শততম টেস্ট জয়ের স্মৃতি হোক জ্বলে ওঠার জ্বালানি

উৎপল শুভ্র নির্বাচিত পাঠকের লেখা

মান্না চৌধুরী

২০ এপ্রিল ২০২১

শততম টেস্ট জয়ের স্মৃতি হোক জ্বলে ওঠার জ্বালানি

জয়ের স্মারক স্টাম্প হাতে মুশফিক আর মিরাজ। অভিনন্দন জানাতে ছুটে গেছেন ইমরুল কায়েস। ছবি: এএফপি

এখনো চোখে লেগে আছে শেষ দৃশ্যটা। রঙ্গনা হেরাথের করা ৫৮তম ওভারের পঞ্চম বলটা মিরাজ সুইপ করলেন স্কয়ার লেগে। দুইবার প্রান্ত বদল করেই উল্লাসে দুই হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে মিরাজ ছুটে গেলেন মুশফিকের দিকে। বাংলদেশের সাংবাদিকদের ছোটখাটো একটা দৌড় প্রতিযোগিতা হয়ে গেল, কে কার আগে পৌছাবেন মাঠে। চার বছর আগে কলম্বোর পি সারাভানামুত্তু স্টেডিয়ামে বাংলাদেশের শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের স্মৃতিচারণা।

কলম্বোর আকাশ টানা চার সন্ধ্যা ধরে কাঁদছে। দিনে আলো ছড়িয়ে রাতে বৃষ্টি। রোদে পোড়া মানুষগুলোকে স্বস্তি দিতেই হয়ত প্রকৃতির উপহার। ১৮ মার্চ (২০১৭ সাল) সন্ধ্যারাতেও হয়ে গেল এক পশলা। কিন্তু আমার কাছে এই বৃষ্টি স্বস্তির চেয়ে বেশি যন্ত্রণার! আজ রাতে অথবা কাল সকালে যদি অঝোর ধারায় কিংবা ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরে তাহলে তো আশা-স্বপ্নের সব শেষ! 

এমন চিন্তায় কলম্বোর উপকণ্ঠে পেহলিগোদায় ছিমছাম ডুপ্লেক্স বাড়ির একটি কক্ষে আমার ঘুম আসে না। পাশে শোয়া সহকর্মী সাংবাদিক আহবাব মোস্তফার অবশ্য মেঘ-বৃষ্টি-রোদ নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই! তিনি তাই নাক ডেকে ঘুমাচ্ছেন। আমার দু চোখ আর এক হয় না। কলম্বোর পি সারা ওভালের চারদিনের স্মৃতিই ভাসে শুধু। ভাসতে ভাসতে আনন্দ খেলা করে। আজ তাহলে কলম্বোয় লাল-সবুজ পতাকাটাই উড়বে? নিজেদের শততম টেস্ট জয়ের উৎসবে রঙিন হবে বাংলাদেশ?

সেই টেস্টে বাংলাদেশের জন্য এমন আনন্দের দৃশ্য এসেছে নিয়মিতই। ছবি: এএফপি

কল্পনায় সুখের ছবি আঁকতে আঁকতে একসময় ঘুমের ঘোরে আমিও। সকাল সাতটায় উঠে দেখি, আকাশ পরিষ্কারই আছে। আটটায় রুম থেকে বের হয়ে ধরলাম পি সারার পথ। প্রতিদিনের মতো আজও ভরসা বেবিট্যাক্সি। কাল রাতে বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। আজ সকালেও রোদের খেলা। ভাগ্য তাহলে আজ শুরু থেকেই আমাদের পক্ষে। সাকিব, মুশফিকরা বাকি কাজগুলো ঠিকঠাক করলেই তো হয়ে যায়। নিজেদের শততম টেস্টে জয় হবে বাংলাদেশের। 

সুখের ছবি আঁকতে গিয়ে ভয়ও হয়। কোন এক ঝড়ে না আবার উড়ে যায় চার দিনে যত্ন করে সাজানো স্বপ্নের বাগান! অতীতে ফিরে গেলে এমন বহু ঝড়ই বয়ে গেছে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে। ২০০৩ সালে পাকিস্তানের মুলতান অথবা আমাদের নারায়নগঞ্জের ফতুল্লার স্মৃতি তো এখনো উঁকি দিয়ে যায় মনে! ভয়ের চোরাস্রোত মনে করিয়ে দেয় সেসব টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসের কথা। যেখানে অনেক সুখের সকাল হারিয়েছে হতাশার বিকেলে। তবে একসময় এসব অলক্ষুণে চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসে মন বলে, আজ জিতে যাবে বাংলাদেশ। দূরের কলম্বোয় উদিত হবে লাল-সবুজ ক্রিকেটের নতুন সূর্য। 

বাংলাদেশের শততম টেস্ট কাভার করতে দেশ থেকে শ্রীলঙ্কায় উড়ে গেছেন অনেক সাংবাদিক। লেখায়, কথায় যারা ক্রীড়া সাংবাদিকতার শিল্পিত রূপ তুলে ধরেন মানুষের মাঝে। তাঁরা সবাই পেশাদার ক্রীড়া সাংবাদিক। তাঁদের পাশে আমি এক অপেশাদার! মানে শৌখিন সাংবাদিক। আবেগের ভেলায় ভেসে, শখ আর নেশা এক হয়ে আমায় নিয়ে গেছে দূরের লঙ্কায়! নিজের জমানো টাকা খরচ করার বিলাসিতায় ইতিহাসের সাক্ষী হওয়া।

কলম্বোর পি সারা ওভালের প্রেসবক্স অত আধুনিক নয়। মোটামুটি মানের টেবিলের সঙ্গে সাংবাদিকদের জন্য প্লাস্টিকের চেয়ার! তবে এদিকে আজ নজর দেয়ার সময় কোথায়? বাংলাদেশের সাংবাদিকদের চোখ যে কেবলই সামনের সবুজ গালিচায়। যেখানে রচিত হতে পারে লাল-সবুজের ক্রিকেট ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়। প্রেসবক্সে আমি বসেছি একসময় যাঁকে নিয়ে কল্পনায় ছবি আঁকতাম, যাঁর লেখা অবাক বিস্ময়ে পড়তাম এবং আজও পড়ি, সেই পবিত্র কুন্ডু দাদার পাশে! প্রথমদিন হাত-পা কাঁপলেও সময় যত গড়িয়েছে, দাদার ভালোবাসায় স্বাভাবিক হয়েছি। অন্য সবাই টেস্টের শেষদিনে এসে ম্যাচের ভাগ্য নিয়ে মহা টেনশনে। পবিত্র দাদা দেখি নির্ভার। দেখে মনে হয় তিনি জানেন, আজ কী হবে!

বাংলাদেশের সফল রান তাড়ায় বড় অবদান ছিল তামিমের ৮২ রানের ইনিংসের। ছবি: এএফপি

শেষ দিনের রোমাঞ্চ কিছুটা হলেও জমিয়ে রেখেছেন দিলরুয়ান পেরেরা আর সুরঙ্গা লাকমল। আজ বাংলাদেশের কাজ তাই শুরুতেই দারুণ দুটি বল। কিন্তু শ্রীলঙ্কার লেজের দিকের দুই ব্যাটসম্যান যেন দুনিয়ার সমস্ত ধৈর্যশক্তি নিয়েই পি সারার উইকেটে! ধৈর্যের সঙ্গে সাহস মিলে স্বাগতিকরা ম্যাচে এগোচ্ছে আর আমরা পেছাচ্ছি। প্রেসবক্সে এই কদিন হাসিখুশি মুখগুলোতে দেখি রাজ্যের হতাশা। তবে কি হাতের মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে আরেকটি টেস্ট ম্যাচ? এরই মাঝে ফিফটি পূর্ণ করে আমাদের যন্ত্রণা বাড়িয়েছেন দিলরুয়ান। আগের দিন ১২৬ বল খেলে ২৬ রানে অপরাজিত ব্যাটসম্যান আজও বাংলাদেশের পথের কাঁটা! এমন কাঁটা সরাতে সাকিবের ঘূর্ণি কিংবা মোস্তাফিজের কাটারেই শুধু কাজ হয় না, ভাগ্যের সহায়তা লাগে। সেই ভাগ্যদেবী হঠাৎ করেই বাংলাদেশের পক্ষে। মিরাজের বল লেগের দিকে খেলেছেন দিলরুয়ান পেরেরা। মিস ফিল্ডিং করলেন শুভাশীষ। রান নিতে দৌড় দিলেন লঙ্কানদের দিল জিতে নেয়া দিলরুয়ান আর লাকমল। কিন্তু ভুল শুধরে বলটি কীভাবে যেন নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে থ্রো করলেন শুভাশীষ। দিলরুয়ান পৌঁছার আগেই স্টাম্প ভেঙে দিলেন মেহেদী হাসান মিরাজ! বাংলাদেশ শিবিরে বাধার দেয়াল ভাঙার স্বস্তি! এভাবে আউট না হলে দিলরুয়ান আউট হতেন বলে মনে হয় না। তাঁর এবং শ্রীলঙ্কার হতে যাওয়া দিনটাকে বাংলাদেশের দিকে ঘুরিয়ে দিল দুই অক্ষরের একটি শব্দ। ভাগ্য!

বাকি কাজ করেছেন বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা। অল্পতে দুই উইকেট হারিয়ে ফেলায় অবশ্য ফিরে এসেছিল পুরোনো দিনের স্মৃতি। কিন্তু কলম্বো টেস্টের ভাগ্য যেন আগেই লেখা হয়ে গেছে, যেখানে বিজয়ী দলের নাম বাংলাদেশ। তাই লাকমলের গতির ঝড়, রঙ্গনা হেরাথের স্পিন-বিষের সামনেও সাবলীল থাকে তামিম, মোসাদ্দেকদের ব্যাট। জয়সূচক রানটা অবশ্য এসেছে মেহেদী হাসান মিরাজের ব্যাট থেকে। শততম টেস্টে জয়ের চেয়েও বেশি কিছু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম টেস্ট জয়। তা-ও এই জয় ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে নয়, শ্রীলঙ্কার মাটিতে।

এখনো চোখে লেগে আছে শেষ দৃশ্যটা। রঙ্গনা হেরাথের করা ৫৮তম ওভারের পঞ্চম বল মিরাজ সুইপ করলেন স্কয়ার লেগে। যতটুকু গেছে বল, তিন রান হতে পারত। কিন্তু জয়ের জন্য বাংলাদেশের দরকার দুই রান। দুইবার প্রান্ত বদল করেই উল্লাসে দুই হাত আকাশের দিকে উঠিয়ে মিরাজ ছুটে গেলেন মুশফিকের উদ্দেশে। বাইশ গজের মাঝামাঝি অধিনায়কের আলিঙ্গনে বাঁধা পড়লেন তরুণ অলরাউন্ডার। ওদিকে সাকিব-সৌম্যদের আটকায় কে? উসাইন বোল্টের গতিতে তাঁরাও ছুটে এলেন মাঠে! প্রেসবক্স থেকে ছুটে গেলাম আমরাও। বাংলদেশের সাংবাদিকদের ছোটখাটো একটা দৌড় প্রতিযোগিতা হয়ে গেল! কে কার আগে পৌছাবেন মাঠে। এ যেন আবেগের নদীতে ভালোবাসার ঢেউ। পাঁচদিনের ক্রিকেটে এমন ঢেউ যে খুব কমই উঠতে দেখেছেন পবিত্র কুন্ডু, শামীম চৌধুরী, মহিউদ্দিন পলাশরা। তাই আগে ঐতিহাসিক জয় উদযাপন, পরে লেখালেখি! 

বাঁধিয়ে রাখার মতো এক ছবি। শততম টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ের পর বাংলাদেশ দল। ছবি: এএফপি

চার বছর পর আবারও টেস্ট খেলতে শ্রীলঙ্কায় বাংলাদেশ। করোনাকালে অচেনা এক সফর। বারবার কোভিড টেস্ট, কোয়ারেন্টিনের মতো যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়েই বুধবার প্রথম টেস্ট খেলতে নামবে বাংলাদেশ। এমন পরিস্থিতিতে বেশি কিছু আশা করাটাই হয়তো বোকামি। তবে এটা নিশ্চিত করেই বলা যায়, ক্যান্ডিতে খেলতে নামার আগে তামিম, মুশফিক, মিরাজদের মাঝে ফিরে ফিরে আসছে ২০১৭ সালের পি সারার স্মৃতি। টুকরো টুকরো সুখের স্মৃতি হয়ে ভাসছে হয়তো সেই শেষের দৃশ্য, তামিমের দুর্দান্ত ৮২, মোসাদ্দেকের ভয়ডরহীন ব্যাটিং। দৃশ্যগুলো অনুপ্রেরণার আলো হয়ে জ্বলে থাকুক মুশফিকদের ব্যাটে, মিরাজদের বোলিংয়ে। 

শুভ কামনা বাংলাদেশ! 

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×