ফেলপসের কাছে সাঁতার যখন `জীবন`

রিও অলিম্পিক ২০১৬

উৎপল শুভ্র

৬ এপ্রিল ২০২১

ফেলপসের কাছে সাঁতার যখন `জীবন`

মাইকেল ফেলপস: অবসর-পরবর্তী জীবনের ছবিটা মনে মনে সাজিয়ে নিয়েছিলেন রিও অলিম্পিক শেষেই। ছবি: গেটি ইমেজেস

রিওর বিকেলে অলিম্পিকে তাঁর শেষ সংবাদ সম্মেলনে মাইকেল ফেলপসের কথা শুনে মনে হলো, অবসর-পরবর্তী জীবনটা তিনি মনে মনে অনেক গুছিয়ে নিয়েছেন। আরও কত কিছু করার আছে জীবনে! এর মধ্যে একটা হলো, পানিতে ডুবে এই যে এত শিশু-কিশোরের মৃত্যু হয়, সাঁতার শিখিয়ে তাঁদের জীবন বাঁচানো। শুনতে শুনতে মাইকেল ফেলপসকে আর শুধুই একজন সাঁতারু মনে হয় না। মনে হয়, অনেক বড় মানুষ।

প্রথম প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০১৬। প্রথম আলো।

সাঁতারপুলে কতবার রেকর্ড ভাঙা-গড়ার খেলায় মেতেছেন, তাঁর নিজের পক্ষেও তা বলা সম্ভব নয়। এটাও কি একটা রেকর্ড যে, অলিম্পিকে দুটি বিদায়ী সংবাদ সম্মেলন করলেন মাইকেল ফেলপস!

লন্ডনে বিদায় বলার দুই বছরের মধ্যেই আবার ফিরেছিলেন পুলে। ফেলপসের বিদায় মানে আসলেই বিদায় কি না, তা নিয়ে তাই অনেকের মনেই সংশয়। সতীর্থ ও প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী রায়ান লোক্‌টি বলে দিয়েছেন, আবারও ফেলপসের সঙ্গে লড়তে চান। চার বছর পর টোকিও অলিম্পিকেও তিনি থাকবেন এবং নিশ্চিত যে, ফেলপসকেও পাবেন সেখানে।

ফেলপস হাসতে হাসতে উড়িয়ে দেন সেই সম্ভাবনা, ‘চার বছর পর রায়ান থাকলে থাকতে পারে, আমি আর নেই।’ উদভ্রান্ত এক সময় কেটেছে প্রথমবার বিদায় নেওয়ার পর। পরশু রিওর বিকেলে অলিম্পিকে শেষ সংবাদ সম্মেলনে মাইকেল ফেলপসের কথা শুনে মনে হলো, এবার তা হওয়ার সম্ভাবনা কম। অবসর-পরবর্তী জীবনটা তিনি মনে মনে অনেক গুছিয়ে নিয়েছেন। আরও কত কিছু করার আছে জীবনে! এটাও পরিষ্কার বোঝা গেল, সেই জীবনের কেন্দ্রে থাকবে রবার্ট বুমার। তাঁর তিন মাসের শিশুপুত্র।

আগের রাতে অলিম্পিকে তাঁর শেষ ইভেন্টে সোনা জিতে ভিলেজে ফিরে বুকে জড়িয়ে ধরতে ঘুম থেকে তুলেছেন বুমারকে। বুমারের মা নিকোল জনসন একটু রাগই করেছেন। সেই রাগ কমাতেই কিনা বুমারের ডায়াপার বদলে দেওয়ার কথা জানালেন হাসতে হাসতে। ছেলে যখন তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসে, সেই অনুভূতির কোনো তুলনা খুঁজে পান না।

অলিম্পিকে আর একটা সোনার পদক হলেই বলা যেত, প্রতিবছরের জন্য একটি সোনার পদক! মোট ২৮টি পদকের ২৩টিই সোনা। কোথায় রেখেছেন সেই পদকগুলো? ফেলপস হাসেন, ‘গোপন একটা জায়গায় রেখেছি। সেটি কোথায়, খুব বেশি মানুষ তা জানে না।’

রিওর অলিম্পিক অ্যাকুয়াটিক সেন্টারের গ্যালারিতে মায়ের কোল থেকে বাবাকে অলিম্পিক সোনা জিততে দেখেছে ছোট্ট বুমার। অলিম্পিক সোনার মাহাত্ম্য তার বুঝতে পারার কথা নয়, বড় হয়ে হয়তো বুঝবে। সেই বড় হওয়ার সময়টার একটা মুহূর্তও মিস করতে চান না। রিওতে বুমারকে দেখলেন চার সপ্তাহ পর, এটুকু সময়েই নাকি অনেক বদলে গেছে ছেলেটা। এই বদলে যাওয়াটাই প্রাণভরে দেখবেন ফেলপস আর ফিরে ফিরে তাকাবেন সাঁতারময় হয়ে থাকা ২৪ বছরের দিকে।

অলিম্পিকে আর একটা সোনার পদক হলেই বলা যেত, প্রতিবছরের জন্য একটি সোনার পদক! মোট ২৮টি পদকের ২৩টিই সোনা। কোথায় রেখেছেন সেই পদকগুলো? ফেলপস হাসেন, ‘গোপন একটা জায়গায় রেখেছি। সেটি কোথায়, খুব বেশি মানুষ তা জানে না। আমি যে ওগুলো খুব নিয়মিত দেখি, তা নয়। তবে আজ (রোববার) সকালে এই অলিম্পিকে জেতা পদকগুলো একখানে করে দেখলাম। দেখতে দেখতে একটু হাসলাম। ২৮টা পদক একসঙ্গে করলে তা দেখতে ভালোই লাগবে।’

বলতে বলতেই আবার দেখা দেন বাবা ফেলপস। ছেলেকে সবগুলো পদক দেখানোর দিন গুনছেন বলে জানান। ছেলে সবকিছু বাঁ হাতে ধরতে চায়। ‘মনে হয় ও “লেফটি”-ই হবে’—বলার সময় হাসেন। যেন বাঁহাতি হওয়াটা খুবই মজার ব্যাপার। ২৩টি সোনা (অলিম্পিকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সোনাজয়ীর চেয়ে যা আড়াই গুণেরও বেশি) ও ২৮টি পদক জয়ের এই রেকর্ড কোনো দিন ভাঙবে কি না, এই প্রশ্নটা শুনেও যেন খুব মজা পান। উত্তরটা অবশ্য সিরিয়াসলিই দেন, ‘কেউ যদি এই রেকর্ডকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে, আমি খুশিই হব। রেকর্ড ভাঙতে দেখতে আমাদের সবারই ভালো লাগে। আর রেকর্ড নিয়ে একটা কথাই তো আছে—রেকর্ড হয়ই ভাঙার জন্য। মার্ক স্পিৎজের রেকর্ড একদিন ভেঙে যাবে, এটাও তো অনেক দিন ভাবতে পারেনি। কিন্তু ভেঙেছে তো! এমনই হয়। আমার রেকর্ডও হয়তো একদিন ভাঙবে। কবে, কোথায় এটাই হলো প্রশ্ন।’

এই রেকর্ড ভাঙার পূর্বশর্তটা বলে অবশ্য ঠিকই বুঝিয়ে দেন কাজটা কত কঠিন, ‘আমার ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বিস্ময়কর যদি কোনো কিছুকে বলি, তা হলো দীর্ঘ সময় ধরে সুতীব্র ইচ্ছা ও নিবেদন ধরে রাখা। এ কারণেই আজ আমি এখানে।’ সেই সাফল্যের রহস্যটাকেও খুব সরল করে দেন, ‘এটা এমন অসাধারণ কিছু নয়। লক্ষ্য ঠিক করা, নিজের ওপর বিশ্বাস রাখা এবং সেটি করতে না পারা পর্যন্ত হাল না ছাড়া, এই তো! আমার জীবনেও উত্থান-পতন এসেছে, কিন্তু হাল ছেড়ে না দেওয়ার ওই মন্ত্রটা খুব ছোটবেলাতেই আমার রক্তে মিশে গেছে।’

শুধু সাঁতারে নয়, জীবনে যেকোনো ক্ষেত্রেই সাফল্য পাওয়ার চাবিকাঠি যে ‘মন’, সেটাও ব্যাখ্যা করেন, ‘মনটাই হলো আসল। মনে যে কী শক্তি লুকিয়ে, বেশির ভাগ মানুষই তা জানে না।’ অলিম্পিকে শেষ সাঁতারের জন্য ওয়ার্মআপ করতে যখন চশমা পরছেন, দুই চোখে তখন জলের ধারা। এত দিনের বন্ধন ছিঁড়ে ফেলার দুঃখে কাতর তিনি। কিন্তু সকালে ঘুম ভাঙার পর, এত দিনের প্রতিযোগিতামূলক সাঁতারজীবন শেষ হয়ে যাওয়ার কথা মনে করে এতটুকুও দুঃখ হয়নি মনে। বরং সেখানে আশ্চর্য এক প্রশান্তি, ‘ঠিক যেভাবে শেষ করতে চেয়েছিলাম, সেভাবেই শেষ করতে পেরেছি। লন্ডনে এমন মনে হয়নি। ওখানে রাতে ঘুমও হয়নি, এখানে খুব ভালো ঘুমিয়েছি।’

অন্যদের হারাতে সাঁতারে নামছেন, এটি আর কখনো ঘটবে না বলে আবারও জানিয়ে দেন। এখন শুধু মনের আনন্দে সাঁতরানোর কথাও। সেটি শুধু ৫০ মিটার পুলের এপার-ওপার নয়, কখনো কখনো তা হবে কিলোমিটারের পর কিলোমিটারও। অন্য কোনো ভূমিকায় থাকতে চান সাঁতারের সঙ্গেই। সাঁতারের সমার্থক হয়ে গেছে তাঁর নাম, সেই দায়িত্ববোধ থেকেই কিনা খেলাটির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবেন। এই অলিম্পিকের অভিজ্ঞতা থেকে রোমাঞ্চিতও বোধ করেন, ‘একসময় সাঁতার ছিল শুধু যুক্তরাষ্ট্র আর অস্ট্রেলিয়ার লড়াই। আর এখানে কত দেশের সাঁতারু পদক জিতল! এখন আর কে কোন দেশের সাঁতারু, কে এক নম্বর লেনে আর কে আট নম্বরে, তাতে কিছু আসে যায় না। যে কেউ জিততে পারে।’

এখানে মাইকেল ফেলপস পুলে জিততে নামেননি। ছবি: গেটি ইমেজেস

শুধু সাঁতারই নয়, সব খেলাকেই ডোপিংয়ের অভিশাপ থেকে মুক্ত দেখতে চান। বাকি সবাই ‘ক্লিন’ বলে নিশ্চিত ছিলেন, এমন কোনো ফাইনালে সাঁতরাননি বলে আক্ষেপ করেন। অবসর-পরবর্তী জীবনের কথা বলতে গিয়ে সাঁতারকে করে তোলেন জীবনের সমার্থক, ‘আমি সাঁতারকে জীবনরক্ষাকারী হিসেবে দেখতে চাই। কত মানুষ জলে ডুবে মারা যায়! আমি চাই, এটার শেষ হোক। বলতে পারেন, এটাই আমার প্যাশন। গত দুই বছরে হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে সাঁতার শিখিয়েছি। আমি এমন আরও শিশুকে জলাতঙ্ক থেকে রক্ষা করতে চাই। যদি এটা করতে পারি, তাহলেই আমার জীবন সার্থক।’

সাঁতারু মাইকেল ফেলপস সাঁতারের সীমানা ছাড়িয়ে হঠাৎই ‘মানুষ’ হয়ে যান। অনেক বড় মানুষ!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×