`আমার পারফরম্যান্স কারও সঙ্গে সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে না`

ওয়াসিম আকরামের একান্ত সাক্ষাৎকার

উৎপল শুভ্র

১৭ এপ্রিল ২০২১

`আমার পারফরম্যান্স কারও সঙ্গে সম্পর্কের ওপর নির্ভর করে না`

ওয়াসিম আকরাম। ছবি: পোপারফটো

১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরে কলম্বোতে যখন ওয়াসিম আকরামের এই ইন্টারভিউ করি, বলতে গেলে তখন তিনি পাকিস্তান দলে একঘরে। মাঠের বাইরে বাকি দল একদিকে, আর তিনি স্ত্রী হুমাকে নিয়ে আলাদা ঘুরে বেড়ান। কিছুদিন আগেই ওয়াকার ইউনিসের নেতৃত্বে খেলোয়াড়-বিদ্রোহে অধিনায়কত্ব হারিয়েছেন। সেই ক্ষত তখনো দগদগে। ইন্টারভিউটায় সেই সময়ের ওয়াসিম আকরাম ধরা পড়েছেন, তাঁর উঠে আসায় ইমরান-মিয়াঁদাদের ভূমিকাও।

প্রথম প্রকাশ: সেপ্টেম্বর ১৯৯৪। ভোরের কাগজ।

উৎপল শুভ্র: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রায় এক দশক কাটিয়ে ফেলার পর আপনার ক্যারিয়ার সম্পর্কে আপনার নিজের মূল্যায়নটা শুনতে চাইছি।

ওয়াসিম আকরাম: আমার তো মনে হয়, আমি ভালােই করছি। এখন পর্যন্ত যা করেছি, তাতে সন্তুষ্টই বলতে পারেন। তবে এ পর্যন্ত আসতে পারার কারণ হিসেবে বলব, আমি কখনোই ফাঁকি দিইনি। কারণ আমি সবসময়ই বিশ্বাস করে এসেছি, পরিশ্রম ছাড়া জীবনে কিছুই পাওয়া সম্ভব নয়। আমি এটাও জানি, আমাকে আরও অনেক দূর যেতে হবে এবং সে জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যেতে হবে।

শুভ্র: ভালো তো করছেনই, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের অধিকাংশ খেলােয়াড়ের মতেই আপনি বিশ্বের এক নম্বর বােলার। এই স্বীকৃতিটা কেমন লাগে?

ওয়াসিম আকরাম: অবশ্যই খুব ভালাে লাগে। বিশ্বের নাম্বার ওয়ান বােলার হিসেবে যদি চিহ্নিত করা হয়, তাহলে নিশ্চয়ই এটা আনন্দের ব্যাপার। তবে নাম্বার ওয়ান হবার চেয়েও কঠিন হলাে নাম্বার ওয়ান হিসেবে টিকে থাকা। সে জন্য পরিশ্রম করে যেতে হবে আমাকে।

শুভ্র: আপনার ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ফিরে যাই। মনে পড়ে সেই দিনগুলাে?

ওয়াসিম আকরাম: শুরুটা অন্য দশজনের মতােই। খুব ছােট থাকতেই ক্রিকেটে ঝুঁকে পড়ি আমি, সম্ভবত সাত-আট বছর বয়সে। তারপর তাে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলা। তারপর একদিন এলাে সেই দিন, ডাক পেলাম পাকিস্তান দলে। 

শুভ্র: দুই রকম কথা শুনি বলে প্রশ্নটা করছি। আপনাকে আবিষ্কার করেছিলেন কে, ইমরান না মিয়াঁদাদ?

ওয়াসিম আকরাম: জাভেদ মিয়াঁদাদ। ১৯৮৪ সালে একদিন জাভেদ লাহােরে আমাকে একটা নেটে বল করতে দেখে। তারপরই আমি নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে খেলার সুযোগ পাই। জাভেদই তখন পাকিস্তানের অধিনায়ক। ইমরানের সঙ্গে আমার দেখা হয় আরও পরে, অস্ট্রেলিয়ায়।

শুভ্র: নেটে দেখার পর মিয়াঁদাদ কি কিছু বলেছিলেন আপনাকে?

ওয়াসিম আকরাম: তেমন কিছু নয়। 'ওয়েল বোল্ড, কিপ ইট আপ'–এ ধরনের কিছু।

ওয়াসিম আকরামকে আবিষ্কারের কৃতিত্বটা জাভেদ মিয়াঁদাদেরই পাওনা। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুভ্র: নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে বিসিসিপি প্যাট্রনস একাদশে সুযোগ পেলেন আপনি। ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেকেই ৫২ রানে ৭ উইকেট। এরপর নিউজিল্যান্ড ট্যুরে গিয়ে জীবনের দ্বিতীয় টেস্টেই ১০ উইকেট।

ওয়াসিম আকরাম: হ্যাঁ, ওই টেস্টটা ছিল ডানিডেনে। উইকেটে ঘাস ছিল, তাই দারুণ এনজয় করেছি বােলিং করে। সে টেস্টের দুই ইনিংসেই পাঁচটি করে উইকেট নিয়েছিলাম আমি।

শুভ্র: প্রথম যখন ডাক পেলেন পাকিস্তান দলে, সেই অনুভূতিটা মনে আছে নিশ্চয়ই।

ওয়াসিম আকরাম: এটা ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। আমি ভাবিইনি, এত তাড়াতাড়ি সুযােগ পাব। খুশি তো হয়েছিলামই। তবে খুশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিস্মিতও হয়েছিলাম।

শুভ্র: আপনার ক্যারিয়ারে ইমরানের ভূমিকা কতটুকু?

ওয়াসিম আকরাম: অনেক। ইমরান এবং মিয়াঁদাদ, দুজনের কাছেই আমি ঋণী। তাঁদের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। মাঠে যেমন, তেমনি মাঠের বাইরেও। আমি পাকিস্তান দলে আসার পর সব সময়ই সাহায্য করেছেন তাঁরা। ইমরান সবসময়ই আমার সাফল্যে গর্ব অনুভব করতেন। তিনি ছিলেন আমার বড় ভাইয়ের মতাে, একই সঙ্গে আদর্শও। ইমরান-মিয়াঁদাদ ছাড়া মুদাসসর নজরের কাছ থেকেও ক্রিকেট সম্পর্কে অনেক শিখেছি আমি ।

শুভ্র: এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনার সবচেয়ে স্মরণীয় পারফরম্যান্স কোনটি?

ওয়াসিম আকরাম: বিশ্বকাপ জেতাটা আমার খেলােয়াড়ি জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। নিজের পারফরম্যান্সের দিক থেকেও স্মরণীয় হয়ে আছে বিশ্বকাপ ফাইনাল, যেখানে ব্যাটিং এবং বােলিং দুটোই ভালাে করেছিলাম আমি। একই রকম লর্ডস টেস্টও স্মরণীয় হয়ে আছে ব্যাটিং ও বোলিং দু কারণেই। অ্যাডিলেডে জীবনের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরিটিও স্মরণীয়। আসলে ১৯৮৯ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ওই সিরিজটাই এখন পর্যন্ত আমার সেরা সিরিজ। এছাড়া ভুলতে পারব না ব্যাঙ্গালোর টেস্ট (১৯৮৭-এর ভারত সফরে), সে টেস্ট জিতেই ভারত থেকে টেস্ট সিরিজ নিয়ে ফিরেছিলাম আমরা।

শুভ্র: বিশ্বকাপ ফাইনালে যে দুটি বলে আউট করেছিলেন অ্যালান ল্যাম্ব ও ক্রিস লুইসকে, তা নিশ্চয়ই খুব মধুর স্মৃতি আপনার জন্য।

ওয়াসিম আকরাম: আমি কোনােদিন তা ভুলতে পারব না। কারণ এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় স্মৃতি। তবে ওটাতেই তৃপ্ত নই আমি। জিততে চাই আগামী বিশ্বকাপও।

এই মুহূর্তে স্টিভ ওয়াহ আমার চেয়ে ভালো অলরাউন্ডার। তাঁর ব্যাটিং ও বােলিং দুটোই ভালো। তবে আমি আশা করছি আগামী বছরের মধ্যেই আমি ব্যাটিংয়ে অনেক উন্নতি করতে পারব।

শুভ্র: অ্যাডিলেড টেস্টে আপনি ইমরানের সঙ্গে জুটি বেঁধে টেস্ট বাঁচিয়েছিলেন এবং খেলেছিলেন একটি ড্রিম ইনিংস (দুজনের জুটিতে ১৯১ রান, সেঞ্চুরি করেছিলেন দুজনই। ওয়াসিম আকরাম করেছিলেন ১২৩)। কিন্তু এরপর আপনি আপনার ব্যাটিং প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেছেন বলে মনে হয় না।

ওয়াসিম আকরাম: আমিও তা স্বীকার করছি। তবে এর কারণটা হলো, আমাকে বােলিংয়ে অনেক বেশি কনসেনট্রেট করতে হয়েছে। এ কারণেই একটু অবহেলিত থেকে গেছে ব্যাটিংটা। অ্যাডিলেডের ওই ইনিংসটা সত্যিই আমার ড্রিম ইনিংস। আমি এ ধরনের ইনিংস খেলতে চাই আরও নিয়মিতভাবে। সে জন্য ব্যাটিংয়ের পেছনে আরও খাটতে হবে আমাকে।

শুভ্র: বছর দুয়েক আগে এক ইন্টারভিউয়ে বলেছিলেন, বিশ্বের এক নম্বর অলরাউন্ডার হওয়াটা আপনার লক্ষ্য। বর্তমানে এ ব্যাপারে আপনার প্রতিদ্বন্দ্বী সম্ভবত অস্ট্রেলিয়ার স্টিভ ওয়াহ। আপনি কী মনে করেন?

ওয়াসিম আকরাম: এই মুহূর্তে স্টিভ ওয়াহ আমার চেয়ে ভালো অলরাউন্ডার। তাঁর ব্যাটিং ও বােলিং দুটোই ভালো। তবে আমি আশা করছি আগামী বছরের মধ্যেই আমি ব্যাটিংয়ে অনেক উন্নতি করতে পারব।

অলরাউন্ডার স্টিভ ওয়াহর প্রতি ওয়াসিমের ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। ওয়ানডেতে সেরা অলরাউন্ডার হওয়া নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও ছিল তখন। ছবি: অলস্পোর্ট

শুভ্র: কিন্তু স্টিভ ওয়াহর বোলিং তো আবার আপনার মতো বিধ্বংসী নয়।

ওয়াসিম আকরাম: তা হয়তো নয়। তবে ওয়ানডেতে ও আমার চেয়ে ভালাে অলরাউন্ডার। দেখা যাক, আমি এখন ব্যাটিংয়ের পেছনে পরিশ্রম করছি।

শুভ্র: বর্তমানে ওয়ানডেতে সবচেয়ে বেশি উইকেট আপনার। এই রেকর্ডটি কিভাবে দেখেন?

ওয়াসিম আকরাম: একজন পাকিস্তানি এই রেকর্ডটির মালিক, এটা ভেবে আমি খুব গর্ব অনুভব করি।

শুভ্র: টেস্টেও সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ডটি অর্জনের স্বপ্ন আছে?

ওয়াসিম আকরাম: টেস্টের কথা এখনই বলা সম্ভব নয়। এজন্য এখনও আমাকে অনেক দূর যেতে হবে। আমি ওই রেকর্ডের মাত্র অর্ধেক পথে আছি। তবে এটুকু বলতে পারি, টেস্ট রেকর্ডটি পেলে ওয়ানডের চেয়েও বেশি আনন্দ পাব। (ওয়াসিম আকরামের তখন ৫৫ টেস্টে ২৩৫ উইকেট। টেস্টে সবচেয়ে বেশি উইকেটের রেকর্ড তখন কপিল দেবের ৪৩৪)।

শুভ্র: এ পর্যন্ত যাঁদের বিপক্ষে বল করেছেন, তাঁদের মধ্যে একজনকে যদি সেরা বলে বেছে নিতে বলি, তাহলে কার কথা বলবেন?

ওয়াসিম আকরাম: একজনকে বেছে নেওয়া কঠিন। বেশ কজনই আছেন। ব্রায়ান লারা খুব ভালাে ব্যাটসম্যান। মার্টিন ক্রো তাে ভালােই, মাইক আথারটনও ভালাে। আসলে বর্তমানে বিশ্ব ক্রিকেটে ভালাে ব্যাটসম্যান আছেন বেশ কয়েকজনই।

শুভ্র: তা তো আমিও জানি। এদের মধ্যে আপনি কাকে বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানের মর্যাদা দেন?

ওয়াসিম আকরাম: এটা বলা খুব কঠিন। তবে পারফরম্যান্স বিবেচনায় নিলে ব্রায়ান লারাই সেরা।

শুভ্র: ছেলেমানুষী প্রশ্ন, তারপরও করছি, যখন কোনো ব্যাটসম্যান আপনাকে চার বা ছয় মারে, তখন কেমন লাগে? যদিও আপনার ক্ষেত্রে খুব বেশি এমন ঘটে না।

ওয়াসিম আকরাম: এটা যে কোনাে বােলারের ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। এতে আমি মাইন্ড করি না। অবশ্যই রাগ হয় আমার। কিন্তু এটা মেনে নিতেই হবে। বােলিং করতে গেলে যে কোনাে সময় মার খেতে পারি, এটা তাে জানা কথাই।

ইমরান, জাভেদ, গাভাস্কার সব বড় প্লেয়াররাই চাপের মধ্যে ভালাে খেলেছেন। আমি মনে করি, এটাই গ্রেটনেসের লক্ষণ। আমিও এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বরং এখন আমি চাপের মধ্যে খেলাটা আরও এনজয় করি, একটু্ও চাপ অনুভব করি না।

শুভ্র: আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখার পর থেকে অনেক কমপ্লিমেন্টই পেয়েছেন আপনি। সবচেয়ে স্মরণীয় কোনটি?

ওয়াসিম আকরাম: এই মুহূর্তে ঠিক মনে পড়ছে না। তবে মানুষ যে বলে, চাপের মধ্যে আমি ভালো খেলি, এতে খুব ভালাে লাগে আমার। ভবিষ্যতেও চাপের মধ্যে একই রকম ভালাে খেলে যেতে চাই।

শুভ্র: চাপের মধ্যে নিয়মিত ভালো খেলে যাওয়ার রহস্যটা কী?

ওয়াসিম আকরাম: এটা আমি আস্তে আস্তে শিখেছি। এ ব্যাপারেও আমি ইমরান ও জাভেদের কাছে ঋণী। তাঁরাও সবসময় চাপের মধ্যে ভালাে খেলেছেন। ধীরে ধীরে আমিও বলতে পারেন এতে অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বরং এখন আমি চাপের মধ্যে খেলাটা আরও এনজয় করি, একটুও চাপ অনুভব করি না। যেমন স্লগ ওভারে বােলিং করতে করতে এত অভ্যস্ত হয়ে গেছি যে, এখন আর একটুও ভিন্ন কিছু মনে হয় না। ইমরান, জাভেদ, গাভাস্কার সব বড় প্লেয়াররাই চাপের মধ্যে ভালাে খেলেছেন। আমি মনে করি, এটাই গ্রেটনেসের লক্ষণ।

শুভ্র: শুরুর সময় আপনি ছিলেন 'যত জোরে সম্ভব' বল করার চেষ্টা করা এক ফাস্ট বােলার। এরপর আপনি কমিয়ে দিয়েছেন রান আপ এবং আগের মতাে গতিতে বলও করছেন না। তাে যখন মানুষ বলে, ওয়াকার বিশ্বের দ্রুততম বােলার, ডােনাল্ড সাদাদের মধ্যে দ্রুততম, আপনার কি কখনাে মনে হয়, একটা চেষ্টা করে দেখি, কারণ আপনারও ক্ষমতা আছে যে কারও গতিতে বল করার।

ওয়াসিম আকরাম: এটা আমার কখনােই মনে হয় না। যখন আমি দ্রুততম না হয়েই নিয়মিত উইকেট পাচ্ছি, তখন এ নিয়ে ভাবব কেন? আমি ফাস্ট বল করি, ওয়াকার আমার চেয়েও বেশি গতিতে বল করে। সে বিশ্বের দ্রুততম বােলার, এই স্বীকৃতি আপনি ওর কাছ থেকে কেড়ে নিতে পারেন না। তবে যত দিন আমি উইকেট পেয়ে যাচ্ছি, কে কত গতিতে বল করল, এ নিয়ে আমার কোনাে মাথাব্যথা নেই।

শুভ্র: শুরুতে সব পেস বােলারেরই একটা প্রবণতা থাকে যত জোরে সম্ভব বল করার। বিশ্বের দ্রুততম হতে হবে, এ ধরনের কোনাে লক্ষ্য কি কখনাে ছিল আপনার?

ওয়াসিম আকরাম: না, না, কখনােই না। আমি হতে চেয়েছি ভালাে বােলার, খুব ভালাে বােলার। আমি ধারাবাহিকভাবে ভালাে খেলে যেতে চেয়েছি এবং বিশ্বাস করি এখন পর্যন্ত তা করে যাচ্ছি।

শুভ্র: ওয়াকারের সঙ্গে বােলিং করতে কেমন লাগে?

ওয়াসিম আকরাম : গ্রেট ফান।

শুভ্র: বিতর্কিত এক ঘটনায় (সহ-খেলোয়াড়দের বিদ্রোহে) আপনি ক্যাপ্টেনসি হারিয়েছেন। সে কথা মনে পড়লে এখনও আপনি যন্ত্রণা পান?

ওয়াসিম আকরাম : না, এখন আর পাই না। যখন এটা ঘটলাে, তখন খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম । কিন্তু সময় সব কিছুই হালকা করে দেয়। এখন আর ওসব নিয়ে ভাবতেই চাই না। সব কিছুই স্বাভাবিক হয়ে এসেছে এখন।

শুভ্র: টিমমেটদের সঙ্গে এখন আপনার সম্পর্ক কেমন, বিশেষ করে ওয়াকারের সঙ্গে?

ওয়াসিম আকরাম : হ্যাঁ, আমি ওদের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেছি। বেশ কিছুদিন আমি কথা বলিনি কারাে সঙ্গে। এখন সবার সঙ্গেই সম্পর্ক ভালাে হচ্ছে ক্রমশ।

দুই ডব্লিউ! দুজনের সম্পর্কে অনেক টানাপড়েন ছিল, সেটাই হয়তো সেরাটা বের করে আনত দুজনের কাছ থেকেই। ছবি: পোপারফটো

শুভ্র: এত কিছু ঘটে গেল, কিন্তু আপনার পারফরম্যান্সে তার কোনাে প্রভাব পড়েনি। এটা অবিশ্বাস্য মনে হয় আমার কাছে।

ওয়াসিম আকরাম: আমার নিজের পারফরম্যান্সের সঙ্গে এসবের সম্পর্ক নেই। দেশের পক্ষে খেলাটাকে আমি সবচেয়ে বড় মনে করি। ওই ঘটনার পর আমি খেলাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী, আমার পরিবার আমাকে খেলে যেতে পরামর্শ দেয়। কারও সঙ্গে সম্পর্ক ভালো কি খারাপ, এটার ওপর আমার পারফরম্যান্স নির্ভর করে না। পাকিস্তানের জন্য আমি সবসময়ই হান্ড্রেড পার্সেন্ট দিয়ে যাব, এটাই আমার লক্ষ্য।

শুভ্র: আপনি বর্তমানে বিশ্ব ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় তারকাদের একজন। এই তারকাখ্যাতি কতটা এনজয় করেন?

ওয়াসিম আকরাম: অবশ্যই এনজয় করি। তবে তারকাখ্যাতির একটা চাপও আছে। তার সঙ্গে মানিয়ে নেয়াটাও জানতে হয়।

শুভ্র: পাকিস্তানের রাস্তায় ফ্রি-লি ঘুরে বেড়াতে পারেন আপনি?

ওয়াসিম আকরাম: তেমন কোনো সমস্যা হয় না। মাঝে মধ্যেই তো বেরোই। লোকজন এগিয়ে আসে, কথা বলে। কেউ বা উইশ করে। আমার তো ভালোই লাগে।

শুভ্র: এই যে আপনি বিশ্ব জুড়ে এত জনপ্রিয়, এই জনপ্রিয়তা সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গিটা কী?

ওয়াসিম আকরাম: আমি মনে করি, জনপ্রিয়তা সরাসরি আপনার পারফরম্যান্সের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখানে (শ্রীলঙ্কায়) আমরা ভালো বল করেছি। ওয়াকার ভালো বল করেছে, আমি ভালো বল করেছি, তাই আমরা এখানে খুব জনপ্রিয়। তবে জনপ্রিয়তা খানিকটা নির্ভর করে লোকজনের সঙ্গে ব্যবহারের ওপরও। নিজের কথাই বলি, অনেক সময় অনেক কিছুই বিরক্তিকর লাগে। কিন্তু তারপরও সহ্য করতে হয়, হাসতে হয় কৃত্রিমভাবে হলেও।

শুভ্র: এই উপমহাদেশের দুই সেরা পেস বোলার ইমরান ও কপিলকে যে ভাবে খেলা ছাড়তে হলো, তাতে আপনি দুঃখ পাননি?

ওয়াসিম আকরাম: হ্যাঁ, নিশ্চয়ই দুঃখ পেয়েছি। তবে একদিন সবাইকে যেতে হবে। আমাকেও যেতে হবে। তবে আশা করি, ভালো খেলছি এমন অবস্থাতেই বিদায় নিতে পারব আমি। শুধু কোনােমতে খেলে যাওয়ার কোনাে ইচ্ছে আমার নেই।

শুভ্র: আপনার আদর্শ অবসরের আইডিয়াটা কী?

ওয়াসিম আকরাম: যখন দেখব আমি আর আগের মতো ফাস্ট বল করতে পারছি না; শরীর বলছে, এখন আর পারি না, তখনই অবসর নেব আমি।

শুভ্র: একজন পেশাদার আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারের জীবন দারুণ দ্রুত লয়ে বাঁধা। এখন খেলা হয় নন-স্টপ। কখনো কি মনে হয়, এর কারণে জীবনে অন্য অনেক কিছু হারাতে হচ্ছে?

ওয়াসিম আকরাম: না, আমি আমার এই জীবন নিয়েই সুখী। তা কিছুটা দ্রুত লয়ে বাঁধা তাে বটেই। এখন খেলা হয় অনেক বেশি, প্লেনেও কেটে যায় অনেক সময়। তারপরও আমি আমার টাইম নিয়ে সন্তুষ্ট। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার হওয়ায় অনেক কিছুই পেয়েছি, যা অন্য কোনোভাবে পেতে পারতাম না।

শুভ্র: এবার একটা স্পর্শকাতর ব্যাপারে প্রশ্ন করি । ইংলিশ পত্রপত্রিকাগুলাে সবসময়ই আপনাকে ও ওয়াকারকে বল ডক্টরিংয়ের দায়ে অভিযুক্ত করে এসেছে। তাে গত সামারে যখন ইংলিশ অধিনায়ক মাইকেল আথারটন হাতেনাতে ধরা পড়লেন ওই পকেটের ধুলােবালি দিয়ে বলে ঘষার কারণে, তখন নিশ্চয়ই একটা অট্টহাসি দিয়েছেন আপনি।

ওয়াসিম আকরাম: না, এসব ব্যাপার নিয়ে আমি একটুও মাথা ঘামাই না। যা কিছু ঘটেছে, এসব আমাকে একটুও স্পর্শ করেনি। কারণ আমি সংবাদপত্র পড়ি না। যতােদিন পর্যন্ত আমি ভালো খেলে যাব, এসব গল্পে কিছু আসে যায় না আমার।

পত্রিকাগুলো ব্যবসা করতে নেমেছে। তাদের তাে পত্রিকা বেচতে হবে। ওরা ওদের কাজ করবে, আমি এসব পাত্তা দিই না।

শুভ্র: কিন্তু মাইকেল আথারটনের ব্যাপারটি নিশ্চয়ই শুনেছেন আপনি।

ওয়াসিম আকরাম: হ্যাঁ, শুনেছি। কিন্তু আমি এটা সিরিয়াসলি নেইনি। এমনকি এরপরও কাগজ খুলে দেখার আগ্রহ বােধ করিনি। আমি সংবাদপত্র পড়ি না।

শুভ্র: ইংলিশ ট্যাবলয়েডগুলাে যখন ওয়াকার ও আপনার পেছনে লেগেছিল, তখন নিশ্চয়ই খারাপ লেগেছে।

ওয়াসিম আকরাম: তা তাে লেগেছেই। তবে আমি এ নিয়ে বেশিক্ষণ ভাবিনি। পত্রিকাগুলো ব্যবসা করতে নেমেছে। তাদের তাে পত্রিকা বেচতে হবে। ওরা ওদের কাজ করবে, আমি এসব পাত্তা দিই না।

শুভ্র: আপনি কখনােই সংবাদপত্র পড়েন না?

ওয়াসিম আকরাম: না, কখনোই না।

শুভ্র: কোনো ক্রিকেট আর্টিকেলও না?

ওয়াসিম আকরাম: মাঝে মধ্যে।

শুভ্র: আপনার প্রিয় কোনো ক্রিকেট লেখক আছে?

ওয়াসিম আকরাম: না। নির্দিষ্ট কেউ নেই।

শুভ্র: খেলা ছাড়ার পর আপনাকে কীভাবে মনে রাখা হােক বলে কামনা করেন আপনি।

ওয়াসিম আকরাম: আমি পরিচিত হতে চাই একজন পাকিস্তানি হিসেবে, যে তার দেশের জন্য সম্মান বয়ে এনেছে, যে সবসময় তার দেশের জন্য দিয়ে এসেছে হান্ড্রেড পার্সেন্ট।

শুভ্র: গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি নেয়ার সময় আপনি সাধারণত কার সঙ্গে আলোচনা করেন?

ওয়াসিম আকরাম: আমার পরিবার ও স্ত্রীর সঙ্গে। এখন পর্যন্ত তারা খুবই সাহায্যে এসেছে। আমি যে সিদ্ধান্তই নিয়েছি, সবসময় তারা পাশে থেকেছে।

শুভ্র: যেভাবে এগোচ্ছেন, কোথায় থামবেন?

ওয়াসিম আকরাম: আমি সেভাবে কিছু ভাবতে চাই না। এখন আমি ফর্মের তুঙ্গে আছি। এভাবেই খেলে যেতে চাই আরও চার-পাঁচ বছর। সাফল্য পেতে আসল ব্যাপারটা হলাে আত্মবিশ্বাস এবং বােলার হিসেবে এখন আমি অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। নির্দিষ্ট কোনাে লক্ষ্যের কথা না ভেবে যত বেশি সম্ভব উইকেট পেতে চাই আমি।

শুভ্র: অবসর নেয়ার আগে নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য নেই আপনার?

ওয়াসিম আকরাম: না, সেরকম কিছু নেই। যত দিন সম্ভব পাকিস্তানের পক্ষে ভালাে খেলে যেতে চাই।

আরও পড়ুন: ওয়াকার ইউনিসের একান্ত সাক্ষাৎকার

 
শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×