‘আই গট সাম স্মেল`

উৎপল শুভ্র

১১ এপ্রিল ২০২১

‘আই গট সাম স্মেল`

সেলিম মালিক: কলম্বোর লংকা ওবেরয়ে তাঁর হোটেল রুমে ১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বরের ওই দিনটির কথা এখনো মনে পড়ে

তখন মাত্রই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাভার করতে শুরু করেছি। আমার চোখে ক্রিকেট তখন মহান এক খেলা, ক্রিকেটাররা প্রায় দেবদূত পর্যায়ের। ১৯৯৪ সালে শ্রীলঙ্কায় সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ কাভার করতে গিয়ে প্রথম শুনেছিলাম এই খেলাটার কদর্য এক দিকের কথা। শুনেছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস করিনি। পরে যখন জেনেছি, অনেক কিছুরই শুরু ওই টুর্নামেন্টে, তখন বারবার কানে বাজতে শুরু করেছে ভারতের বন্ধু সাংবাদিক রবিন চ্যাটার্জির ওই কথাটা, `আই গট সাম স্মেল`।

প্রথম প্রকাশ: ১ আগস্ট ১৯৯৯। প্রথম আলাে।

ইদানীং রবিন চ্যাটার্জিকে বড় বেশি মনে পড়ে। ১৯৯৪-এর নভেম্বরের পর আর ওর সঙ্গে দেখা নেই। এরই মধ্যে কলকাতার স্পাের্টসওয়ার্ল্ডের বদলে ওর নতুন ঠিকানা হয়েছে দুবাইয়ের গালফ নিউজ। সবই লােকমুখে শুনেছি, ওর সঙ্গে আর যােগাযােগ নেই, তারপরও ইদানীং বারবার ফিরে ফিরে আসে ও। কানে বাজে কপাল কুঁচকিয়ে বলা ওর সেই কথা, 'আই গট সাম স্মেল'।

যেখানে এই 'গন্ধ' পেয়েছে বলে দাবি রবিনের, মাত্র মিনিট পাঁচেক আগে সেখানে থেকেই এসেছি আমি। সকাল থেকে মুখ ভার করে থাকা কলম্বাের আকাশ তখন টিপটিপ জল ঝরাতে শুরু করেছে। ১৯৯৪-এর সেপ্টেম্বরে আয়ােজিত সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজের নাম বদলে 'রেইন ওয়ার্ল্ড সিরিজ' রাখলে আর কেউ আপত্তি করবে না—অবস্থা এমনই। সেই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে প্রতীক্ষিত ম্যাচটিও যে বৃষ্টির রাহুগ্রাসে পড়তে যাচ্ছে, এটি তখনই মােটামুটি পরিষ্কার। ভারত-পাকিস্তান কোনাে দলই প্র্যাকটিসে যায়নি। সে টুর্নামেন্ট কাভার করতে ভারতীয় সাংবাদিক ছিল অনেক। ভারতীয় অধিনায়ক মােহাম্মদ আজহারউদ্দিন ও ম্যানেজার অজিত ওয়াদেকার তাই হােটেলে অনানুষ্ঠানিক একটা সংবাদ সম্মেলনের মতাে করতেন প্রতিদিনই।

পাকিস্তান দলের তাে আর সে দায় নেই, সে দেশের মাত্র একজন সাংবাদিকই তখন আছেন কলম্বোতে। আজহার-ওয়াদেকারের কথা শােনার পর তাই সেলিম মালিক-ইন্তিখাব আলম আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ালেন। টুর্নামেন্টে নিজের দেশ থাকলে সাংবাদিকদের চাপ অনেক বেড়ে যায় ঠিকই, তবে বড় একটা সুবিধাও থাকে। নিজেদের দল নিয়েই লেখার থাকে অনেক কিছু। নিজের দেশ না থাকলে তাে আপনি সত্যিকার অর্থেই 'নিরপেক্ষ'। ম্যাচের প্রিভিউ বলুন, বা ম্যাচ উত্তর প্রতিক্রিয়া বলুন, প্রতিদ্বন্দ্বী দুই দলের বক্তব্যই তাতে চাই-ই চাই।

চাই বলেই কলম্বাের লঙ্কা ওবেরয় হােটেলের লবি থেকে সেলিম মালিকের রুমে ফোন। আমি হাউস ফোনের দিকে এগােচ্ছি দেখেই রবিন প্রায় চিৎকার করে বললাে, 'আমি কিন্তু এখনই মালিকের রুমে যাচ্ছি। একটু আগে কথা হয়েছে। তুই এখন আবার সময় চাইলে হয়তাে আর কারও সঙ্গে কথাই বলবে না। তুই ফোনটা একটু পরে কর।'

অন্য কেউ বললে এই অনুরােধ রাখার প্রশ্নই উঠত না। তবে কলম্বোতে গিয়েই প্রথম পরিচয়, তারপরও সদ্য পরিচয়ের সব বাধা টপকে কদিনের মধ্যেই অদ্ভুত এক অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব হয়ে গেছে রবিনের সঙ্গে। 'আপনি থেকে ‘তুমি'তে প্রায় না থেমেই 'তুই' য়ে নেমে এসেছি দুজন। রবিনের অনুরােধ তাই রাখতেই হলাে। শর্ত একটাই, পরে সেলিম মালিক যদি আমাকে সময় না দেয়, তবে পরদিনের ম্যাচ নিয়ে পাকিস্তান অধিনায়কের ভাবনার একটা হদিস দেবে ও আমাকে।

অন্যের মুখে ঝাল অবশ্য খেতে হয়নি। রবিনকে লিফট থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেই আমি টেলিফোনের সামনে এবং সেই ট্যুরে ক্রিকেটারদের রুমে ঢোকার জন্য আমার ভিসা হয়ে দাঁড়ানাে 'বাংলাদেশের সাংবাদিক' শব্দযুগল কাজে দিল এবারও । তখনই রুমে আহবান সেলিম মালিকের। 'ভেরি বিজি' পাকিস্তান অধিনায়কের শর্ত একটাই—'অনলি টেন মিনিটস।'

সেলিম মালিকের রুমে তখন আরও চারজন। রুমমেট অফ স্পিনার আকরাম রাজা। বাকি তিনজনের দুজন অপরিচিত, অন্যজন পাকিস্তানি ফটোগ্রাফার মঈন-উদ-দিন হামিদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে টুর্নামেন্টের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই। সেলিম মালিকের দায়সারা গোছের গৎবাঁধা সব উত্তরে 'টেন মিনিটস' শেষ হওয়ার আগেই কথা শেষ।

হোটেল রুমে আরও চারজন লোক। সেলিম মালিককে খুব অস্থির মনে হচ্ছে। তখন এতে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখিনি। হয়তাে পরে শ্রীলঙ্কায় ১৯৯৪-এর ওই সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ অনেক কিছুর শুরু বলে জানার পরই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে মন।

ফাইনালে উঠতে হলে পাকিস্তানকে শুধু ভারতের বিপক্ষে জিতলেই হত না, রানরেটেও অনেক পেছনে ফেলতে হতাে প্রতিপক্ষকে। সেলিম মালিক পরস্পরবিরােধী সব কথা বললেন সে ব্যাপারে। একবার বলছেন, 'আবহাওয়া যে রকম, তাতে কাল খেলা হলেও হবে কার্টেলড ওভারের। তাই আমাদের ফাইনালে ওঠার সম্ভাবনা দেখছি না।' আবার পর মুহূর্তেই পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের মুখের সেই পরিচিত বুলি, 'আমরা মুসলমান। আল্লাহ বিশ্বাস করি। আল্লাহ চাহে তাে আমরাই ফাইনাল খেলব।'

কোনাে রকমে ইন্টারভিউটা শেষ করতে চাইছিলেন বলেই সেলিম মালিক অমন বলছিলেন কী-না, কে জানে! তবে মনে আছে খুব অস্থির মনে হচ্ছিল তাঁকে। মনে হচ্ছিল, কোনো একটা জটিল বিষয়ের সমাধান খুঁজে না পেয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। মঈন-উদ-দিন হামিদ বেরিয়ে যাওয়ার সময় যখন আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি আর কতক্ষণ আছি, রসিকতা করে বললাম, 'সেলিম ভাই তাে আমাকে ১০ মিনিট সময় দিয়েছিলেন। এখন তাে মনে হচ্ছে না, সহজে যেতে দেবেন!' সেই সরল রসিকতাটাও বুঝতে না পেরে সেলিম মালিক রীতিমতাে আতংকিত হয়ে বললেন, 'না, না, আমি খুব ব্যস্ত।'

সত্যি কথাটা বলি, তখন এতে কোনো অস্বাভাবিকতা দেখিনি বা সেলিম মালিককে অস্থিরও মনে হয়নি। হয়তাে পরে শ্রীলঙ্কায় ১৯৯৪-এর ওই সিঙ্গার ওয়ার্ল্ড সিরিজ অনেক কিছুর শুরু বলে জানার পরই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে মন। অস্বাভাবিকতা কিছু থাকলেও তখন তাে বােঝারই ক্ষমতা নেই আমার। এর আগে সে বছরই ফেব্রুয়ারিতে নিউজিল্যান্ড সফরে যাওয়ার পথে ঢাকা থেমেছিল পাকিস্তান দল। খেলােয়াড়দের বিদ্রোহে ওয়াসিম আকরাম অধিনায়কত্ব হারানাের পর হঠাৎই অধিনায়ক হয়ে যাওয়া সেলিম মালিকের একটা সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। সেই প্রথম আমার বিখ্যাত কোনাে ক্রিকেটারের রুমে যাওয়া। এর আগে ঢাকাতেই মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনকে ইন্টারভিউ করলেও তা করেছি হোটেলের লবিতে বসে। এক বছরও হয়নি, কলকাতায় ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট দিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কভার করায় অভিষেক । তাই খুঁটিয়ে দেখার পেশাদার সাংবাদিকের চোখ তখনাে আমার হয়নি, বরং ওয়াসিম আকরাম-ওয়াকার ইউনিসদের ইন্টারভিউ করার সময় চোখে-মুখে তখনাে উপচে পড়ছে মুগ্ধতা।

এখন ক্রিকেট সাংবাদিকতা মানে তাে শুধু গুগলি আর চায়নাম্যানের পার্থক্য জানা নয়। ঘুষ, বাজি, ম্যাচ পাতানাে এই বিচ্ছিরি শব্দগুলােও ঢুকে পড়তে চাইছে ক্রিকেট অভিধানে! প্রতি রাতেই পত্রিকার পাতায় যখন এসব কলঙ্ক লিখতে হয়, তখনই হঠাৎ কানে বাজে রবিনের কণ্ঠস্বর, 'আই গট সাম স্মেল।'

এ কারণেই সেলিম মালিকের রুম থেকে নিজে নেমে লবিতে যখন রবিনকে একটু উদভ্রান্ত দেখলাম, তখনাে অন্য কিছু মনে হয়নি আমার। আমি তখন লেখার ইনট্রো হাতড়ে মরছি। কিছুক্ষণ পর সেই হােটেলেই থাকা 'দ্য হিন্দু' ও 'স্পাের্টস্টারে'র ক্রিকেট প্রতিনিধি রামস্বামী মােহন এসে লবিতে বসলেন আমাদের পাশে। রবিন তাকেই বললাে, 'আরএম (রামস্বামী মােহনের নামের আদ্যক্ষর) একটু আগে সেলিম মালিকের রুম থেকে এলাম। আই গট সাম স্মেল।'

দুজনের কথপোকথন থেকে যা বুঝলাম, সেই 'স্মেল' মানে গন্ধটা টাকা-পয়সা সংক্রান্ত এবং তা পরদিনের ম্যাচ নিয়ে বাজি নিয়ে। সেলিম মালিকের রুমে বাকি দুজন লােক এবং তাঁদের হাবভাব দেখে রবিনের ওই সন্দেহ। আমি তো শুনে স্তম্ভিত; এই ফাজিল বলে কি! আমার চোখে ক্রিকেট তখন শুধু খেলাই নয়, মহান এক আদর্শ। মানবিক দোষ-ক্রটির উর্ধ্বে প্রায় দেবদূতের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত ক্রিকেটাররা। রবিনের ওই কথায় তাই খুবই বিরক্ত হয়েছিলাম। এই 'সন্দেহবাতিকগ্রস্ত' লােকটির হাত থেকে ক্রিকেট এবং ক্রিকেটারদের রক্ষা করার মহান ব্রত নিয়ে একটু তীব্র ভাষাতেই আক্রমণ করেছিলাম ওকে, 'তােদের কলকাতার সাংবাদিকদের এই এক দোষ। খারাপ কিছু খুঁজে বেড়ানােটাই তােদের নেশা, সেটা বানিয়ে হলেও।'

বন্ধু বলেই রবিন রাগ করেনি। বরং মৃদু হেসে বলেছিল, 'ঠিক আছে, বাদ দে!'

রবিনের সঙ্গে দেখা হয়নি অনেক দিন। কিন্তু ইদানীং বারবারই ফিরে আসে ও, লঙ্কা ওবেরয় হােটেলের লবিতেও ফিরে যেতে হয় বারবার। হায়! এখন ক্রিকেট সাংবাদিকতা মানে তাে শুধু গুগলি আর চায়নাম্যানের পার্থক্য জানা নয়। ঘুষ, বাজি, ম্যাচ পাতানাে এই বিচ্ছিরি শব্দগুলােও যে এখন ঢুকে পড়তে চাইছে ক্রিকেট অভিধানে! এখন প্রতি রাতেই পত্রিকার পাতায় যখন এসব কলঙ্ক লিখতে হয়, তখনই হঠাৎ কানে বাজে রবিনের কণ্ঠস্বর, 'আই গট সাম স্মেল।'

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×