লিস্ট `এ` ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরি

সৌম্যর সেই রুদ্র ইনিংস 

রিফাত এমিল

২৩ এপ্রিল ২০২১

সৌম্যর সেই রুদ্র ইনিংস 

রেকর্ড গড়া সেই ডাবল সেঞ্চুরির পর সৌম্য সরকার। ২৩ এপ্রিল ২০১৯, বিকেএসপি। ছবি: বিসিবি

লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে খেলেছেন ১৪০ ইনিংস। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে এক ইনিংস কম। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও ব্যাট করতে নেমেছেন ১২৪ বার। এত ইনিংসের মধ্যে হুট করে ২৩ এপ্রিল শুনে সৌম্য নিজেও মনে করতে পারবেন কি না, কে জানে। তবে ডাবল সেঞ্চুরি বললেই নিশ্চিত তা পারবেন। তাঁর মনে যাবে, ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল বিকেএসপিতে ইতিহাস গড়া সেই ইনিংসের কথা।

বাংলাদেশের সবচেয়ে মারকুটে ব্যাটসম্যান কে? কখনো সুপার ওভারে ব্যাটসম্যান নামানোর দায়িত্ব কাঁধে পড়লে আপনি কাকে নামাবেন।? উত্তর আপেক্ষিক তা বলাই যায়। একেক জনের পছন্দ একেক রকম। তবে অনেকেরই মিল আসতে পারে যে নামে, সে নামটি সৌম্য সরকার।  

হুট করে সৌম্যকে নিয়ে কেন পড়েছি? বাংলাদেশ দল পাল্লেকেলে টেস্টে সুন্দর সময় কাটাচ্ছে।  ব্যাটসম্যানরা ছন্দে, সবাই পেয়েছে রান। সৌম্য তো দলেও নেই। সৌম্যকে মনে পড়ার কারণ ২৩ এপ্রিল। কেন এই ২৩ এপ্রিলেই সৌম্যকেই মনে পড়ছে? 

লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ব্যাটিং করতে নেমেছেন ১৪০ ইনিংস। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তার চেয়ে এক ইনিংস কম। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও নেমেছেন ১২৪ বার। এত ইনিংসের মধ্যে হুট করে ২৩ এপ্রিল শুনে সৌম্য নিজেও মনে করতে পারবেন কি না, কে জানে।

ধান ভানতে শিবের গীত গেয়ে ফেলছি। মূল কথাটা বলে ফেলাই ভালো, সৌম্যকে মনে পড়ার কারণ লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে বাংলাদেশের একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরিটি। ডাবল সেঞ্চুরি শুনলেই হয়তো সৌম্য বলেই ফেলতেন, ‘আরে, এই তো সেদিন বিকেএসপির তিন নম্বর মাঠের ঘটনা। যেদিন খেলেছিলাম একেবারে নিজের মতো।’’ 

দেশের অন্যতম মারকুটে ব্যাটসম্যান একেবারে নিজের মতো খেললে যা হওয়ার কথা ২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিলে হয়েছিল তা-ই।  বাংলাদেশের লিস্ট ‘এ’ ইতিহাসে একমাত্র ডাবল সেঞ্চুরি। একমাত্র যেহেতু, এটাই লিস্ট ‘এ’-তে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ, তা আর না বললেও চলছে। সীমানাটা শুধু বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে না রাখলেও চলে। বাংলাদেশের মাটিতেই লিস্ট 'এ' ক্রিকেটে এটি কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ।

শুধু কী সৌম্য? এই ইনিংস তো আরও অনেকেরই মনে রাখার কথা। অনেক রেকর্ডের সেই ইনিংসে সৌম্য যে অনেকের নাম মুছে দিয়ে লিখেছেন নিজের নাম।

•    বাংলাদেশের প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ডাবল সেঞ্চুরির কথা তো বলাই হলো। এর আগে সর্বোচ্চ ছিল রকিবুল হাসানের ১৯০। ২০১৭ ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে যা করেছিলেন তিনি মোহামেডানের হয়ে আবাহনীর বিপক্ষে।

•    ইনিংসে সৌম্য ছক্কা মেরেছিলেন ১৬টি। লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের এক ইনিংসে সবচেয়ে বেশি ছক্কার রেকর্ড। আগের রেকর্ড ১১ ছক্কার। প্রাইম দোলেশ্বর স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে যা মেরেছিলেন সাইফ হাসান। সাইফের আগেই অবশ্য এক ইনিংসে ১১টি ছক্কা মেরে রেখেছিলেন সৌম্য, মেরেছিলেন মাশরাফিও। সর্বোচ্চ ছক্কার রেকর্ডে এখন নামটা শুধুই সৌম্যের। শুধু কি বাংলাদেশিদের মধ্যে? পুরো লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেট ইতিহাসেই সৌম্যের চেয়ে বেশি ছক্কার ইনিংস মাত্র তিনটি।  

সৌম্যর ডাবল সেঞ্চুরির দিনে তিন অঙ্কের ম্যাজিক ফিগারের দেখে পেয়েছিলেন জহিরুল ইসলাম অমিও। তাতেও ইতিহাস। শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের ৩১৭ রানের জবাবে দুজনের ওপেনিং জুটিতেই রান ৩১২। দুজনের কল্যাণে বাংলাদেশের লিস্ট 'এ' ক্রিকেট প্রথম দেখেছে ৩০০ রানের জুটি।

এর আগের সর্বোচ্চ জুটি ছিল ২৯০ রানের। ২০০৭ সালে জাতীয় লিগের ওয়ানডে সংস্করণে রাজশাহীর বিপক্ষে চট্টগ্রাম বিভাগের হয়ে তৃতীয় উইকেট জুটিতে যেটির অংশীদার ছিলেন মাহবুবুল করিম ও ধীমান ঘোষ। ওপেনিং জুটিতে এর আগের রেকর্ড ছিল ২০১৮ সালে আবাহনীর হয়ে এনামুল হক ও নাজমুল হোসেন শান্তর ২৩৬ রান।  

১৯৪ মিনিটে, ১৫৩ বলে ১৪ চার ও ১৬ ছয়ে অপরাজিত ২০৮। সৌম্য সরকার। ছবি: বিসিবি

রেকর্ড নিয়ে কথা তো অনেক হলো, এবার ইনিংস নিয়ে কিছু বলা যাক। এমন ইনিংস নিয়ে কিছু না বললে যে তা রীতিমতো অন্যায় হবে। 

৩১৭ রানের বোঝা নিয়ে সৌম্য নেমেছিলেন ওপেনিংয়ে। যেমন উইকেটই হোক, ৫০ ওভারের ক্রিকেটে ৩০০ পেরোনোর লক্ষ্য মানেই তো বড় বোঝা। অভ্যাস নেই বলে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের জন্য তা আরও বেশি। চাপটা আরও বেশি ছিল আবাহনীর ঢাকা প্রিমিয়ার লিগ শিরোপা এর ওপর নির্ভর করছিল বলে। চ্যাম্পিয়ন হতে হলে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবকে হারাতেই হবে। আর সেই ম্যাচেই কিনা ৩১৮ রানের টার্গেট। সৌম্য অমন রুদ্ররূপে দেখা দিয়েছিলেন বলে ১৭ বল বাকি রেখেই যা করে ফেলে আবাহনী।  

সৌম্যর প্রথম ৫০ এসেছিল ৫২ বলে, যাতে চার-ছয় সমান, ৪টি করে। হাফ সেঞ্চুরির পর আরও মারমুখী হয়ে ওঠার প্রমাণ মাত্র ৩৮ বলে দ্বিতীয় ফিফটি করে সেঞ্চুরির দেখা পাওয়া। আবারও চার, ছক্কার সংখ্যা সমান রেখে ৮ চার ও ৮ ছয়ে সেই সেঞ্চুরি।

ওভারনির্দিষ্ট ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরির অভিজ্ঞতার সঙ্গে সৌম্য অবশ্য একেবারে অপরিচিত ছিলেন না। এর সাত বছর আগেই, ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে কুয়েতের বিপক্ষে করেছিলেন ২০৯।

তাতেই তৃপ্তির ঢেঁকুর না তুলে সেঞ্চুরির সময়ে থাকা ৮ চার ও ছয়ের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ বানিয়ে ১৫ ছয়ে ১০৪ বলে করেন ১৫০ রান। ডাবল সেঞ্চুরি ১৪৯ বলে, যাতে ১৪টি চার ও ১৫টি ছয়।

শেষ পর্যন্ত ১৯৪ মিনিটে, ১৫৩ বলে ১৪ চার ও ১৬ ছয়ে অপরাজিত ২০৮ রানের ইনিংস। তাইজুলকে তাঁর ইনিংসে ১৬ নম্বর ছক্কা মেরেই ম্যাচ শেষ করেছেন। সৌমের হাতে সবচেয়ে বেশি নাজহাল হয়েছেন তাইজুলই। ওভারপ্রতি ১১ রান দিতে বাধ্য হওয়া তাইজুল হজম করেছেন সাতটি ছক্কা। সৌম্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪টি ছক্কা মেরেছেন মিনহাজুল আবেদীন আফ্রিদিকে।

ওভারনির্দিষ্ট ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরির অভিজ্ঞতার সঙ্গে সৌম্য অবশ্য একেবারে অপরিচিত ছিলেন না। এর সাত বছর আগেই, ২০১২ সালে মালয়েশিয়ায় অনূর্ধ্ব-১৯ এশিয়া কাপে কুয়েতের বিপক্ষে করেছিলেন ২০৯। সেদিন অবশ্য ২৭টি চার মারলেও ছয় মেরেছিলেন ৮টি। তার সাত বছর পর ডাবল সেঞ্চুরি করলেন সেই ইনিংসের দ্বিগুণ ছয় মেরে।  

ডাবল সেঞ্চুরির আগের ম্যাচেই লিজেন্ডস অব রূপগঞ্জের বিপক্ষে করেছিলেন ৭১ বলে সেঞ্চুরি। সেই এপ্রিলকে তাই বিশেষভাবে মনে রাখা উচিত সৌম্যর। হয়তো মনে রেখেছেনও। সৌম্য ছাড়া অমন ইনিংস আর যারা মনে রেখেছেন, তাদের জন্য শুরুতে ছুঁড়ে দেওয়ার সেই প্রশ্ন দুটির উত্তর দেওয়া মনে হয় বেশ সহজই হবে।

প্রশ্ন দুটি মনে আছে তো? 

বাংলাদেশের সবচেয়ে মারকুটে ব্যাটসম্যান কে?

কখনো সুপার ওভারে ব্যাটসম্যান নামানোর দায়িত্ব কাঁধে পড়লে আপনি কাকে নামাবেন?

২০১৯ সালের ২৩ এপ্রিল যাদের মনে আছে, প্রশ্ন দুটি শেষ হওয়ার আগেই তাদের বলার কথা–আর কে, সৌম্য; সৌম্য সরকার।

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×