হারানো মুকুট ফিরে পেলেন রাজা

উৎপল শুভ্র

২৭ জানুয়ারি ২০২১

হারানো মুকুট ফিরে পেলেন রাজা

হারিয়ে ফেলা রেকর্ড পুনরুদ্ধারের সঙ্গে টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম কোয়াড্রুপল সেঞ্চুরি করার আনন্দে মাতোয়ারা ব্রায়ান লারা। অ্যান্টিগা, ২০০৪।

এক দলের সবাই মিলে ৪০০ রান করতে পারলেই যেখানে সেই দল বেশ খুশি থাকে, সেখানে একজন ব্যাটসম্যান একাই যদি ৪০০ রান করে ফেলেন! টেস্ট ক্রিকেট এর আগে কখনো এমন কিছু দেখেনি। `কোয়াড্রুপল সেঞ্চুরি` কথাটাও তাই ব্রায়ান লারার সৌজন্যে ক্রিকেট অভিধানে নতুন সংযোজন। মাহাত্ম্যটা তো এখানেই শেষ নয়। ছয় মাস আগে ম্যাথু হেইডেনের কাছে হারানো মুকুটও আবার মাথায় তুলে নিয়েছিলেন তো এর মাধ্যমেই।

প্রথম প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০০৪। প্রথম আলো।

একই মাঠ, একই প্রতিপক্ষ, শুধু মাঝখানে ১০ বছরের ব্যবধান। ইংল্যান্ডের বিপক্ষে অ্যান্টিগার সেন্ট জনসের রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডে টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটি আবারও হয়ে গেল ব্রায়ান লারার। পার্থক্য বলতে, প্রথমবার ভেঙেছিলেন স্যার গ্যারি সোবার্সের ৩৬ বছরের পুরনো রেকর্ড, আর এবার ছয় মাস আগে ম্যাথু হেইডেনের কাছে হারিয়ে ফেলা মুকুট পুনরুদ্ধার।

মাত্র ছয় মাস! ছয় মাসের মধ্যেই হারানো মুকুটটি আবারও ব্রায়ান লারার মাথায়। ৩৬ বছর টিকে থাকা স্যার গ্যারি সোবার্সের রেকর্ডটি ভেঙেছিলেন যে মাঠে, ১০ বছর পর সেন্ট জনসের সেই অ্যান্টিগা রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডেই টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্কোরের রেকর্ডটি আবার নতুন করে লিখলেন ব্রায়ান চার্লস লারা। সেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষেই।

তিনবার মুষ্টিযুদ্ধের বিশ্ব হেভিওয়েট শিরোপা হারিয়ে তিনবার তা পুনরুদ্ধার করেছিলেন মোহাম্মদ আলী। ব্রায়ান লারার বিশ্ব রেকর্ড পুনরুদ্ধার করাটা ছাড়িয়ে গেল সেই বিস্ময়কেও। হারানো রেকর্ডটা আবার নিজের করে নিয়েই থেমে যাননি। টেস্ট ক্রিকেটের নতুন এক দিগন্তও উন্মোচিত হয়েছে তাঁর ব্যাটে। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে করেছেন ৪০০ রান। তারপরও ইংল্যান্ডের কোনো বোলার থামাতে পারেননি তাঁকে। লাঞ্চের আধঘণ্টা পর নিজেই থামার সিদ্ধান্ত নিলেন ব্রায়ান লারা। ৫ উইকেটে ৭৫১ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্রথম ইনিংস ঘোষণা করলেন অধিনায়ক। অপরাজিত ৪০০ রান, ৭৭৬ মিনিট, ৫৮২ বল, ৪৩টি চার, ৪টি ছয়--টেস্ট ইতিহাসের নতুন এক দ্বার খুলে দিল এই পরিসংখ্যান। 

এর আগে যে শৃঙ্গে কারও পা পড়েনি। টেস্ট ইতিহাসে প্রথম কোনো ব্যাটসম্যানের ৪০০ রান করার ইতিহাসের নাম ব্রায়ান লারা

১০ বছর অনেক সময়। এই ১০ বছরে দেখেছেন অনেক উত্থান-পতন, সেদিনের সেই তরুণ ব্রায়ান লারার চেহারাতেও ছাপ ফেলেছে তা। সেই লারা আর এই লারায় পার্থক্য তো আছেই। কিন্তু ব্যাট আর হেলমেট পাশে রেখে উবু হয়ে যখন চুমু খেলেন উইকেটে, লাঞ্চের সময় দুই সারিতে দাঁড়ানো ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান খেলোয়াড়রা ব্যাট দিয়ে তোরণ বানিয়ে যখন ‘গার্ড অব অনার’ দিলেন ৩৯০ রানে অপরাজিত ব্রায়ান লারাকে, মনে হলো পুনঃভিনীত হচ্ছে ১০ বছর আগের দৃশ্যই। পার্থক্য একটাই, সেবার রেকর্ড ভাঙার পরপরই স্যার গ্যারি সোবার্স তাঁর উত্তরসূরিকে অভিনন্দন জানাতে ঢুকে গিয়েছিলেন মাঠে, কাল ম্যাথু হেইডেন ঢুকলেন না। ঢুকবেন কীভাবে, তিনি তো তখন অস্ট্রেলিয়ায়।

টেলিভিশনের পর্দায় নিশ্চয়ই তাঁর ছয় মাসের সাম্রাজ্যের হাতবদল হতে দেখেছেন ম্যাথু হেইডেন। গত অক্টোবরে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পার্থে ব্রায়ান লারার ৩৭৫ রানের রেকর্ডটি ভেঙে যখন ৩৮০ করলেন, হেইডেনের কল্পনাতেও ছিল না--যাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিলেন, মাত্র ছয় মাসের মধ্যেই মুকুটটা ফিরিয়ে দিতে হবে তাঁকেই। হেইডেনের কী দোষ! লাঞ্চের সময় যখন মাঠ থেকে বেরোচ্ছেন, ডেভিড গাওয়ারের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে লারা নিজেই তো স্বীকার করলেন, রেকর্ডটি হারানোর ছয়-সাত মাসের মধ্যেই আবার তা ফিরে পাবেন, এটি তিনি একদমই ভাবেননি। কোনো দিনই আর ফিরে পাবেন না, এটি ভাবাই তো স্বাভাবিক। এর আগে কেউই তো কোনো দিন পাননি।

দশ বছর আগে একই মাঠে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে সবার দেখা দৃশ্যটাই পুনরাভিনীত হলো আবার। সেবার ৩৭৫, এবার ৪০০

এক টুকরো ইতিহাস গড়ে ফেলেছিলেন গত পরশুই। ক্রিকেট-অমরত্ব নিশ্চিত করে ফেলেছেন অনেক আগেই, তাতে নতুন মাত্রা যোগ হলো আরেকটি ট্রিপল সেঞ্চুরিতে। এত দিন টেস্ট ক্রিকেটে দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরি ছিল শুধু একজনেরই। এক এবং অদ্বিতীয় স্যার ডন ব্র্যাডম্যানের সেই কীর্তির পাশে বসেও তৃপ্ত হননি লারা। গত পরশু দিনশেষে ৩১৩ রানে অপরাজিত, হেইডেনের রেকর্ড ভাঙতে তখনো প্রয়োজন ৬৮ রান। তখনই বলে দিয়েছিলেন, বিশ্ব রেকর্ডটাকে একদমই দূরের বলে মনে হচ্ছে না, সেটি তাঁর হাতে ওঠারই অপেক্ষায়। রাতে ভালো একটা ঘুম দেবেন, সকালে উঠে ভাববেন ১০ বছর আগের সেই ইনিংসের কথা।

সিরিজের শুরুতেই কথায় কথায় বলেছিলেন, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে যেমন প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫০০ করেছেন, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ৪০০ করাটাও তাঁর লক্ষ্যের তালিকায় আছে।

কাল লাঞ্চের আগেই ফিরে পেলেন হারানো সাম্রাজ্য। ব্রায়ান লারার ব্যাটিংয়ে সব সময়ই দৃশ্যমান অসম্ভবকে সম্ভব করার একটা প্রতিজ্ঞা, তাঁর মতো করে সবকিছু করার দুরন্ত এক দুঃসাহস। এখানেও তার ব্যতিক্রম হবে কেন? বিশ্ব রেকর্ডটা তো যেন-তেনভাবে ভাঙতে পারেন না! হেইডেনকে ছুঁলেন তাই অফ স্পিনার গ্যারেথ ব্যাটির বলে বিশাল এক ছক্কা মেরে। ৩৭৪ থেকে ৩৮০। পরের বলে সুইপ করে চার। ‘কিং অব অল রেকর্ডস’ আবারও এসে লুটিয়ে পড়ল ব্রায়ান লারার পায়ে। অদ্ভুত এক আঁধারের মধ্য দিয়ে যেতে থাকা ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ হেসে উঠল একসঙ্গে। অ্যান্টিগার প্রধানমন্ত্রী মাঠে ঢুকে আলিঙ্গনে বাঁধলেন লারাকে। ইংল্যান্ডের খেলোয়াড়েরা এমনভাবে ঘিরে দাঁড়ালেন, যেন ব্রায়ান লারা তাঁদেরই একজন। ইতিহাসের সাক্ষী হওয়ার গৌরবটাও তো কম নয়!

এই সিরিজের শুরুতেই কথায় কথায় বলেছিলেন, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে যেমন প্রথম ব্যাটসম্যান হিসেবে ৫০০ করেছেন, টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম ৪০০ করাটাও তাঁর লক্ষ্যের তালিকায় আছে। অথচ সিরিজের প্রথম ৬ ইনিংস মিলিয়ে তাঁর ব্যাট থেকে এসেছে মাত্র ১০০ রান। ডুবতে হয়েছে টেস্ট ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো পরপর দুই ইনিংসে শূন্য রানে আউট হওয়ার লজ্জাতেও। এই সিরিজেই ৪৭ রানে অলআউট হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ, আগের টেস্টেই একটি ইনিংস শেষ হয়েছে ৯৪ রানে। ৩৬ বছর পর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে দেশের মাটিতে টেস্ট সিরিজ হেরেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অধিনায়ক ব্রায়ান লারাকে ক্ষত-বিক্ষত করেছে সমালোচকদের ধারালো ছুরি। দল হারছে, নিজের ব্যাটে রান নেই-অতীতে আরও অনেকবারের মতো ‘ব্রায়ান লারা শেষ’ এমন একটা রবও জোরালো হচ্ছিল ক্রমশই।

৬ ইনিংসে ১০০ রানের পর এক ইনিংসেই অপরাজিত ৪০০-জিনিয়াসদের নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলার বিপদটাও কি সবাইকে আবার মনে করিয়ে দিলেন না লারা?

সম্পর্কিত বিষয়:

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×