সমর্থকদের জয় আর অন্ধত্বের অন্ধকার
মোস্তফা মামুন
২৬ এপ্রিল ২০২১
ফুটবল ফ্যানদের তো ধন্যবাদ দিতেই হবে, ধন্যবাদ দেওয়ার আছে ক্লাবগুলোকেও। প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু লাখো মানুষ তো আর রাস্তায় নেমে পড়েনি যে বাধ্য হয়ে...। হাজারখানেক বা সে রকম সংখ্যার সমর্থকের প্রতিবাদ, কিন্তু সেটাও ওদের কানে গেছে। বোঝা গেল, অধুনার হাওয়া আর উদ্ভট মালিকানায় পথচ্যুত হলেও আদতে নিজেদের ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা আছে তাদেরও।
ভদ্রলোক বলেছিলেন, ক্লাব চত্বরে ঢুকে আমাকে এসএমএস করো।
কথামতো কাজ। একটা সমস্যা হচ্ছিল অবশ্য। স্প্যানিশে যাবতীয় দিকনির্দেশনা, তাই ঠিক বুঝতে পারছিলাম না কোনটা ন্যু ক্যাম্পের প্রশাসনিক বিল্ডিং। দু-একজনকে জিজ্ঞেস করেও সুবিধা করা গেল না। যা বলে এর বিন্দুবিসর্গ বোঝা যায় না বলে বাঙালি অভিজ্ঞতাই কাজে লাগালাম। সবচেয়ে বড় দালানটা প্রশাসনিক ভবন না হয়ে যায় না। ওখানেই মিস্টার ওয়েনেস ন্যু ক্যাম্প ট্যুরের দুটি টিকিট নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করে আছেন। উয়েফার বড় কর্তার রেফারেন্সে এসেছি বলে যথেষ্ট খাতির, তিনি একটু পর পর ফোন করে কাজ চালানো ইংরেজিতে জানতে চাইছেন, কত দূরে আছি।
বললাম, ‘একদম গেটের সামনে।’
‘আমিও তো গেটের সামনে।’
‘তোমাকে দেখি না কেন?’
আমি পোশাক-টোশাকের যথাসাধ্য বর্ণনা দিলাম। তারটাও নিলাম। জানা গেল, তিনি নীল স্যুট পরে আছেন। না, নীল স্যুটধারী কাউকে তো দেখা যায় না।
একটু এগিয়ে ভিড়ের মধ্যে খোঁজাখুঁজি করলাম। আর আবিষ্কার করলাম, এই বিশাল দালানটা আসলে সাপোর্টার্স অফিস। কারও মৌসুমি টিকিট লাগবে। কেউ এসেছে পরের অ্যাওয়ে ম্যাচের যাত্রার সূচি সম্পর্কে জানতে।
পরে ওয়েনেসকে পাওয়া গেল। ন্যু ক্যাম্পের আনাচ-কানাচ ঘুরে দেখলাম। ম্যাচের দিনে তাতে মিশে থাকে রোমাঞ্চের সম্ভার আর ম্যাচহীন দিনে যেন ঐতিহ্যের অহংকার। পুরো স্থাপনাটা এমনই ধাঁধাময় যে মনে হয় সাবেক উয়েফা সভাপতি লেনার্ত ইয়োহানসনের বিভ্রান্তিটা আসলে স্বাভাবিকই ছিল। ১৯৯৯-এর ম্যানইউ-বায়ার্নের কল্পকথা হয়ে যাওয়া ফাইনালটা হয়েছিল এখানে। ম্যাচের ৯০ মিনিট প্রায় শেষ, ১-০ গোলে এগিয়ে থাকা বায়ার্ন জিতে গেছে ধরে নিয়ে তিনি প্রেসিডেন্টস্ বক্স থেকে বেরিয়ে গেলেন। জটিল এবং প্যাঁচানো সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে অবাক। বায়ার্নের খেলোয়াড়রা সব শুয়ে পড়ে কাঁদছে। ম্যানইউ লাফাচ্ছে। ভদ্রলোক আসলে কল্পনাই করতে পারেননি তিনি সিঁড়িতে থাকা অবস্থায় দুই গোল দিয়ে দিয়েছে ম্যানইউ। মাঠে থেকে এক গোলের উল্লাস মিস হতে পারে, তাই বলে দু-দুটো গোল! উয়েফার সর্বময় কর্তা টেরই পাবেন না? আসলে এক শ গোল হলেও টের পাবেন না। স্থাপত্যকর্মটা এমনই যে মাঠ থেকে চোখ ফিরিয়ে বেরোতে গেলেই যেন সুড়ঙ্গে হারিয়ে গেলেন।
পরের ঘণ্টা তিনেক সেই সুড়ঙ্গরূপী ভূতুড়ে পথে নানা দিকে চললাম, গৌরবের ভরপুর সব খনি দেখলাম, কিন্তু ওই সামান্য ব্যাপারটা মাথা থেকে গেল না। সবচেয়ে বড় দালানটা সমর্থকদের। সেটাই ওদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আর ভরদুপুরে একটা দীর্ঘশ্বাসও ফেললাম। তুলনায় আমাদের সমর্থকরা কত দুর্ভাগা। প্রশাসকরা বিলাসবহুল প্রাসাদে খেলা দেখেন, যখন এদের ভাগ্যে সাধারণত জোটে বঞ্চনা আর বিড়ম্বনা। নিরাপত্তারক্ষীদের চোখ রাঙানি, ১০ টাকার জিনিস ৫০ টাকায় কিনে খাওয়া, বাথরুমে যেতে নিঃশ্বাস বন্ধ করার এক্সারসাইজ করা; এই তো ওদের ভাগ্য। এরপর ইউরোপের বহু মাঠে গেছি আর প্রতিবারই মনে হয়েছে, ওদের সমর্থকরা কত ভাগ্যবান।
কিন্তু গত সপ্তাহের পর কেন যেন মনে হচ্ছে ওদের ভাগ্যবান বলাটা একটু অবিচার। এ আসলে ওদের অর্জন। কারো দয়ার দান নয়। সমর্থকসুলভ বাঁধনহারা ভালোবাসা তো আছেই। সঙ্গে উচ্চাঙ্গের মূল্যবোধ, ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সুস্পষ্ট ফুটবলবোধ ওদের মর্যাদার জায়গাটাও নিশ্চিত করেছে। ভালোবাসা অশেষ, কিন্তু অন্ধ নয়। ভুল পথ ধরলে সেই পথে পা না বাড়িয়ে বরং পথ আগলাবে। আর তাতে ঘটে গেল অবিশ্বাস্য ঘটনা। একবিংশ শতকে তথাকথিত বাজার আর বাস্তবতার অঙ্ক যখন সব গিলে নিচ্ছিল তখন তাদের পাল্টা আঘাতে আমাদের ক্ষয়ে যাওয়া একটা বিশ্বাসও ফিরে এলো। এখনকার দুনিয়া টাকারই দুনিয়া, তবে কোথাও না কোথায়ও মূল্যবোধের মূল্য আজও টাকাকে চ্যালেঞ্জ জানায় এবং জিতে যায়।
মরিনহো বলছিলেন, ‘পর্তুগালে আমরা বলি, তুমি জীবনে দুটি জিনিস ছাড়া আর সব বদলাতে পারবে। সেই দুটি জিনিস হচ্ছে, তোমার মা আর ফুটবল ক্লাব।’ বুয়েনস এইরেসে বোকার সমর্থকরা মৃত্যুর পরও যেন একসঙ্গে থাকা যায় এ জন্য সমাধিস্থলও কিনে রেখেছে। এভাবেই বিল শ্যাঙ্কলির চিন্তায় ‘ফুটবল জীবন-মৃত্যু নয়, এর চেয়েও বড় কিছু’ হয়েছে। ইউরোপ এমনিতেই ঐতিহ্যমুখী আভিজাত্যবাদী। আমেরিকানরা যখন বলে, অতীত বা তোমার বংশ-পরিচয় কোনো ব্যাপার না, তুমি কে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ; ইউরোপ তখনও রাজা-রানিকে মাথায় করে রাখে। তবে সময় এবং বাস্তবতার সঙ্গে আপস করে সেই রাজাদের কাগুজে রাজা বানায়। যাতে ঐতিহ্যও রইল, সময়োপযোগীও হওয়া গায়ে লাগল।
ফুটবলেও তাই। বাজারের নিয়ম আছে, তাতে হাইবুরি হয়ে গেছে এমিরেটস। পেট্রোডলার বা রাশিয়ান তেল মালিক বা মার্কিনি ধুরন্ধর মার্কেটিং ওস্তাদরাও ক্লাবগুলোর মালিকানায় চলে এসেছিলেন নির্বিঘ্নে। এতে তাঁদের এই বিশ্বাসও বোধ হয় তৈরি হয়েছিল যে, ঐতিহ্য-মূল্যবোধ এসব ‘পুরনো’ জিনিস থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া গেছে। এখন নর্থ আমেরিকান স্পোর্টিং ম্যানেজমেন্ট মডেলের দিকে আগানো যায়। পৃথিবীতে মোটা দাগে দুই ধরনের মডেল, একটা ক্লাবভিত্তিক, বহুদিন ধরে গড়ে ওঠা প্রক্রিয়া। আরেকটা ফ্র্যাঞ্চাইজিনির্ভর, টাকাওয়ালা করপোরেট কোম্পানির দল কিনে সাফল্য এবং সমর্থক জোগাড় করা। হালে গোটা দুনিয়ায় যৌক্তিক কারণে দ্বিতীয়টাই রমরমা। ইউরোপের শীর্ষ ক্লাবগুলো দেখেছিল, তাদেরই সমর্থক বেশির ভাগ, তাদেরই খেলা দেখে পুরো দুনিয়া; তাহলে আর ছোটদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে যাওয়া কেন?
এখনকার বিশ্ব নিয়মে খুবই যৌক্তিক দাবি। এবং তাতে নিজেদের সমর্থকদের তাল দেওয়ারই কথা। তাদের দল আরও বেশি টাকা পাবে। আরও বেশি বেশি বড় ম্যাচ দেখার স্বপ্নে তাদের সমর্থকরা শিহরিত হবে। আর এই শক্তি দিয়েই উয়েফা-ফিফাকে বাগে আনা খুবই সম্ভব। কিন্তু সেই সমর্থকরাই যে এমন বেঁকে বসবে, তারা কল্পনা করতে পারেনি। সত্যি বললে আমরাও ভাবিনি। আশপাশের বিভ্রান্তিকর সমর্থনভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল, ইউরোপের সমাজও ভেসে গেছে। মনের মধ্যে ক্ষীণ আশা অবশ্য ছিল। বারকয়েক ইউরোপ ঘুরে এবং ওদের এই প্রজন্মের গভীর চিন্তা দেখে মনে হয়েছিল, বিষয়টা আমরা যেভাবে ভাবি, এমন বোধ হয় নয়। প্রথম আনন্দময় ধাক্কাটা খাই ২০১৭ সালে ইংল্যান্ডের নির্বাচন কাভার করতে গিয়ে। লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন প্রায় ঘোষিত সমাজতন্ত্রী, কিন্তু তরুণদের কাছে অবিশ্বাস্য রকম জনপ্রিয়। সব জনমতই ছিল এমন যে তরুণরা যত বেশি ভোট দিতে আসবে, করবিনের জেতার সম্ভাবনা তত বেশি। ঠিক যেন মেলে না। তরুণরা সব সময় ভোগী বলেই গণ্য, সমাজতন্ত্র সেখানে প্রায় পরিত্যক্ত ব্যবস্থা, তাহলে...? কৌতূহল থেকে নিজের মতো করে বিষয়টা অনুসরণ করে অনেক তরুণের সঙ্গে কথা বললাম আর অবাক হয়ে দেখলাম, আমরা ওদের বাইরের চেহারা দেখে যে বিচারে পৌঁছে যাই তাতে কত ভুল। বার্মিংহামের এক ঝাঁকড়া চুলের তরুণ বলছিল, ‘ধরো, আমি ভালো থাকলাম, চাকরি পেলাম, কিন্তু আমার পাশে একজন দাঁড়িয়ে না খেয়ে চিৎকার করছে, তাহলে আমি স্বস্তি পাব কী করে? হয় নাকি!’
ওরা নিজেরা ভালো থাকতে চায়, কিন্তু মনে করে ভালো থাকার সবচেয়ে ভালো উপায়, সবাই মিলে ভালো থাকা। আর এই সবাই মিলে ভালো থাকার সবচেয়ে ভালো উপায়কেই ওরা আঁকড়ে রাখতে চায়। ছোট ক্লাবগুলো বড় দলের সঙ্গে না খেলতে পারলে ছোটদের আর থাকেটা কী! এমনিতেই এই কথিত সুপার লিগ মডেল হিসেবে প্রক্রিয়াটা অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং ত্যাজ্য। যে খেলায় কোনো রেলিগেশন-প্রমোশন থাকবে না, যেমনটা আইপিএলে নেই, তাহলে এই টুর্নামেন্ট সবার জন্য নয়। ধরনের মধ্যেই একটা রাজতান্ত্রিকতা আছে। দ্বিতীয়ত, খেলার যে অনিশ্চয়তার মজা সেটার গুরুত্বও কী কম! ছোট দল বড় দলগুলোর সঙ্গে বেশির ভাগ সময় হারে, এটা যেমন সত্য, তেমনি কখনো কখনো যে হারিয়ে দেবে, এই সম্ভাবনাটাই খেলার অনিশ্চয়তার চরিত্রকে ধারণ করে রাখে। বড় দল বড় দল খেলা হলে সেটাই যে আর থাকে না। খেলার মৌল চরিত্রের সঙ্গেই এগুলো অসংগতিপূর্ণ। আর তাই গর্জে ওঠে সেই সমর্থকরা, যারা দলপ্রেমী, কিন্তু তারও আগে খেলাপ্রেমী। ফলে আইপিএল বা ক্রিকেটে যা চলতে পারে, ফুটবল বা ক্লাবে তা চলতে পারে না।
আর ধন্যবাদ দেওয়ার আছে ক্লাবগুলোকেও। প্রতিবাদ হয়েছে, কিন্তু লাখো মানুষ তো আর রাস্তায় নেমে পড়েনি যে বাধ্য হয়ে...। হাজারখানেক বা সে রকম সংখ্যার সমর্থকের প্রতিবাদ, কিন্তু সেটাও ওদের কানে গেছে। বোঝা গেল, অধুনার হাওয়া আর উদ্ভট মালিকানায় পথচ্যুত হলেও আদতে নিজেদের ইতিহাসের প্রতি শ্রদ্ধা আছে তাদেরও।
সমর্থকদের মধ্যে প্রতিবাদ করার লোক যেমন আছে, ক্লাবে তেমন প্রতিবাদ শোনার লোকও আছে। এই জায়গাতে দুই পক্ষ মিলে গেল বলেই প্রবল টর্নেডো দুই দিনের মধ্যেই দুর্বল বায়ুপ্রবাহ হয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়।
তখন নিজের অভিজ্ঞতাটা আবার মনে পড়ে। এসব সমর্থকের জন্য সবচেয়ে বড় দালানটাই বরাদ্দ রাখতে হয়। আবার ক্লাব ওদের কথা শুনে আর ভাবে বলেই ওরা 'মা আর ক্লাব কখনো বদলায় না।'
নিজেদের জন্য তখন আবার বড় দীর্ঘশ্বাস ফেলতে হয়। আমাদের বিভ্রান্তিকর সমর্থনের দৃষ্টিভঙ্গিতে খেলা তুচ্ছ হয়ে এর চেয়ে দল বা দেশ বড় হয়ে যায়। আবার কখনো সেই দলের চেয়ে বড় হয়ে ওঠে খেলোয়াড়। কে জানে, এই কারণেই হয়তো আমাদের সমর্থকরা মর্যাদাহীন। ম্যাচ পাতানোতে জড়িত খেলোয়াড়কে সামাজিকভাবে পরিত্যাগ না করে যখন তাঁর পক্ষে সাফাই দেন, বড়ত্ব দেখিয়ে খেলার মূল চেতনাকে অগ্রাহ্য করা দলকেও যখন দেয়া হয় বাহবা, তখন সেই সমর্থক আসলে নিজেকেও তুচ্ছ করে ফেলেন। নিজের প্রিয় খেলোয়াড়কে বড় করে দেখাতে গিয়ে দলেরই অন্যদের তীব্রভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করায় দলীয় সমর্থক হিসাবে নিজের অবস্থানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়। এভাবেই অন্ধত্বের অন্ধকারে হারিয়ে যায় তাঁর মর্যাদা। সেই সূত্রে সম্ভবত অধিকারও।
তাই বোধ হয় তাঁদের কপালে থাকে পুলিশের লাঠি। গ্যালারিতে বসতে হয় প্রচণ্ড অবহেলা নিয়ে। পুরো আয়োজনে সে-ই সবচেয়ে সামান্য এবং অসম্মানিত। যদিও আসলে তাঁর মাথাটাই থাকার কথা সবচেয়ে উঁচুতে। ইউরোপিয়ান সমর্থকদের যেমন থাকে। যেমন এবার থাকল।
* মোস্তফা মামুন: ক্রীড়া সাংবাদিক ও লেখক।