্গে নিয়েছে। জিম্বাবুয়েতে থাকলেও ওদের কিছুই হতো না। সারা পৃথিবীর নজর যখন ওদের ওপর, তখন ওদের কিছু করার বোকামি কেউ কেন করবে? আমার তো মনে হয়, উল্টো জিম্বাবুইয়ান সরকার নিজেদের স্বার্থেই তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করত।’
এরপর যে উদাহরণটা দিলেন আলী শাহ, সেটি শোনার পর তাঁর কথা একেবারে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় থাকল না, ‘দেখুন, রোডেশিয়া থেকে জিম্বাবুয়ে হতে ইয়ান স্মিথের সঙ্গে লড়াই হয়েছে। অথচ এখনো তো ইয়ান স্মিথ বহাল তবিয়তে জিম্বাবুয়েতে আছেন। ৭৩ বছর বয়স, নিজের খামারে সময় কাটান। তাঁরই যখন কিছু হয়নি, অ্যান্ডি-হেনরিরও কিছু হতো না।’
আরও পড়ুন: অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারের সাক্ষাৎকার
আরও পড়ুন: গ্রান্ট ফ্লাওয়ারের সাক্ষাৎকার