হেইডেনের বিশ্ব রেকর্ডের কথায় জিম্বাবুইয়ান বোলাররা হাসছেন!

উৎপল শুভ্র

২৭ জানুয়ারি ২০২১

হেইডেনের বিশ্ব রেকর্ডের কথায় জিম্বাবুইয়ান বোলাররা হাসছেন!

ব্রায়ান লারার রেকর্ড ভাঙার পর ম্যাথু হেইডেন। পার্থ, ২০০৩

ম্যাথু হেইডেন নিশ্চয়ই কল্পনাও করেননি, মাত্র মাস ছয়েকই তাঁর অধিকারে থাকবে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ স্কোরের রেকর্ডটা। পার্থে হেইডেনের তোপের মুখে পড়া জিম্বাবুইয়ান বোলাররাও কল্পনা করেননি, কোনো ব্যাটসম্যান এমন মার মারতে পারে। দুঃস্বপ্নের ওই অভিজ্ঞতা বলার সময়ও তাঁদের মুখে তাই অবিশ্বাসের হাসি।

প্রথম প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০০৪। প্রথম আলো।

হিথ স্ট্রিক হেসে বললেন, ‘আমি জানতাম বাংলাদেশের কোনো না কোনো সাংবাদিকও আমাকে এই প্রশ্নটা করবে।’প্রশ্নটা শেষও করতে পারিনি, 'ম্যাথু হেইডেন’ নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই স্ট্রিকের মুখে ওই হাসি এবং এই একটা জায়গায় সবার মধ্যেই মিল। গত অক্টোবরে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনার ম্যাথু হেইডেন এই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই ভেঙেছেন ব্রায়ান লারার রেকর্ড। পার্থে টেস্ট ক্রিকেটের সর্বোচ্চ ওই ৩৮০ রানের ইনিংসটি যখন খেলছেন হেইডেন, কেমন লেগেছিল জিম্বাবুইয়ান বোলারদের?

একই অভিজ্ঞতার কথা বলছেন সবাই, তাই উত্তরের কিছু অংশে তো মিল থাকাটা প্রত্যাশিতই ছিল। তবে চমকে দিল ওই হাসিটাই। অ্যান্ডি ব্লিগনট, শন আরভিন, রেমন্ড প্রাইস, ট্রেভর গ্রিপার—সবারই উত্তর শুরু হলো হাসি দিয়ে। সর্বশেষ যাঁর সঙ্গে কথা বললাম, সেই শন আরভিনকে শেষ পর্যন্ত কারণটা জিজ্ঞেস না করে পারলাম না। আরভিন বললেন, ‘এটা ছিল আসলে হেইডেনেরই দিন। বলের পেছনে ওভাবে ছুটতে খারাপ তো লেগেছেই। তবে একটা সময় আমরা হাল ছেড়ে দিয়ে মাঠেই হাসাহাসি শুরু করেছি। কারণ আমরা বুঝে গিয়েছিলাম, আমরা শুধু চেষ্টাই করে যেতে পারি। কিন্তু এই ইনিংস কখন শেষ হবে, সেটি আর আমাদের হাতে নেই।’

শুধু তো বোলার নয়, স্ট্রিক জিম্বাবুয়ের অধিনায়কও। পরে কি তার কখনো মনে হয়েছে, অন্য কোনো ভাবে হেইডেনকে ঠেকানোর চেষ্টা করা যেত? স্ট্রিক নিজেও এ নিয়ে অনেক ভেবেছেন, কিন্তু বারবার পৌঁছেছেন একই সিদ্ধান্তে— কিছু করার ছিল না।

‘ফ্রিক ডে’র বাংলা করা কঠিন। কাছাকাছি হতে পারে, ভুতুড়ে দিন। এ কথাটাই ব্যবহার করলেন আরভিন। হেইডেনের সেই ইনিংসের সবচেয়ে তাৎপর্যময় দিক হিসেবে আর সবার মতো তাঁর মুখেও একই কথা, ‘শিয়ার পাওয়ার’। ‘কনসিসটেন্ট হিটিং’ শব্দ দুটিও শোনা গেল অনেকবার। এক দশকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে আর কাউকে এভাবে ধারাবাহিকভাবে বড় শট খেলে যেতে দেখেননি স্ট্রিক,‘ওর মিস হিটগুলোও সেদিন ছয় হয়ে যাচ্ছিল। ব্লিগনট ১৪৫-১৪৬ কিলোমিটার গতিতে বল করেছে। অথচ অবলীলায় ফ্রন্ট ফুটে গিয়ে সেগুলোতে ছয় মেরেছে হেইডেন!’

শুধু তো বোলার নয়, স্ট্রিক জিম্বাবুয়ের অধিনায়কও। পরে কি তার কখনো মনে হয়েছে, অন্য কোনো ভাবে হেইডেনকে ঠেকানোর চেষ্টা করা যেত? স্ট্রিক নিজেও এ নিয়ে অনেক ভেবেছেন, কিন্তু বারবার পৌঁছেছেন একই সিদ্ধান্তে— কিছু করার ছিল না। হেইডেনকে ঠেকাতে যা কিছু করা যেত, তার সবই করেছেন তিনি। ‘ব্লিগনটের দ্বিতীয় ওভারেই ভালো একটা এলবিডব্লু শাউট ছিল। এ ছাড়া হেইডেন আউট হতে পারত, এমন কিছুই হয়নি। তবে হ্যাঁ, ৩৪০ রানে ও একটা ক্যাচ দিয়েছিল। যা আমরা ধরতে পারিনি। প্রথম ১০০ রানের আগে কখনো কখনো একটু নড়বড়ে মনে হচ্ছিল ওকে। তবে সেঞ্চুরি করার পর থেকে ও যা খেলেছে, সেটিকে এক কথায় আমি বলব— আনস্টপেবল।’

শুধু হেইডেনই তো আর জিম্বাবুয়ের জন্য একমাত্র যন্ত্রণা ছিলেন না। ‘একদিকে হেইডেন ওরকম মারছে, অন্যদিকে গিলক্রিস্ট। ক্রিকেট মাঠে এতটা অসহায় আর কখনো লাগেনি’—স্বীকার না করে উপায় থাকল না স্ট্রিকের।

রেকর্ড ভাঙার আনন্দ! তখন তো আর ম্যাথু হেইডেন জানেন না, মাস ছয়েকই মাত্র তা তাঁর অধিকারে থাকবে

৬২২ মিনিটে ৪৩৭ বল খেলে ৩৮০ রান, ৩৮টি চার আর ১১টি ছয়। ম্যাথু হেইডেনের ব্যাটিং তাণ্ডবের বিস্তারিত জানলেন। জিম্বাবুয়ের বোলারদের দুর্গতির চিত্রটাই বা বাদ থাকবে কেন? হিথ স্ট্রিক ২৬-৬-১৩১-০, ব্লিগনট ২৮-৪-১১৫-০, আরভিন ৩১-৪-১৪৬-৪, প্রাইস ৩৬-৫-১৮৭-০, ট্রেভর গ্রিপার ২৫.৩-০-১৪২-২। ১৪৬ রানে ৪ উইকেট টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর সেরা বোলিং বলে আরভিন হয়তো রাজি হবেন না, কিন্তু বাকি সবাই কোনো জাদুমন্ত্রবলে রেকর্ড বুক থেকে এই বোলিং ফিগার মুছে দিতে পারলে বাঁচেন। ও হ্যাঁ, আরভিনের দলে আর একজন আছেন। ট্রেভর গ্রিপার। শেষ পর্যন্ত এই পার্টটাইম অফ স্পিনারই যে আউট করেছেন হেইডেনকে। 

কাউন্টি ক্রিকেটের এক ম্যাচে তাঁর এক ওভারের ছয় বলেই ছক্কা মেরে গ্যারি সোবার্স রেকর্ড গড়ার পর বোলার ম্যালকম ন্যাশ বলেছিলেন, ‘সমস্যা কী! রেকর্ড বুকে তো সোবার্সের সঙ্গে আমার নামও থাকবে।’ট্রেভর গ্রিপারের প্রতিক্রিয়াটাও শোনাল সে রকম, ‘এমন একটি রেকর্ডের অংশ হতে পারাটা তো ভালোই। এটা ঠিক যে, প্রায় দু দিন মাঠে থাকতে হয়েছিল আমাদের। বলের পেছনে ছুটতে ছুটতে অবস্থা শোচনীয়ই হয়ে গিয়েছিল। তারপরও আমি বলব, ইতিহাসের অংশ তো হতে পেরেছি।’ 

অনুমিতভাবেই ট্রেভর গ্রিপারের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে স্মরণীয় উইকেটও এটি, ‘টেস্ট ক্রিকেটে আমি উইকেটই পেয়েছি ৫টা না ৬টা। তাই স্বাভাবিকভাবেই রেকর্ড ভেঙে দেওয়া হেইডেনের উইকেটটিই আমার কাছে সবচেয়ে স্মরণীয়। ওকে আউট করতে না পারলে হয়তো টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে চার শ-ও করে ফেলত ও। উইকেটটি পাওয়ার পর আমাদের পুরো দলেরই যে অনুভূতিটা হয়েছিল তা যতটা না আনন্দ, তার চেয়ে বেশি স্বস্তির।’

ইনজুরির কারণে অস্ট্রেলিয়া সফরে যেতে না পারা গ্রান্ট ফ্লাওয়ার হেসে বললেন, ‘ওখানে যে আমি ছিলাম না, এটিকে আমি আমার সৌভাগ্য বলেই মানি। তবে ওদের (জিম্বাবুইয়ান সতীর্থদের) জন্য আমার খারাপ লেগেছে।’

হেইডেনের ইনিংসের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ দিক বলতে গিয়ে বাকিদের মতো পাওয়ারের কথা বললেন গ্রিপারও। তবে হেইডেনের সোজা ব্যাটে বল মারার ব্যাপারটিও বিস্ময়ের ব্যাপার হয়ে আছে তাঁর কাছে, ‘আমাদের গেম প্ল্যান ছিল অফ স্টাম্পের একটু বাইরে বল করে ওকে কাট আর পুল খেলতে না দেওয়া। তাতেও লাভ হলো কই? হেইডেন তা বুঝতে পেরে সোজা সামনের দিকে মারতে শুরু করল।’

গ্রিপার ইতিহাসের অংশ হতে পেরে খুশি। তাই বলে সবাই তাঁর মতো ভাবেন না। যেমন গ্রান্ট ফ্লাওয়ার। ইনজুরির কারণে অস্ট্রেলিয়া সফরে যেতে পারেননি, টেলিভিশনে দেখেছেন খেলা, হেসে বললেন, ‘ওখানে যে আমি ছিলাম না, এটিকে আমি আমার সৌভাগ্য বলেই মানি। তবে ওদের (জিম্বাবুইয়ান সতীর্থদের) জন্য আমার খারাপ লেগেছে।’

অন্য কারণে খারাপ লাগার কথা শন আরভিন ও মার্ক ভারমিউলেনেরও। হেইডেনের রান যখন ৩৪০, লং অফে একটা ক্যাচ দিয়েছিলেন হেইডেন, ভারমিউলেন তা ফেলে দেন। দুঃখ দুঃখ গলায় আরভিন বললেন, ‘ওটা হতো আমার পঞ্চম উইকেট। টেস্ট ক্রিকেটে আমি ৫ উইকেট পাইনি বলে ওই মিসটা আরো বেশি খারাপ লেগেছে।’

ভারমিউলেনেরও নিশ্চয়ই খারাপ লেগেছে। তবে তাঁর কথা থেকে তা বোঝার উপায় নেই। ইনজুরির কারণে বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজে খেলতে পারছেন না এই ব্যাটসম্যান, তবে হারারে টেস্টের মতো বুলাওয়ে টেস্টেও মাঠে আসছেন প্রতিদিনই। দারুণ আমুদে ছেলে। কথা শুরু করার আগে একবার হাসেন, শেষ করার পর আরেকবার। হেইডেনের ইনিংসের কথা তুলতেই মুখে  হাসি, ‘ও যা করেছে, তা ব্যাটিং নয়, অন্য কিছু। একটি শট আমার এখনো মনে আছে। স্ট্রিকের গুড লেংথে পড়া বল ফ্রন্টফুটে গিয়ে লং অফের ওপর দিয়ে ছক্কা মেরে দিল ও। আমি তখন গালিতে ফিল্ডিং করছি, স্লিপ ফিল্ডারদের বললাম, ওকে তাড়াতাড়ি ফেরাতে না পারলে আজ খবর আছে।’

স্ট্রিকের মুখে তো আগেই শুনেছেন, হেইডেনকে তাড়াতাড়ি ফেরানোর কোনো সম্ভাবনাই জাগাতে পারেনি জিম্বাবুইয়ান বোলাররা। তবে ৩৪০ রানের মাথায় ভারমিউলেন ওই ক্যাচটি না ফেললে অন্তত রেকর্ডটি হয় না। সে কথা বলতে গিয়েও ভারমিউলেনের মুখে হাসি, ‘শুনুন, এই পৃথিবীর নিয়মই হলো, আপনি কিছু দেবেন, বিনিময়ে কিছু পাবেন। আমি হেইডেনকে রেকর্ডটি দিয়েছি, এক দিন তার কাছ থেকে তা কেড়েও নেব।’

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×