বাবার দুঃখ-ঘোচানিয়া মেয়ে

বিশ বছর আগে ও পরে

বেইজিং অলিম্পিক ২০০৮

উৎপল শুভ্র

৬ এপ্রিল ২০২১

বিশ বছর আগে ও পরে

বিশ বছর আগে পারেননি বাবা ভ্যালেরি লিউকিন। তাতে কী, মেয়ে নাস্তিয়া লিউকিন আছেন না! ছবি: গেটি ইমেজেস

বিশ বছর আগে সিউল অলিম্পিকে অল-অ্যারাউন্ড ইভেন্টে পয়েন্টের ভগ্নাংশের ব্যবধানে সোনা হারিয়েছিলেন ভ্যালেরি লিউকিন। বিশ বছর পর, বেইজিং অলিম্পিকে একই ইভেন্টে সোনা জিতে বাবার দুঃখ মুছে দিয়েছিলেন মেয়ে নাস্তিয়া লিউকিন। এটা বাবা-মেয়ের সেই গল্প।

প্রথম প্রকাশ: ১৬ আগস্ট ২০০৮। প্রথম আলো।

ভ্যালেরি লিউকিনের বুকে বিশ বছর ধরে জেঁকে বসা পাথরটা কাল নেমে গেল! নামিয়ে দিল তাঁর ১৯ বছর বয়সী মেয়ে নাস্তিয়া লিউকিন।

চেহারা-উচ্চতা-হাসিতে অদ্ভুত মিল—দেখতে ঠিক সের্গেই বুবকার মতো। কাল দুপুরে বেইজিংয়ের অলিম্পিক ইনডোর হলে তাঁকে ঘিরেই সব আলো। আলোটা আসলে নাস্তিয়া নামের সূর্যের, যার আলোতে আলোকিত ‘চাঁদ’ ভ্যালেরি!

গায়ে ইউএসএ লেখা ট্র্যাকস্যুট, পরিচয় যুক্তরাষ্ট্র মহিলা জিমন্যাস্টিকস দলের কোচ। এই পরিচয় পরে। তার আগে তাহলে কী? ১৯৮৮ সিউল অলিম্পিকে দুটি সোনাসহ চারটি পদকজয়ী জিমন্যাস্ট। কাজাখস্তানে জন্মানো ভ্যালেরির গায়ে তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতাকা।

একটু আগে শেষ হওয়া অল-অ্যারাউন্ড জিমন্যাস্টিকসে সোনা-রুপা দুটিই জিতেছে যুক্তরাষ্ট্রের দুই মেয়ে। অলিম্পিক ইতিহাসে এই প্রথম মেয়েদের অল-অ্যারাউন্ডের এক-দুইয়ে মার্কিন জিমন্যাস্ট। মিক্সড জোনে সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়ানো ভ্যালেরি লিউকিনের কথা আর ফুরোতে চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। স্বাভাবিক মুখে লেগে থাকা হাসিটাও। তবে সেই হাসি শুধুই তৃপ্ত কোচের হাসি নয়, একটু পরপরই রূপ বদলে তা গর্বিত বাবার হাসি হয়ে যাচ্ছিল। কোচ হিসেবে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারছেন, কিন্তু বাবায় রূপান্তরিত হতেই হারিয়ে যাচ্ছে ভাষা, ‘আমার মনে হয়, কোনো বাবাই এই অনুভূতির বর্ণনা করতে পারবে না।’

ভ্যালেরি লিউকিন কখনো কোচ থেকে বাবা হয়ে যাচ্ছেন, পর মুহূর্তেই বাবা থেকে কোচ। ছবি: গেটি ইমেজেস

তা নয় বোঝা গেল। কিন্তু বিশ বছর আগে-পরের ব্যাপারটা তো ব্যাখ্যা দাবি করছে। সেটি এমন—বিশ বছর আগে সিউল অলিম্পিকে অল-অ্যারাউন্ড ইভেন্টে পয়েন্টের ভগ্নাংশের ব্যবধানে সোনা হারিয়েছিলেন ভ্যালেরি। এতগুলো বছর পাথর হয়ে বুকে জেঁকে বসা সেই দুঃখ কাল ভুলে গেলেন ভ্যালেরি লিউকিন। ‘সিউলে সামান্য ব্যবধানে ভ্লাদিমিরের (আর্তিওমভ) কাছে হেরে অল-অ্যারাউন্ড সোনাটা পাইনি। বিশ বছর আগের সেই ভুলটা আমার মেয়ে আজ ঠিক করে দিল’—এবার আর কোনো সন্দেহ থাকল না যে, ভ্যালেরির মুখের এই হাসিটা গর্বিত বাবার।

একটু পরে মেয়ের কথাতেও অলিম্পিক সোনা জয়ের চেয়েও বড় হয়ে উঠল এই তৃপ্তিটাই, ‘আমার বাবা এত কাছে গিয়েও অল-অ্যারাউন্ড সোনা পাননি। এ নিয়ে তাঁর দুঃখ ছিল। আজ আমি তা মুছে দিয়েছি।’  

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছিলেন ভ্যালেরি। টেক্সাসে ওয়ার্ল্ড অলিম্পিক জিমন্যাস্টিকস একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে শুরু করেন কোচিং ক্যারিয়ার। নাস্তিয়ার জিমন্যাস্ট না হওয়াটাই হতো অস্বাভাবিক। কারণ তাঁর মা আনা কচনেভাও ছিলেন জিমন্যাস্ট। যেনতেন জিমন্যাস্ট নন, রিদমিক জিমন্যাস্টিকসে সাবেক বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। একাডেমিতে কোচ হিসেবে তিনিও আছেন, মেয়ের সঙ্গে বেইজিংয়েও এসেছেন। তবে টেনশন সহ্য করতে পারবেন না বলে ইনডোর হলে ঢোকেননি, প্রতিযোগিতার সময়টায় ঘুরে বেরিয়েছেন বাইরে বাইরে। ভ্যালেরির কাছ থেকে মুঠোফোনে মেয়ের বিশ্বজয়ের খবর পেয়ে কাঁদতে শুরু করেন তিনি। নীরব আনন্দাশ্রু নয়, হাউমাউ করে কান্না। ভ্যালেরি মজাও করেছেন, ‘কী ব্যাপার, তুমি কি ভুল শুনলে নাকি? আমাদের মেয়ে তো হারেনি, সোনা জিতেছে!’

কোচ-বাবার দ্বৈত ভূমিকায় ‘অভিনয়’ করতে কোনো সমস্যা হয় না ভ্যালেরির? ‘সমস্যা হবে কেন? প্রতিযোগিতার সময় আমি কোচ, প্রতিযোগিতার আগে-পরে বাবা।’ কোচ-বাবা দুই ভূমিকাতেই মেয়ের বিশ্ব জয়ের মূলে দেখেন অসম্ভব মানসিক শক্তিকে, ‘ওর মধ্যে একটা বাঘ আছে।’ ‘বাঘ’ আছে বলেই ২০০৬ সালে অ্যাংকেলে অস্ত্রোপচার ও পরের বছর আবারও জেগে ওঠা একই সমস্যা জয় করে কাল সোনার পদক গলায় পরলেন নাস্তিয়া। আছে বলেই তাঁর প্রথম রোটেশন ভল্টে খারাপ করে দশম স্থানে থাকার পরও আনইভেন বার, বিম ও ফ্লোর এক্সারসাইজে পেছনে ফেলতে পারলেন বাকি সবাইকে।

টেকনিক্যাল খুঁটিনাটি বিশেষজ্ঞদের বিষয়, সাধারণ দর্শকের চোখ জিমন্যাস্টিকসে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি খোঁজে সৌন্দর্য। যে বিবেচনায় নাস্তিয়া লিউকিনকে মনে হলো বাকিদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে। টেলিভিশনে যা দেখায়, জিমন্যাস্টরা তার তুলনায় অনেক ছোটখাটো। সামনাসামনি দেখলে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হয়, যেন মানুষের ‘বনসাই’! ৫ ফুট ৩ ইঞ্চির নাস্তিয়াকে মানতে হবে ব্যতিক্রম বলে, নইলে কাল তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের সবাই তো ৫ ফুটের নিচে। ফুটফুটে মুখ, বাকিদের তুলনায় বাড়তি উচ্চতা, ছিপছিপে শরীর, লম্বা পা—সব মিলিয়ে নাস্তিয়া লিউকিন যেন মনে করিয়ে দিলেন নাদিয়া কোমানেচের কথা। নাদিয়ার নিজেরও কি তা-ই মনে হলো? বিমে নাস্তিয়ার অপরূপ ফুল ফোটানো দেখতে দেখতে মেক্সিকান এক টিভির ভাষ্যকার হয়ে বেইজিংয়ে আসা রুমানিয়ান কিংবদন্তির মুখনিঃসৃত অস্ফুট প্রশংসাধ্বনি তো এমনই মনে করাল।

বাবা অল-অ্যারাউন্ডে অলিম্পিক সোনা জিততে পারেননি, মেয়ে পেরেছেন। অলিম্পিক পদক-সংখ্যায় বাবাকে হারিয়ে দেওয়াটাই কি পরবর্তী লক্ষ্য? ‘এখনো তো বাবা অনেক এগিয়ে। তবে আমার আরও তিনটি ইভেন্ট (আনইভেন বার, ব্যালান্স বিম ও ফ্লোর এক্সারসাইজ) এখনো বাকি। দেখা যাক কী হয়!’—নাস্তিয়া তাঁর অপূর্ব হাসিটা আবার দিলেন।

বেশি-বেশি বাবা হয়ে যাচ্ছে ভেবেই কি না, মায়ের কথা বলাটাও কর্তব্য বলে মনে হলো নাস্তিয়ার। ‘কয়েক মাস আগে আমাকে প্রেরণা জোগায় এমন কিছু ছবি-টবি দিয়ে একটা বোর্ড বানিয়েছিলাম। মা করলেন কী, সেখানে তাঁর জেতা একটা পদক ঝুলিয়ে দিলেন। গত কয়েক মাস প্রতিদিন ওটা দেখতে দেখতে বাড়তি একটা অনুপ্রেরণা বোধ করেছি আমি।’

জিমন্যাস্টদের বড় কঠিন জীবন। প্রায় সবারই তিন-চার বছর বয়সে শুরু। সমবয়সী অন্য শিশুরা যেখানে ইচ্ছেমতো খেলে বেড়ায়, ‘খেলা’র আবরণে তাদের চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সাধনা। নাস্তিয়া লিউকিনেরই যেমন সপ্তাহে গড়ে ৩৬ ঘণ্টা অনুশীলনেই কাটে। ১৯ বছরের জীবনের ১৫ বছরই এমন কেটেছে। অলিম্পিক সোনাটা গলায় পরার পর কেন কাঁদলেন, সেটি পরিষ্কার হয়ে গেল এই কথায়, ‘এত বছর ধরে এত চোট-আঘাত, এত রক্ত, এত কান্না, এত কষ্ট সব আজ সার্থক।’

যে পদকের জন্য এত কষ্ট, এত ত্যাগ। ছবি: গেটি ইমেজেস

‘রক্ত’টা নিশ্চয়ই প্রতীকী অর্থে বলা। বাকিগুলো আক্ষরিকভাবেই নেওয়া যায়। অলিম্পিক সোনা জেতার পর যে কারোরই এমন মনে হওয়ার কথা। নাস্তিয়া লিউকিনের আরেকটু বেশিই মনে হচ্ছে। ২০ বছর ধরে বাবার বুকে জেঁকে বসে থাকা পাথরটা যে নামিয়ে দিতে পারলেন!

শেয়ার করুনঃ
আপনার মন্তব্য
আরও পড়ুন
×