অভিশপ্ত এক স্টেডিয়ামের গল্প

উৎপল শুভ্র

২১ এপ্রিল ২০২১

অভিশপ্ত এক স্টেডিয়ামের গল্প

তখন পর্যন্ত এই মাঠে টেস্ট হয়েছে ১৯টি, তাতেই অনেক ঘটনার ঘনঘটা। দুর্ঘটনাও। ফিল্ডিংয়ের সময় সংঘর্ষে স্টিভ ওয়াহর নাক আর জ্যাসন গিলেস্পির পা ভাঙার ঘটনা তো মোটামুটি সবারই জানা। এর বাইরেও ক্যান্ডির এই আসগিরিয়া স্টেডিয়াম এমন কিছু ভুতুড়ে ঘটনার সাক্ষী যে, `অভিশপ্ত` শব্দটা এর সঙ্গে খুব ভালো খেটে যায়।

প্রথম প্রকাশ: ১০ জুলাই ২০০৭। প্রথম আলো।

সেপ্টেম্বর ১৯৯৯: মাহেলা জয়াবর্ধনের সুইপ ক্যাচ হয়ে উঠে গেল ডিপ ব্যাকওয়ার্ড স্কয়ার লেগের দিকে। স্কয়ার লেগ থেকে দৌড় লাগালেন স্টিভ ওয়াহ, বাউন্ডারি লাইন থেকে জ্যাসন গিলেস্পি। বলের নিচে ধাবমান দুজনের ধাক্কা লাগল। গিলেস্পির পা ভাঙল, স্টিভ ওয়াহর নাক। শ্রীলঙ্কান সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে দুজনকে উড়িয়ে নিতে হলো কলম্বোর হাসপাতালে। চার জায়গায় ভেঙে যাওয়া নাকে ব্যান্ডেজ নিয়ে স্টিভ ওয়াহ বললেন, ‘অবস্থা আরও খারাপ হতে পারত। আমি তো ভেবেছিলাম, নাকটা বোধহয় মস্তিষ্কে ঢুকে গেছে।’

ক্যান্ডির আসগিরিয়া স্টেডিয়ামে প্রথম পা দিয়ে কারও যদি এই ঘটনা মনে না পড়ে, তা হলে বুঝতে হবে তিনি ক্রিকেটের খোঁজখবর খুব একটা রাখেন না। পাহাড় কেটে বানানো আসগিরিয়া স্টেডিয়াম আর ওয়াহ-গিলেস্পির ওই সংঘর্ষ এমনই সমার্থক হয়ে গেছে যে, এতে প্রথম পা রেখেছি জেনে ক্যান্ডি ডিস্ট্রিক্ট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি দেবা আমুনুগামা প্রথমেই বললেন, ‘ওই যে স্কোরবোর্ডটা দেখছেন, ওটির নিচেই স্টিভ ওয়াহ আর জ্যাসন গিলেস্পির সংঘর্ষটা হয়েছিল।’ যেন এটিই আসগিরিয়া স্টেডিয়ামে সবচেয়ে বড় ‘কীর্তি’!নাকে ব্যান্ডেজ বেঁধে স্টিভ ওয়াহ, জ্যাসন গিলেস্পিকে মাঠের বাইরে বয়ে নিতে হচ্ছে দুজনের। ছবি: গেটি ইমেজেস

সবচেয়ে বড় এটিই, তবে একমাত্র নয়। ১৯৮৩ সালে টেস্ট ভেন্যু হিসেবে অভিষেক হওয়ার পরও আগামীকাল শুরু হতে যাওয়া বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের তৃতীয় ম্যাচটি এই মাঠে মাত্র ২০তম টেস্ট। অথচ এর মধ্যেই এখানে এমন সব ভুতুড়ে ইনজুরির ঘটনা ঘটেছে যে, ছিমছাম দেখতে ক্যান্ডির আসগিরিয়া স্টেডিয়াম ‘অভিশপ্ত’ হিসেবে নাম লিখিয়ে ফেলেছে ক্রিকেট ইতিহাসে। আরও দুটি ঘটনা বলি—

ডিসেম্বর ২০০১: ওয়েস্ট ইন্ডিজ-শ্রীলঙ্কা ওয়ানডে ম্যাচ। একটা নো বলে সিঙ্গেল নিতে ক্রিজের দিকে ব্যাট বাড়িয়ে দিয়েছেন ব্রায়ান লারা। দৌড়ে আসা ফিল্ডার মারভান আতাপাত্তু গিয়ে পড়লেন তাঁর বাড়িয়ে দেওয়া হাতের ওপর। ব্যাট ফেলে দিয়ে ব্যথায় চিৎকার করতে শুরু করলেন লারা। প্রথমে মনে হয়েছিল, কনুই-কাঁধ দুটিই গেছে। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর জানা যায়, কনুইয়ের হাড় স্থানচ্যুত হওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি। তাতেই তিন মাস খেলার বাইরে থাকতে হলো লারাকে। শুধু লারার নয়, ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানদেরও এ নিয়ে আফসোসের শেষ নেই। কারণ লারা তখন ফর্মের তুঙ্গে। ওয়ানডে সিরিজের আগে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ৩ ম্যাচে করেছিলেন ৬৮৮ রান।

মে ২০০৩: এবার শিকার আতাপাত্তু নিজেই। মিড অফে ফিল্ডিং করছিলেন। সেখান থেকে বল ধরতে স্টাম্পের দিকে দৌড়ানোর সময় সংঘর্ষ হলো ড্যানিয়েল ভেট্টোরির সঙ্গে। ভেট্টোরির বুটের স্পাইক গলায় ঢুকে গিয়ে রীতিমতো রক্তারক্তি কাণ্ড। চোট পেলেন অ্যাঙ্কেলেও। স্ট্রেচারে করে মাঠ থেকে বের করে আতাপাত্তুকে সোজা নিয়ে যেতে হলো হাসপাতালে।

আসগিরিয়া স্টেডিয়ামের কিউরেটর এই মাঠকে ‘অভিশপ্ত’ বলতে শুনে খুব হাসলেন। তারপর নিজেই যোগ করলেন আরেকটি ঘটনা—কোন দলের বিপক্ষে তাঁর মনে নেই, মনে নেই বছরটাও, তবে এই মাঠে শুরুর দিকের এক টেস্ট ম্যাচে শ্রীলঙ্কান উইকেটকিপার অমল ডি সিলভা রান নেওয়ার সময় এক ফিল্ডারের থ্রোতে তাঁর চোখের ওপরে বল লাগে। প্রচুর রক্তপাতও হয়। চোখটা নষ্ট হয়ে গেল কি না, এ আশঙ্কাও জেগেছিল, যে আশঙ্কা পরে সত্যি হয়নি।

আতাপাত্তু-ভেট্টোরি সংঘর্ষের পর। ছবি: রয়টার্স

মাত্র ১৯টি টেস্ট ম্যাচেই এত সব ‘ভুতুড়ে’ ইনজুরি উপহার দেওয়ার পর ক্যান্ডির আসগিরিয়া স্টেডিয়ামকে অভিশপ্ত বলাটা মোটেই বাড়াবাড়ি হয় না। ২০০৪ সালে এই মাঠে আবারও টেস্ট খেলতে এসে একটা গা শিরশিরে অনুভূতির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল জ্যাসন গিলেস্পির। টেস্টের আগের দিন প্র্যাকটিসে নেমে বারবার ফিরে আসছিল স্টিভ ওয়াহর সঙ্গে ওই সংঘর্ষের স্মৃতি, ক্যাচিং প্র্যাকটিসের সময় বল ধরতে পারছিলেন না। জ্যাসন গিলেস্পির এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক।

ভুতুড়ে ইনজুরির এত সব ইতিহাস জানা থাকলে এই মাঠে খেলতে নামার সময় যে কারোরই মন একটু খুঁতখুঁত করতে বাধ্য। মোহাম্মদ আশরাফুলের কি করছে?

করছে না, কারণ ওয়াহ-গিলেস্পির ওই ঘটনাটি জানা থাকলেও সেটি যে এই মাঠে, এটা তিনি জানতেন না। লারা-আতাপাত্তুর ঘটনা দুটিও যে এ মাঠেই, তা-ও না। আশরাফুলের যে কারণে ক্যান্ডির আসগিরিয়া স্টেডিয়ামকে মনে আছে, সেটিও অবশ্য কম বিচিত্র নয়। এই মাঠে আগে কখনো খেলেননি। খেলার সুযোগ এসেছিল, কিন্তু ২০০০ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে আশরাফুল ছিলেন দ্বাদশ ব্যক্তি! এক বছর পর টেস্ট ক্রিকেটের কনিষ্ঠতম সেঞ্চুরিয়ানে পরিণত হওয়া আজকের বাংলাদেশ-অধিনায়কের সে টুর্নামেন্টে মূল কাজ ছিল স্কোরারকে বাংলাদেশের খেলোয়াড় চেনায় সহায়তা করা!

আসগিরিয়া স্টেডিয়াম শ্রীলঙ্কার এই দলের দুজনের হোমগ্রাউন্ড। মুত্তিয়া মুরালিধরনের ক্ষেত্রে শুধু হোমগ্রাউন্ড বললেই চলছে, কুমার সাঙ্গাকারার ক্ষেত্রে নয়। এটি শুধু তাঁর হোমগ্রাউন্ডই নয়, স্কুলগ্রাউন্ডও! আসগিরিয়া স্টেডিয়ামটি আসলে সাঙ্গাকারার স্কুল ট্রিনিটি কলেজের প্রায় শতাব্দীপ্রাচীন নিজস্ব মাঠ। ১৯৮১ সালে সেই মাঠটিকেই উন্নয়ন করে টেস্ট ভেন্যু বানানো হয়েছে। সাঙ্গাকারার ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠা এ মাঠে খেলেই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে এই মাঠে আর কোনো ‘ভুতুড়ে’ ইনজুরির ঘটনা অবশ্য তিনি মনে করতে পারছেন না।

সাঙ্গাকারা-মুরালি, দুজনেরই হোমগ্রাউন্ড এই আসগিরিয়া স্টেডিয়াম। সাঙ্গাকারার তো নিজের কলেজের মাঠও। আসগিরিয়া বিশ্বের একমাত্র স্টেডিয়াম, যেটির মালিক একটা কলেজ। যে ট্রিনিটি কলেজ শ্রীলঙ্কাকে উপহার দিয়েছে মাদুগালে-সাঙ্গাকারার মতো ক্রিকেটার। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুধু ‘ভুতুড়ে’ ইনজুরিই কেন, এর বাইরেও আসগিরিয়া স্টেডিয়ামের সংক্ষিপ্ত টেস্ট ইতিহাসে এমন আরেকটি ঘটনা আছে, যেটি একমেবাদ্বিতীয়ম। টেস্ট ক্রিকেটে তিন বোলার মিলে এক ওভার শেষ করার একমাত্র ঘটনাটি এখানেই। ২০০০-২০০১ মৌসুমে ওয়েস্ট ইন্ডিজ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচে। মার্ভ ডিলন দুটি বল করার পর পেটের ব্যথায় মাঠ ছেড়েছিলেন। কলিন স্টুয়ার্ট ওভারটি শেষ করতে এসে ব্যাটসম্যান সনাৎ জয়াসুরিয়াকে তিন বলের মধ্যে দুটি বিমার ছুড়লে আম্পায়ার ওই ইনিংসেই তাঁকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। ওভারটি শেষ করতে হয় ক্রিস গেইলকে।

কী বুঝলেন? ক্যান্ডির আসগিরিয়া স্টেডিয়াম শুধু ‘অভিশপ্ত’ই নয়, বিচিত্র সব ঘটনার আধারও। টেস্ট ম্যাচের প্রথম দিন মাত্র ১২ ওভার হওয়ার পর বৃষ্টির কারণে আর একটি বলও না হওয়া (১৯৯৩ সালে ভারত-শ্রীলঙ্কা), ব্যাটসম্যান বোল্ড হওয়ার পরও মাঠের দুই আম্পায়ারের তাঁকে নট আউট ঘোষণা করা, পরে ফিল্ডিং দলের পীড়াপীড়িতে টিভি আম্পায়ারের সিদ্ধান্তে ব্যাটসম্যানের প্যাভিলিয়নে ফেরা (২০০৩ সালে ইংল্যান্ড-শ্রীলঙ্কা, বোলারের নাম জাইলস, ব্যাটসম্যান মুরালিধরন)—এমন ছোটখাটো ব্যতিক্রমী ঘটনার কথা বলতে গেলে জায়গায় কুলাবে না।

কে জানে, বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা টেস্টে এই তালিকায় নতুন কিছু যোগ হয় কি না!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×